Home জাতীয় পরিকল্পনা ছাড়াই ইভিএম ক্রয়-সংরক্ষণ নিয়ে বিপাকে ইসি

পরিকল্পনা ছাড়াই ইভিএম ক্রয়-সংরক্ষণ নিয়ে বিপাকে ইসি

34

ডেস্ক রিপোর্ট: অযত্ন আর অবহেলায় মাঠ পর্যায়ে পড়ে আছে হাজার কোটি টাকায় ক্রয় করা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)। মাঠ পর্যায়ে ফেলে রাখা হয়েছে ৮৫ হাজার ইভিএম। ইতিমধ্যে ভোটকেন্দ্রে থাকা ইভিএমগুলো সরিয়ে নেওয়ার জন্য স্কুল-কলেজ থেকে বারবার তাগাদা দেওয়া হলেও অবকাঠামোর অভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্হা গ্রহণ করতে পারছে না নির্বাচন কমিশন (ইসি)। যথাযথ পরিকল্পনা ছাড়াই ক্রয়কৃত ইভিএমগুলো সংরক্ষণ করা নিয়ে বিপাকে পড়েছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। উপায়ান্তর না পেয়ে ইভিএম রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাড়ি বা ফ্ল্যাটের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ চেয়ে সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। যদিও এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি ইসি।

এ বিষয়ে ইভিএমের প্রকল্প পরিচালক কর্নেল মো. কামাল উদ্দিন ইত্তেফাককে বলেন, প্রকল্পের আওতায় ১ লাখ ৫৪ হাজার ইভিএম ক্রয় করা হয়। এর মধ্যে ৮৫ হাজার বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে রয়েছে। মাঠ পর্যায়ে থাকা ইভিএগুলো স্হায়ীভাবে সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

ইসি সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পের অর্থ ছাড়ের আগেই ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি করে ৮০ হাজার ইভিএম ক্রয় করে ইসি। ঐ সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ইভিএমের বিরোধিতা করলেও পিছু হটেনি কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন। এজন্য নেওয়া হয় প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। সিদ্ধান্ত হয় ২ লাখ ২০ হাজার ইভিএম ক্রয়ের। বিগত কমিশনের পরিকল্পনা ছিল দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের। ঐ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ধাপে ধাপে মোট ১ লাখ ৫৪ হাজার ইভিএম বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির কাছ থেকে কেনা হয়। প্রতিটি মেশিনের পেছনে ব্যয় হয় ২ লাখ ১০ হাজার টাকার মতো। যা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ব্যবহূত ইভিএমের চেয়ে দাম কয়েকগুণ বেশি। কিন্তু এত দামি মেশিন কোথায় রাখা হবে, তার জন্য প্রকল্পতে কোনো ব্যবস্হা রাখা হয়নি। ফলে যথাযথ যত্ন ছাড়াই এগুলো স্হান পাচ্ছে মাঠ কর্মকর্তাদের কার্যালয়ে। ইভিএমে মেশিন একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা, আর্দ্রতায় সংরক্ষণ করতে হয়। বিদ্যমান স্টোররুমে এই ব্যবস্হার কতটা সুযোগ রয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যদিও বর্তমান কমিশনের ধারাবাহিক সংলাপে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার পক্ষে মত দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিশিষ্টজনেরা।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছয়টি আসনে ৫ হাজারের মতো উন্নতমানের এই ইভিএম দিয়ে ভোট নেওয়া হয়। বর্তমানে প্রতিটি নির্বাচনেই কম-বেশি হারে এই যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের পর প্রতিটি স্হানীয় সরকারের নির্বাচনেও ইভিএম ব্যবহার করা হয়। প্রথম দিকে ইভিএমগুলো আগারগাঁও নির্বাচন ভবনের বেজমেন্টে রাখা হতো। কিন্তু সমস্যা হয় নির্বাচনের সময় মাঠ পর্যায়ে মেশিন পাঠানো নিয়ে। কেননা, এতে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যায়। এরপর সিদ্ধান্ত হয় মাঠ কার্যালয়গুলোতে ইভিএম রাখার। কিন্তু কোনো মাঠ কার্যালয়ে ইভিএম রাখার মতো পর্যাপ্ত কক্ষ নেই। এছাড়া ইভিএম রাখার জন্য যে অবকাঠামো প্রয়োজন, তা-ও নেই।

