Home মতামত আগস্ট শেষ হয়! মুজিব নিয়ে লেখা শেষ হয় না!!

আগস্ট শেষ হয়! মুজিব নিয়ে লেখা শেষ হয় না!!

31

সরদার মোঃ শাহীন:

ভাবছিলাম বাংলাদেশের গেল ৭৫ বছরের কথা। ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর প্রথমত পাকিস্তান আমল এবং বর্তমানের বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে ক’জন প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ কিংবা রাষ্ট্রনায়কের নাম কমবেশি আলোচনায় আসে বা যাঁরা ঘুরেফিরে আলোচনায় থাকেন তাঁদের সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়। হাতে গুনেই বলে দেয়া যায় তাঁদের নাম। নামে এবং দামে তাঁরা প্রত্যেকেই স্বমহিমায় উজ্জল। বিশেষ দিনে কিংবা বিশেষ আলোচনায় তাঁরা থাকেন সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে।
তাঁদের মধ্যে শেরে বাংলা ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী এবং ভাসানী অন্যতম। এই তিনজন জাতীয় নেতাকে বাঙালি জাতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে, সম্মান করে। কেবল বিশেষ দিনগুলোতেই নয়, মাঝেমধ্যেও করে। তাঁদেরকে সম্মান করে জীবদ্দশায় তাঁদেরই রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্যে। তাঁদের বুদ্ধিমত্তার জন্যে। দেশমাতৃকায় তাঁদের পজিটিভ এবং দৃঢ়চেতা ভূমিকার জন্যে। তাঁদের কর্মকান্ডই তাঁদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বাঁচিয়ে রেখেছে মানুষের অন্তরে এবং দেশীয় মিডিয়ার নানা ধরনের কভারেজে।
কিন্তু পুরো বছরব্যাপী তাঁরা মিডিয়ায় কভারেজ পান না। বা মিডিয়ায় থাকেন না। না থাকেন প্রিন্ট মিডিয়ায়, না থাকেন ইলেকট্রনিক্স এ। তবে একজন ব্যতিক্রম আছেন। তিনি বাংলার অবিসংবাদিত নেতা। তিনি বঙ্গবন্ধু; বাঙালি জাতির জনক। সারা বছরব্যাপী তিনি মিডিয়ায় কভারেজ পান। প্রতিদিন পান। এদেশে এমন কোন দৈনিক পত্রিকা নেই, যেখানে তাঁর নামটি কোন না কোনভাবে জায়গা পায় না। ব্যাপারটি এমন, যেন তাঁর নামটি নেয়া ছাড়া কোন পত্রিকাই বেরুতে পারে না।
সব সময় তিনি থাকেন। তিনি থাকেন খবরের মাঝে, কখনো বা শিরোনামে। তিনি থাকেন শ্রদ্ধায়, স্মরণে এবং বরণে। তাঁকে নিয়ে বিশেষ কলামও বছরব্যাপীই বিশেষ করে মার্চ, আগস্ট আর ডিসেম্বরে বের হয়। শতশত লেখা হয় তাঁকে নিয়ে। এবারের আগস্টেও তাঁকে নিয়ে প্রচুর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। লেখায় ছেয়ে গেছে প্রিন্ট মিডিয়ার জগত। বলা যায়, আগস্ট শেষ হচ্ছে! কিন্তু মুজিব নিয়ে লেখা শেষ হচ্ছে না!! মুজিব নিয়ে সেদিন শামসুদ্দিন পেয়ারের লেখাটি পড়লাম। তিনি লিখেছেন,
আওয়ামী লীগের একজন বড় নেতা জনাব শামসুল হক (ইসলাম?) যার বাড়ি বৃহত্তর ঢাকা জেলার কোথাও ছিল (দুঃখিত, আমি তাঁর সম্পর্কে আর কিছু জানি না), যিনি উচ্চকণ্ঠ ও সুশিক্ষিত ছিলেন, চমৎকার ইংরেজি বলতেন, বঙ্গবন্ধুর খুব ঘনিষ্ঠ ও স্নেহাস্পদ ছিলেন, যিনি ১৯৭৩-এর ৫ সেপ্টেম্বরে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত ৪র্থ ন্যাম (জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রসমূহের সংগঠন) এক সময়ে অত্যন্ত শক্তিশালী, (বর্তমানে দুর্বল) সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গী ছিলেন, তার কাছে একদিন জনাব আমানুল্লাহর দিলকুশার অফিসে বসে শুনেছিলাম, আলজিয়ার্স