ডেস্ক রিপোর্ট: ইরানে বিভিন্ন সময়ে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। তবে এবারের পার্থক্য হলো—এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের বিভিন্ন অংশে। ৩১টি প্রদেশের প্রতিটিতে ছড়িয়েছে এই বিক্ষোভ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মাশহাদ এবং কোম। প্রদেশ দুটি শিয়া মতাবলম্বীদের ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত। এছাড়া কোম ইসলামি বিপ্লবের নায়ক আয়াতুল্লাহ খোমেনির নিজ শহর। বিক্ষোভ দমনে কর্তৃপক্ষ যথারীতি ইন্টারনেট বন্ধ বা সীমিত করে দেওয়া এবং ধরপাকড় ও মাত্রাছাড়া শক্তি প্রয়োগের মতো কৌশলগুলো ব্যবহার করেছে। বিক্ষোভে এরই মধ্যে প্রাণহানির সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়েছে।
এবারের বিক্ষোভের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ব্যাপকসংখ্যক নারীর অংশগ্রহণ। অনেকে একে নারীদের বিপ্লব বলেও অভিহিত করেছে। ইতিপূর্বে ১৮৮৬ সালে তামাক আন্দোলন ও ১৯০৬ সালে সাংবিধানিক বিপ্লবের সময় নারীরা মাঠে নেমেছিলেন। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর নারীদের এভাবে রাজপথে নামতে দেখা যায়নি। আরেকটি বৈশিষ্ট্য তরুণদের অংশগ্রহণ। বহু সেলিব্রেটি রাস্তায় নেমেছেন। অনেক দেশের নারীরা একাত্মতা জানিয়ে নিজেদের চুল বিসর্জন দিয়েছেন। বর্তমান বিক্ষোভটি হিজাববিরোধী হিসেবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে পরিচিতি পেয়েছে। পুলিশ হেফাজতে মাহশা আমিনির মৃত্যুর খবর চাউর হওয়ার পর নারীসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বাস্তবে এটি শুধু হিজাব বাধ্যবাধকতার বিরুদ্ধে কিছু মানুষের প্রতিবাদ নয়, ইন্টারনেটকে আরো কড়া নজরদারির আওতায় আনতে প্রস্তাবিত প্রোটেকশন বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোও এর একটি উদ্দেশ্য। ধারণা করা হচ্ছে, বিলটি পার্লামেন্টে গোপনে পাশ করা হয়েছে। এসব কিছুর পরও এবারের বিক্ষোভ সফল হবে বলে খুব একটা আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু কেন?

যে কোনো বিপ্লবের পেছনে একটি আদর্শিক অনুপ্রেরণা থাকে। বাস্তবতা হলো বিপ্লব সফল হওয়ার পর সেই প্রেরণা আর চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে না। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের সময় মানুষের প্রত্যাশা ছিল বিদেশি শক্তির আধিপত্য থেকে মুক্তি এবং স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার অর্জনের পাশাপাশি দেশের ভেতর স্বৈরতন্ত্র থেকে মুক্তি ও নিপীড়িত মানুষের দুর্ভোগের অবসান ঘটানো। ৪৩ বছর পর এসেও বলতে হয়—তার অনেকগুলোই পূরণ হয়নি। তেহরান ইউনিভার্সিটির সোশিওলজির অধ্যাপক তাজি আজাদারমাকি মনে করেন, ইসলামি প্রজাতন্ত্র এখন নানাবিধ সংকটের মুখোমুখি। এর থেকে উদ্ধার পেতে সবাইকে নিয়ে চলার মতো যৌক্তিক একটি মানসিকতাচর্চার সময় এসে গেছে। তার ধারণা, প্রজাতন্ত্র মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতি সহানুভূতিশীল নয়। অথচ যে কোনো সমাজের চালিকাশক্তি মধ্যবিত্ত শ্রেণি। যে কোনো পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও তারা প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। একটা দেশের সুশীলসমাজ বলতে যা বোঝায়, তা মূলত এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির। এদের শক্তির ওপর ভর করেই বিপ্লব হয়ে থাকে। তার মতে, ইরানে এখন একটি অবিকশিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি আছে। দুর্নীতিসহ নানারকম অবক্ষয়ে জড়িয়ে পড়েছে এই শ্রেণিটি।
সামাজিক উন্নয়নের জন্য নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ, আস্থা, সহযোগিতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের মতো সামাজিক মূলধনের প্রয়োজন হয়, ইরানের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মাহমুদ সারিওগালাম এ কথা লিখেছেন। তার মতে—সিভিল সোসাইটির রক্ষাকবচ হিসেবে যে প্রতিষ্ঠানগুলো থাকা দরকার, সরকার সেগুলোকে নিজের অস্তিত্বের জন্য চ্যালেঞ্জ মনে করে। টুইটার, ফেসবুক ও ইনস্ট্রাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দেশটিতে ঠিকই আছে কিন্তু সেগুলোর ওপর কঠোর সরকারি সেন্সরশিপ আছে। তেহরান ইউনিভার্সিটির নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক ইবরাহিম ফাইয়াজ বলেন, সাধারণ মানুষ হতাশ ও ক্ষোভ উগরে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন সময় সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে থাকে। যে কারণে কর্তৃপক্ষ এখন খুব হুঁশিয়ার। কখনো আংশিক, কখনো পুরো বন্ধ থাকছে নেট। সিভিল সোসাইটি যেন শক্ত ভিত গাড়তে না পারে, সেজন্য সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে ‘নৈতিক শিক্ষক’ ও ‘সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব’ পদে বিভিন্ন ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে বিপ্লবের ধর্মীয় চরিত্র রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত অংশও সিভিল সোসাইটির প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন। গণমানসের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিনিধিত্ব করে সমাজের যে অংশ বা সমাজের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যাদের দরকার, সেই মধ্যবিত্তরা অবহেলিত রয়েছে দীর্ঘসময় জুড়ে।
সিভিল সোসাইটির অনুপস্থিতির ফলে এলিটদের সঙ্গে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। সমাজবিজ্ঞানী আলি সায়ির গবেষণায় দেখা গেছে—দেশটির ক্ষমতার চক্র শুরু হয় সরকারি পদে আসীন হওয়ার পর থেকে। প্রভাবশালী কাউন্সিলগুলোতে তাদেরই আধিপত্য লক্ষণীয়। আমলা, সেনাবাহিনী, রাজনৈতিক এলিট ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র সব মিলিয়ে এক ধরনের মুষ্ঠিমেয়র শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। তবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনুপস্তিতিই যে আন্দোলনগুলো ব্যর্থ হওয়ার একমাত্র কারণ, সেটাও বলা যাবে না। এবারের বিক্ষোভে বাইরের বিভিন্ন পক্ষের সক্রিয় উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ কারণে দেশটির অনেক মানুষ বিক্ষোভের সঙ্গ একাত্ম হতে পারেনি।
ইত্তেফাক