গত বছরের শেষের দিকে উপজেলা নির্বাচন অফিসে ইভিএম মেশিন উইপোকা, তেলাপোকায় নষ্ট করছে বলে খোদ ইসি কর্মকর্তারাই বৈঠকে জানান। এমন অভিযোগের বিষয়ে সরেজমিন তদন্ত রিপোর্টে জানা গেছে ইভিএম সরঞ্জামাদির জন্য ব্যবহূত বেশ কিছু কাগজের প্যাকেট এবং আনুষঙ্গিক সামগ্রীর কিছু তার নষ্ট হয়েছে। ইভিএম মেশিনের কোনো ক্ষতি হয়নি। এরপর স্হানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে ব্যবহার করা ৮৫ হাজার ইভিএম বর্তমানে মাঠ অফিস ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্হানে ভোটকেন্দ্রে সেগুলো রাখা হয়েছে। বিশেষ করে স্কুলগুলোতে। মাঠ কর্মকর্তারা জানান, স্কুল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বারবার তাগাদা দিচ্ছে মেশিনগুলো সরিয়ে নেওয়ার। কিন্তু তাদের এসব মেশিন রাখার জায়গা নেই। এ অবস্হায় প্রথমে সিদ্ধান্ত হয় মাঠ কার্যালয়গুলোর পরিধি বাড়ানোর। কিন্তু গণপূর্ত বিভাগ জানিয়েছে আঞ্চলিক, জেলা বা উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়গুলোর যে নকশা, তাতে এগুলো ওপরের দিকে আর বাড়ানো যাবে না। এরপর সিদ্ধান্ত হয় ভবন ভাড়া নেওয়ার। কিন্তু সে সিদ্ধান্তেও কোনো কূল-কিনারা মিলছে না। কেননা, ইভিএম রাখার জন্য প্রতি উপজেলায় ৫ হাজার বর্গফুট জায়গা প্রয়োজন। কিন্তু এই পরিমাণ জায়গা একই ভবনে মিলছে না। আর মিললেও নিরাপত্তা ব্যবস্হা ভালো নয় বা ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ভাড়া পাওয়া গেলেও দেখা যাচ্ছে তা বাজেটের চেয়ে বেশি। এ অবস্হায় প্রস্তাবসমূহের সার-সংক্ষেপ প্রস্ত্তত করে কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে অর্থ বরাদ্দের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে পত্র প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত রয়েছে। বর্তমানে বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

এ বিষয়ে ইসির প্রশাসন ও অর্থ বিভাগের যুগ্ম-সচিব মো. কামাল উদ্দীন বিশ্বাস ইত্তেফাককে জানান, ইভিএম সংরক্ষণের জন্য সব আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা জায়গাসহ অবকাঠামো/ফ্ল্যাট/বাড়ি, ইভিএম ধারণ ক্ষমতা, ভাড়ার পরিমাণ ইত্যাদি সংক্রান্ত প্রস্তাব ইসি সচিবালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর এ বিষয়ে ইত্তেফাককে বলেন, সবে আমরা দায়িত্ব নিয়েছি। এখনো ইভিএমের বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।

২০১০ সালের ১৭ জুন দেশে যন্ত্রের মাধ্যমে ভোটগ্রহণের প্রচলন শুরু করে বিগত ড. এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন। সে সময় তারা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে ১২ হাজার টাকা করে প্রায় ১ হাজার ২৫০টি ইভিএম তৈরি করে নেয়। ঐ কমিশন এই যন্ত্রে ভোট নিয়ে সফলও হয়। পরবর্তীকালে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশন রাজশাহী সিটি নির্বাচনে ২০১৫ সালের ১৫ জুন ভোট নিতে গেলে একটি মেশিন বিকল হয়ে পড়ে। সে মেশিনটি পরে আর ঠিক করতে পারেনি কমিশন। ঐমেশিনগুলো নষ্ট করে নতুন করে আরো উন্নত প্রযুক্তি ইভিএম তৈরির নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় রকিব কমিশন। এরপর ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কে এম নুরুল হুদা কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় ১ লাখ ৫৪ হাজার করে ইভিএম ক্রয় করে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি থেকে।-ইত্তেফাক