সম্মেলনের মধ্যবর্তী কোনও এক সময়ে বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে বাদশাহ ফয়সালের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একটি দ্বিপাক্ষিক সাক্ষাৎকারের আয়োজন করা হয়েছিল। সৌদি আরব তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। তার দরুন বাংলাদেশের লোকেরা হজ্বে যেতে পারছিলেন না। বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য বাদশাহ ফয়সালকে অনুরোধ করা, যাতে করে বাংলাদেশের হজ্বপালনেচ্ছু মানুষ পবিত্র ধর্মকর্মটি সম্পাদন করতে পারেন। বঙ্গবন্ধুর এ অনুরোধে বাদশাহ তেমন কোনও উৎসাহ না দেখিয়ে বরং বাংলাদেশের নাম ইসলামিক রিপাবলিক রাখার জন্য চাপ দেন এবং এটাকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির শর্ত বলে উল্লখ করেন। বাদশাহ ফয়সালের এই শর্তারোপে বঙ্গবন্ধু এক সেকেন্ডের জন্য চুপ করে যান। তাঁর চেহারায় ফুটে উঠতে থাকে সেই দুঃসাহসী দুর্বিনীত শেখ মুজিবের আসল মুখ যার অধিকারী মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও কখনো নিজের যা বলার তা বলতে বিন্দুমাত্র ভয় করেননি। দৃশ্যতঃ মর্মাহত বঙ্গবন্ধু তখন বাদশাহ ফয়সালকে বললেন, “ইউর এক্সেলেন্সি, আপনি আমাকে ইসলামের কথা বলছেন? কোথায় ছিল সেদিন আপনার ইসলাম যখন ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তানের মুসলিম সৈন্যরা লক্ষ লক্ষ নিরীহ মুসলমান বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যা করেছে, তাদের নারীদের সম্ভ্রমহানি করেছে? আর আপনি এখন আমাকে বলছেন এক ইসলামিক রিপাবলিকের বিরুদ্ধে লড়াই করে মাত্র স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশকে আবারো আরেকটা ইসলামিক রিপাবলিক বানানোর জন্য। আপনার নিজের দেশের নামই তো হচ্ছে কিংডম অব সাউদি আরাবিয়া, ইসলামিক কিংডম অব আরাবিয়া নয়। বাংলাদেশ কখনোই ইসলামিক রিপাবলিক হবে না।” সেখানে উপস্থিত অন্য মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানগণ বঙ্গবন্ধুর এই প্রজ্ঞা প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব স্পষ্টবাদিতা ও সাহস দেখে বিমোহিত হন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারি বুমেদিয়েন এসে বঙ্গবন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং অন্য কক্ষে নিয়ে যান। এই ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। জীবনে কখনো মাথা নোয়ান নাই। নোয়ালে এখনো আমাদেরকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়েই বেঁচে থাকতে হতো। পিয়নের উপরে চাকুরি পেতাম না। মুদি দোকানদারির বাইরে কোনো ব্যবসা করতে পারতাম না। সালমান রহমানের নিউমার্কেটে একটা দোকান থাকতো, এস আলম ইসলামি ব্যাংকের সামনে টেবিল বসিয়ে ছেঁড়া নোট পাল্টানোর ব্যবসা করতো। এক শ’ টাকার ছেঁড়া নোট বদলে নিরানব্বই টাকা নব্বই পয়সা দিত। আর আমাদেরকে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, পাহাড়তলী, ঝাউতলা, সৈয়দপুরে বিহারি পোলাপানের চড়-থাপ্পড় খেয়ে বেঁচে থাকতে হতো।
কি দারুণ বর্ননা। মুজিবের বর্ণনা। কিন্তু তিনি তো আর এমনি এমনি একদিনে একা একা মুজিব হয়ে ওঠেননি। তাঁর পাশে কেউ না কেউ তো ছিলেন। মাসকাওয়াথ আহসান হয়ত সে কথাই বলার চেষ্টা করেছেন তার লেখায়;
