অস্তিত্ব নিয়ে ‘ধোঁয়াশা’

ভারতের ধানবীজ ‘মিনিকিট’ থেকে মিনিকেটের উৎপত্তি

‘অস্তিত্ব’ নিয়ে ধোঁয়াশার মধ্যেই মিনিকেট বন্ধে আইন

মিনিকেট নিয়ে ‘গভীর ষড়যন্ত্র’ হচ্ছে, দাবি ব্যবসায়ীদের

চাল ছাঁটাই-পলিশের প্রক্রিয়া চিহ্নিতের দাবি ক্যাবের

ডেস্ক রিপোর্ট: ‘মিনিকেট’ নামে বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের চালের ছড়াছড়ি। বাজারে এ চালের কদরও বেশ, দামটাও চড়া। তবে সরু ও ঝকঝকে চেহারার এ মিনিকেট চাল ঠিক কোন জাতের ধান থেকে তৈরি, তা নিয়ে আলোচনা দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) বলে আসছে, মিনিকেট নামে কোনো ধান নেই। ব্রির উদ্ভাবিত বিভিন্ন সরু আকৃতির ধান থেকে উৎপাদিত চাল পলিশ করে বাজারে মিনিকেট নামে বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা। তবে কিছু মিলমালিক ও ব্যবসায়ীদের দাবি উল্টো। তারা বলছেন, মিনিকেট নামেও ধান আছে, যার আবাদ খুবই কম। তাহলে বাজারে যে মিনিকেটের ছড়াছড়ি, তা এলো কোথা থেকে- ভোক্তাদের এমন প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব নেই কারও কাছে। তবুও দিনের পর দিন বাজারে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে ‘মিনিকেট চাল’।
খাদ্য মন্ত্রণালয় ও ব্রি সূত্র বলছে, বিভিন্ন জাতের ধানের চাল ছাঁটাই করে মিনিকেট বানানো হয়। এ প্রক্রিয়া বন্ধে আইন করছে সরকার। মিনিকেট নামে কোনো চাল বাজারজাত না করতেও ব্যবসায়ী ও মিলমালিকদের নির্দেশ দিয়েছে সরকার।

তবে সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ দুই অধিদপ্তরের গবেষণায় উঠে এসেছে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য। গবেষকদের একদল বলছে, ‘মিনিকেট জাতের ধান আছে। তবে আবাদ কম। মিনিকেট নামে যে চাল বিক্রি হয়, তা কিছুটা পলিশ করা হয়। তবে মোটা চাল ২৫-৩০ শতাংশ ছাঁটাই করে মিনিকেট চাল বানানোর যে অভিযোগ, তার কোনো প্রমাণ মেলেনি।’ আরেক দল গবেষকের দাবি, ‘মিনিকেট ধান নেই। ব্রির বিভিন্ন জাতের ধান ছাঁটাই ও পলিশ করে মিনিকেট নামে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে।’
অন্যদিকে ব্যবসায়ী ও মিলমালিকরা বলছেন, চাল ছাঁটাইয়ের কোনো মেশিন নেই। উত্তরাঞ্চলে ব্যাপকভাবে জিরাশাইল ধানের আবাদ হয়। এ জিরাশাইল ধানই কৃষকরা মিনিকেট নামে বাজারে বিক্রি করেন। এ ধান থেকে তৈরি হয় মিনিকেট চাল। সরকার যদি মিনিকেট নামে চাল বাজারজাত বন্ধ করে, তাহলে অন্য নামে বাজারজাত করা হবে। দিন শেষে অবস্থা দাঁড়াবে ‘যে লাউ সেই কদু’।

