Home মতামত দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা : পরিচয়হীনতার ইতিবৃত্ত থেকে আলোকিত এক জনপদ

দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা : পরিচয়হীনতার ইতিবৃত্ত থেকে আলোকিত এক জনপদ

20

মো. মামুন অর রশিদ:

রাষ্ট্র ও পতাকা ছাড়া কখনো কি নাগরিক হিসাবে পরিচয় দেওয়া সম্ভব? উত্তর হলো, ‘না’। রাষ্ট্র ও পতাকা না থাকার কারণে যে পরিচয়, তা পরাধীনতা। কয়েক বছর আগেও সিটমহলের মানুষ রাষ্ট্রীয় পরিচয়হীনতার ইতিবৃত্তে বন্দি ছিলেন। এ রকম পরিচয়হীনতার বৃত্তে আবদ্ধ একটি ছোট্ট জনপদের নাম ছিল দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহল। রাষ্ট্রহীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা এখন উন্নয়নের ছোঁয়ায় আলোকিত এক জনপদ।

দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায় কতটুকু উন্নয়ন হয়েছে, তা উপলব্ধি করতে হলে এ সিটমহলের পরাধীনতার ইতিহাস একটু দেখে নেওয়া প্রয়োজন। ছিটমহল সমস্যার ইতিহাস অনেক পুরাতন। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তান ছিটমহল সমস্যার কোনো সমাধান করেনি। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে ভারত-পাকিস্তান ছিটমহলগুলো বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহলে রূপান্তরিত হয়। ১৯৭৪ সালের ১৬ই মে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি’র ১২ ও ১৪ নম্বর সেকশনে ছিটমহল ইস্যুটি সমাধানের কথা বলা হয়। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে দক্ষিণ বেরুবাড়ীর দক্ষিণ অংশের বিনিময়ে ভারতের তিনবিঘা নামক স্থানে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার সঙ্গে ভারতের ১৭৮ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৮৫ মিটার প্রস্থের একটি করিডর বাংলাদেশকে চিরস্থায়ীভাবে বন্দোবস্ত দেওয়ার কথা থাকলেও ভারত সরকার ১৯৯২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৮ বছর বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখে। বাংলাদেশের পাটগ্রাম উপজেলার পানবাড়ী থেকে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার মাঝে মাত্র ১৭৮ মিটার দৈর্ঘ্যের ভারতীয় ভূখণ্ডই দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাবাসীর বন্দিদশার মূল কারণ। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ৪৫ বছর ধরে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার মানুষকে নিত্যপ্রয়োজনে এই ১৭৮ মিটার দুস্তর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে রাতের অন্ধকারে, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গ্রেপ্তার, লাঠিচার্জসহ নানা হয়রানি সহ্য করে।
বাংলাদেশের অনবরত দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে ১৯৯২ সালে সেই করিডর দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার মানুষ খুব সীমিত পরিসরে চলাচলের সুযোগ পায়। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীন হলেও দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার মানুষকে শর্ত সাপেক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশে বৈধভাবে প্রবেশের জন্য দীর্ঘ ২১ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। দুই পাশে সশস্ত্র বিএসএফের সার্বক্ষণিক পাহারায় ১৯৯২ সালের ২৬শে জুন প্রথমে প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর এক ঘণ্টা করে দিনে মোট তিন ঘণ্টার জন্য তিনবিঘা করিডর বাংলাদেশের নাগরিকদের যাতায়াতের জন্য খোলা রাখার ব্যবস্থা করা হয়। এর তিন মাস পর সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত প্রতি এক ঘণ্টা পরপর এক ঘণ্টা করে মোট ছয় ঘণ্টা খোলা রাখার ব্যবস্থা করা হয় এবং এই ব্যবস্থা চলতে থাকে ২০০১ সাল পর্যন্ত। ২০০১ সালে নতুন ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে করিডরটি সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে ১২ ঘণ্টা খোলা রাখার ব্যবস্থা করা হয়। বাকি ১২ ঘণ্টার জন্য দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার পুরো জনপদটি ছিল একটি কারাগার! অবশেষে ২০১১ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার চুক্তি অনুযায়ী করিডরটি ২৪ ঘণ্টার জন্য খুলে দেওয়া হয়। ২০১১ সালের ১৯শে অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে করিডরটি ২৪ ঘণ্টার জন্য উন্মুক্ত রাখার ঘোষণা দেন।
১৯৪৭ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত এখানে কত মানুষ যে বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। মৃত্যুর পর অনেকের ভাগ্যে দাফনের কাপড় পর্যন্ত জোটে নাই। এখনো দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার মানুষ পূর্বের বঞ্চনার কথা স্মৃতিচারণ করলে তাঁদের চোখ দিয়ে পানি ঝরে।
বর্তমান দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায় পুরোদমে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০১১ সালের পূর্বে এখানে কোনো হাসপাতাল ছিল না। বর্তমানে এখানে ২০ শয্যার একটি হাসপাতাল-সহ তিনটি কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কয়েক বছর আগেও এখানে কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এখন হাতের কাছে চিকিৎসা সেবা পেয়ে এখানকার মানুষ আপ্লুত।
শিক্ষাক্ষেত্রেও এগিয়ে যাচ্ছে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা। সরকার ২০১৩ সালের ১৬ই অক্টোবর দহগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করে। পরবর্তী সময় দহগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়কে কলেজিয়েট করা হয়। দহগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি ছয়তলা একাডেমিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও এখানে রয়েছে ৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১টি এমপিওভুক্ত মাদ্রাসা। যে ভূখণ্ডে একসময় সাক্ষরজ্ঞান অর্জন করাও দুরূহ ছিল, সেখানে শিক্ষার্থীরা স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে। এখানকার ছেলে-মেয়েরা এখন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে চাকরি করছেন।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য এখানে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়েছে। এই ফাঁড়ি স্থাপনের ফলে দহগ্রাম ইউনিয়নের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে এখানকার মানুষ শান্তিতে আছেন।
২২.৮ বর্গকিলোমিটারের এই জনপদের প্রায় শতভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছে গিয়েছে। দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার যোগাযোগব্যবস্থাও উন্নত হয়েছে। এখানকার ৪১ কিলোমিটার রাস্তার অধিকাংশই পাকা হয়েছে। বাকি রাস্তাও পাকাকরণের কাজ চলমান।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় দহগ্রামে ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের জন্য গৃহ নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে গৃহহীন মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী এখানে বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা, প্রতিবন্ধীভাতা, মাতৃত্বকালীনভাতা-সহ অন্যান্য ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। যা দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দহগ্রাম ইউনিয়নের অনেকেই নিজস্ব খামার তৈরি করেছেন। এখানে মোট ১৭৫টি হাঁস, মুরগি ও গোরুর খামার রয়েছে। এসব খামার স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায় সরকারের ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের ফলে এ এলাকার মানুষ প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ পেতে শুরু করেছে। দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায় সরকারের এই উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকলে এ জনপদের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার আরও উন্নয়ন ঘটবে। দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায় রয়েছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব হলে দেশের অর্থনীতিতে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

-লেখক : সিনিয়র তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রংপুর।