ফজিলাতুন্নেছার মতো মায়াময়ী স্ত্রী থাকলে, দুর্গার মতো দশহাতে সে সবদিক সামলালে, তবেই মানুষের মুজিব হওয়া যায়। স্ত্রী পরিবার পরিচালনার দায়িত্ব নিলে, সন্তানদের মানুষ করার দায়িত্ব নিলে, তবেই সমাজের সন্তানদের ভালোবেসে একটা জীবন ভাসিয়ে দেয়া যায় দেশপ্রেমের ভেলায়। নয়তো ‘জীবন থেকে নেয়া’র গায়ক স্বামীর মতো ফ্যাসিস্ট স্ত্রীর ভয়ে লুকিয়ে ছাদে গিয়ে গাইতে হয়, এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে। অথবা স্ত্রীর গঞ্জনাতে আরো বেশি টাকা উপার্জনের খরগোশ দৌঁড়ে যোগ দিয়ে হতে হয় গণশত্রু সেকেন্ড হোমার অথবা প্লট পদক পদবী বুদ্ধিজীবী। প্রফেসর সালামের মতো স্ত্রীভাগ্য হলে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরষ্কার জুটবে নয়তো জুটবে না; নিভৃতে মৃত্যু হবে বিরল প্রতিভারও। স্ত্রী ভাগ্যই নির্ধারণ করে লোকটা আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানী হবে নাকি জামালোস্টোটলের মতো সহমতাচার্য হবে।
খুবই দুঃখজনক এবং মর্মান্তিক হলো, হাজার বছরের পরাধীন বাংলাকে যিনি স্বাধীন বাংলাদেশ বানিয়ে দিলেন, সেই বঙ্গবন্ধুকে একা নয়, বংশ শুদ্ধ নির্বংশ করে দেবার পরিকল্পনা নিয়েই কুলাঙ্গার খুনীরা ১৫ই আগস্ট ঘটায়। একটা সদ্য স্বাধীন দেশের এই নির্মম হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেও বিশ্ব সেদিন চুপ করে ছিল। একটি কথাও কারো মুখ থেকে বেরোয়নি মানবাধিকার নিয়ে। কেউ কোন কথা বলেনি গণতন্ত্র নিয়ে। আজ এ’দুটি কথা বলার জন্যে অনেকেই কোমরে গামছা বেঁধে মাঠে নেমেছে। প্রতিদিন জাতিকে সবক দিচ্ছে। তারা যে গণতন্ত্রের কথা বলে তার বাস্তব রূপটা বর্ণনা করেছেন শিহাব আহমেদ শাহীন; তার লেখায়। আমার মনে হয় না এর চেয়ে চমৎকার বর্ণনা ইদানীং আর কেউ করেছেন!
কোনো এক স্কুল হোস্টেলে ১০০ জন ছাত্র ছিলো। তাদের টিফিনে প্রতিদিন ‘সিঙ্গাড়া’দেওয়া হতো। কিন্তু ১০০ জনের মধ্যে ৮০ জনই প্রতিদিন এই একই খাবার খেতে চাইতো না। তারা টিফিনে অন্য কিছু খাবারের জন্য হোস্টেল সুপারের কাছে আবেদন জানালো। কিন্তু বাকি ২০ জন প্রতিদিন সিঙ্গাড়াই খেতে চাইলো। অনেক আলাপ আলোচনার পর হোস্টেল সুপার ভোটের ব্যবস্থা করলেন এবং বললেন, তোমরা যে, যেই খাবার খেতে চাও তা লিখে এই বাক্সে ফেলো। যে খাবার সর্বাধিক ভোট পাবে সেই খাবারই প্রতিদিন টিফিনে দেওয়া হবে। ভোট গণনার পর দেখা গেলো, ওই ২০ জন ছাত্র প্রতিদিন সিঙ্গাড়ার পক্ষেই ভোট দিয়েছে। বাকি ৮০ জনের ভোটের ফলাফল নিম্নরূপ: ডালপুরি ১৮ জন। পরোটা ও সবজি ১৬ জন। রুটি ও ছোলার ডাল ১৩ জন। মাখন পাউরুটি ১১ জন। নুডুল্স ১০ জন। ভেজিটেবল রোল ৭ জন। ডিমটোস্ট ৫ জন। ফলাফলে সিঙ্গাড়া সর্বাধিক ভোট পাওয়ায় টিফিনে প্রতিদিন সিঙ্গাড়া দেওয়াই চলতে লাগলো।
নির্বাচনী ফলাফলে আর কিছু না বোঝা যাক, অন্তত এইটুকু বোঝা গেল যে নির্বাচনী গণতন্ত্রেরও জটিল এবং কঠিন দুর্বলতা আছে। সব গণতান্ত্রিক নির্বাচনেই সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতামত জেতে না। বরং সংখ্যাগরিষ্ঠরা মাঝে মাঝে হেরেও যায়। আবার, চাইলে ম্যাকানিজম করেও সংখ্যাগরিষ্ঠদের হারিয়ে দেয়া যায়। বিশ্ব রাজনীতিতে নির্বাচনী গণতন্ত্রের দুর্বলতার এমন ভুরিভুরি উদাহরণ আছে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন সোনার বাংলায় তো আছেই।

-লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা ডট কম।