মিনিকেট নিয়ে যত মত
গবেষকদের একপক্ষের মতে, বাজারে মিনিকেট নামে যে চাল পাওয়া যায়, সেটার উৎপত্তি ভারতের এক ধরনের ধানের বীজের প্যাকেট থেকে। ‘মিনিকেট’ শব্দটি এসেছে ইংরেজি ‘মিনিকিট’ থেকে, যা কোনো ধানের জাত নয়। এটা এক ধরনের প্রোগ্রাম বা কর্মসূচি। ভারত সরকার কৃষকদের উপহার হিসেবে যে প্যাকেটে ধানের বীজ দিতো, তা ‘মিনিকিট’ নামে প্রচলিত। এ জাতের আবাদ বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায়ও শুরু হয়। পরে তা বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সেটাই পরবর্তীতেসময়ে মিনিকেট নামে পরিচিতি পায়।
ভিন্নমত গবেষকদের অন্যপক্ষের। তারা বলছেন, যেকোনো দেশীয় জাতের মোটা চাল ঘষামাজার পর চকচকে ও সরু করে মিনিকেট নামে বিক্রি হচ্ছে। সরু চালের জনপ্রিয়তার কারণে ব্রাউন রাইস (বাদামি) ও মোটা চাল ছাঁটাই করেন মিলমালিকরা। পরে ‘মিনিকেট’ নাম দিয়ে বিক্রি করা হয়। এ কাজে মিলমালিকদের অতিরিক্ত দুটি যন্ত্র কিনতে হয়। এসব যন্ত্র ব্যবহার করে মোটা চালকে কম খরচে সরু করা সম্ভব।
মিলমালিক ও ব্যবসায়ীদের একটি অংশের দাবি, উত্তরাঞ্চলে ব্যাপকভাবে জিরাশাইল জাতের ধানচাষ হয়। এ জিরাশাইল ধান স্থানীয় বাজারে মিনিকেট নামে কেনাবেচা চলে। মিলমালিকরা এ জাতের ধান কিনে মিলে যে চাল তৈরি করেন, তা মিনিকেট নামে বাজারে বিক্রি হয়।
মিনিকেট ‘রহস্যের’ জট খোলেনি গবেষণায়ও
‘মিনিকেট চাল’ ঠিক কোন ধান ও কী প্রক্রিয়ায় বাজারে আসে, তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদেরও। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ অধিদপ্তর এবং সংস্থাও এ প্রশ্নে ‘চুপ’। মিনিকেট চালের এ রহস্য উন্মোচনে গবেষণা করে সরকার। ২০২০ সালে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ খাদ্য পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণ ইউনিট (এফপিএমইউ) একটি গবেষণা করে।
তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, অটো রাইস মিলের মালিকরা আধুনিক মেশিন ব্যবহার করে চালের আকার পরিবর্তন করেন। চাল পলিশ করে ঝকঝকে রূপ দেন। এ প্রক্রিয়াকে তারা ‘রাইস মিলিং’ বলেন। এ প্রক্রিয়ায় চাল প্রস্তুতের পর বাজারজাত করার ফলে কোন চাল কোন ধানের তা বোঝার কোনো উপায় থাকে না। ফলে বিভিন্ন জাতের ধান থেকে উৎপাদিত চাল মিনিকেট নামে চালিয়ে দেওয়া হয়।
তবে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ আরেক সংস্থা জাতীয় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের গবেষণা প্রতিবেদনে ভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। তারা দাবি করেছেন, রাইস মিলগুলো বিআর-২৮, বিআর-২৯ ও অন্যান্য জাতের ধান কিনে চাল তৈরি করে। এ চাল কেটে সরু করা বা ২৫-৩০ শতাংশ ছাঁটাই করার যে অভিযোগ রয়েছে, তা সত্য নয়। মিলগুলো কিছুটা পলিশ করে। আর পরিমাণে কম হলেও বোরো মৌসুমে মিনিকেট নামে ধান চাষ হয়। এ ধান থেকেও মিনিকেট চাল তৈরি করে বাজারজাত করা হয়।
গবেষণা প্রতিবেদনে ভারত সরকারের ‘মিনিকিট’ নামে ধানবীজ বিতরণ এবং তা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ার দাবিকেও সমর্থন করেছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের গবেষণা টিমের প্রধান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মো. ইকবাল রউফ মামুন। তিনি বলেন, ‘চাল ছাঁটাইয়ের ধারণা ভুল। কিছুটা পালিশ হয় এটা সত্য। কিন্তু মোটা চালকে ছাঁটাই করে কখনো সরু চাল করা যাবে না। কারণ কোনো চাল ২৫-৩০ শতাংশ ছাঁটাই করলে তা ভেঙে যাবে।’

‘অস্তিত্ব’ নিয়ে ধোঁয়াশার মধ্যেই মিনিকেট বন্ধে আইন

গবেষক, কৃষক, মিলমালিক ও ব্যবসায়ীদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে মিনিকেট ধানের অস্তিত্ব নিয়ে যখন ধোঁয়াশা, তখন মিনিকেট নামে চাল বিক্রি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। যে জাতের ধান, চালের বস্তায় সেই জাতের নাম লিখতে হবে। এ বিষয়ে আইনও করা হচ্ছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ভিন্ন জাতের ধান থেকে তৈরি চাল মিনিকেট নামে বিক্রি করলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর জেল বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রেখে আইনের খসড়া করা হয়েছে। খসড়া আইনটি এরই মধ্যে অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা কমিটি। আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে এটি সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে পাস হতে পারে।
বিদ্যমান ‘দ্য ফুড গ্রেইন্স সাপ্লাই অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৯’ ও ‘দ্য ফুড অ্যাক্ট, ১৯৫৬’ যুগোপযোগী করে ‘খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন আইন-২০২২’ করা হয়েছে। আইনের পরে খাদ্যদ্রব্য ভিন্ন বা কাল্পনিক নামে বাজারজাত করা যাবে না।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘চালের বস্তার গায়ে ধানের জাতের নাম লিখে বস্তায় যদি সেই অতিরিক্ত ছাঁটাই বা পলিশ করা চাল দেওয়া হয়, তাহলে কী লাভ হবে? ভোক্তারা কোনো সুফল পাবেন না। চাল কীভাবে ছাঁটাই বা পলিশ করা হচ্ছে তা চিহ্নিত করতে হবে। এরপর তা বন্ধে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে।’

মিনিকেট ইস্যুতে মিলমালিকদের বিরুদ্ধে ‘গভীর ষড়যন্ত্র’
মিনিকেট চাল বন্ধ করা নিয়ে যে ‘ইস্যু’ তৈরি করা হচ্ছে, তা গভীর ষড়যন্ত্র বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, চালের দাম কমাতে ব্যর্থ হয়ে সরকার মিনিকেট বন্ধ করে ভোক্তাদের সামনে ‘মুলা ঝুলিয়ে’ রেখেছে। দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ সরকারের এটা এক ধরনের কৌশল। দৃষ্টি ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করার জন্য এটা করা হচ্ছে।

অটো রাইস মিল মালিক সমিতি ও ধান-চাল আড়তদার সমিতির অভিযোগ, চালকল মালিকদের হেয় করতে বিভিন্ন মহল থেকে অবৈজ্ঞানিক ও বাস্তবতা-বিবর্জিত কথা বলা হচ্ছে। এসব কথাবার্তার কোনো ভিত্তি নেই।

নওগাঁর ধান-চাল আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নিরোদ বরণ সাহা বলেন, ‘৩০ বছরের বেশি সময় ধরে বাজারে কম-বেশি মিনিকেট চাল ছিল। কৃষকদের কাছ থেকে আমরা মিনিকেট নামে ধান কিনছি। এখন শুনছি মিনিকেট ধান নেই। তাহলে যেটা আমরা কিনেছি, সেটা কোন ধান? সেটাও স্পষ্ট করা হচ্ছে না। অথচ প্রচার করা হচ্ছে মেশিনে ছাঁটাই বা পলিশ করে চাল সরু করা হচ্ছে। বাস্তবতা হলো- দেশের কোনো চালকলে চাল ছাঁটাই বা সরু করার মেশিন নেই।’
তিনি বলেন, ‘মিনিকেট চাল নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে। সরকার যেসব কথা প্রচার করছে, তা বিভ্রান্তিমূলক ও বাস্তবতা-বিবর্জিত। কোনো কিছু পরিষ্কার না করার পরও মিনিকেট বন্ধে আইন হচ্ছে, এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।’

ব্রি তাদের উদ্ভাবিত ধানের জাত জনপ্রিয় করতে তোড়জোড় করছে মন্তব্য করে নিরোদ বরণ সাহা বলেন, ‘মিনিকেট বন্ধের পেছনে আমরা দুটি কারণ দেখছি। তার মধ্যে একটি হলো- ব্রি (বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট) চায় তাদের উদ্ভাবিত ধানের জাতের নামে চাল বাজারজাত হোক। যেমন- ব্রি-২৮, ব্রি-১৯ ধানের চাল। বাজারে এখনো সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম ব্রির উদ্ভাবিত জাতবহির্ভূত মিনিকেট চাল। এটা বন্ধে তারা তোড়জোড় করছে।

‘দ্বিতীয় কারণটি হলো— বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো চাচ্ছে, মিনিকেট বন্ধ হলে তাদের ব্র্যান্ড দ্রুত বাজার ধরতে পারবে। ছোট ছোট মিল, যারা মিনিকেট নামে চাল বিক্রি করতো, তারা বাজার থেকে ছিটকে পড়বে। বাজার ধরতে তারা সরকারকে পেট্রোনাইজ করছে’ বলেও অভিযোগ করেন ব্যবসায়ী নিরোদ বরণ সাহা।
জাগোনিউজ২৪.কম