Home জাতীয় সুগন্ধায় পোড়া লাশের গন্ধ : কখনো কি জানা যাবে কতো মানুষ প্রাণ...

সুগন্ধায় পোড়া লাশের গন্ধ : কখনো কি জানা যাবে কতো মানুষ প্রাণ হারিয়েছে?

36

আহমেদ জালাল : যাত্রীবাহী লঞ্চে এরকম অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে অঙ্গার হয়ে একসঙ্গে এতো মানুষের মৃত্যু কি কখনও দেখেছে দেশ? যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন এক কালো অধ্যায়। মাঝনদীতে লঞ্চে এমন ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড দেশের ইতিহাসে এটাই কিনা প্রথম? স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে সুগন্ধা আর হাসপাতালের বাতাস। বুকফাটা হাহাকার আর গগন বিদারী আর্তনাদ! পোড়া দেহটা থেকে বেরিয়ে গেছে প্রাণ। শোকে বারবার মুর্ছা যাচ্ছেন স্বজনরা। একেকটি পোড়া দেহের মৃত্যু খবরে স্বজনদের আহাজারিতে এমনিভাবে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। যেন হৃদয় বিদারক এ ঘটনায় শান্তনা দেয়ার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছেন সবাই। শীতের রাতে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে দাউ দাউ আগুনে পুড়ছে লঞ্চ। স্বজনদের আহাজারি আর বাতাসে লাশ পোড়া গন্ধ! কিন্তু কখনো কি জানা যাবে কতো মানুষ যে প্রাণ হারিয়েছে?
স্বজনদের আহাজারিতে আকাশ-বাতাশ ভাড়ী অত:পর মরদেহ নিয়ে ঘরে ফেরার করুন দৃশ্য। আগুনের রহস্য উদঘাটনে তদন্ত কমিটি, ক্ষতিপূরণের ঘোষণা, লঞ্চের ত্রুটি নিয়ে কতো বিজ্ঞজনের কথো কথা-আবার সবকিছুই হয়তবা তিমিরে ঢাকা পড়ে যাবে। লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবেই আবার তদন্ত কমিটি হবে। সেই তদন্ত কমিটির রিপোর্টে কি এমন আশাজাগানিয়া? তদন্ত রিপোর্টে আদৌ কখনো কি হয়েছে? নৌযানের ফিটনেস ঠিক আছে কিনা? চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় কিনা? তদারকি হয় কিনা? ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি থাকলে এমন দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
আহারে এই আমার স্বাধের স্বাধীন বাংলাদেশে! আহারে আর কখেনাই কোনো মরদেহ খুঁজেও পাওয়া যাবে না! আহারে কিছু মরদেহ ডিএনএ টেস্টের জন্য পড়ে থাকবে মর্গে! আহারে কিছু মরদেহ বেওয়ারিশ দাফন হয়ে যাবে! আহারে কেউ নদীতে ঝাঁপ দিয়ে তীব্র ঠান্ডায় প্রাণ হারিয়ে নদীতেই ভেসে গেছে। আহারে মানুষের কি যে আহাজারি! করুন আর্তনাদ! কেউ আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। কেউ পানিতে ঝাঁপ দিচ্ছে। কেউ ফেলে আসা সন্তান বা প্রিয়জনকে খুঁজতে আগুনেও ঝাঁপ দিচ্ছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। পুরো লঞ্চটিতে আগুন ধরে যায়। আগুনের লেলিহান শিখায় লাল হয়ে গেছে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীর পানি। এ যেন বয়ে যায় রক্তের স্রোত। প্রশ্ন হচ্ছে- এটা কি স্রেফ দুর্ঘটনা? নাকি কাঠামোগত হত্যা?
লঞ্চের মাস্টারের গাফিলতি : রাজধানীর সদরঘাট থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় এমভি অভিযান-১০ নামে লঞ্চটি যাত্রা শুরুর পর থেকেই এর ইঞ্জিনের দিক থেকে মাঝে মধ্যেই জোরে শব্দ হচ্ছিলো আর প্রচণ্ড কালো ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিলো। ওই সময় গরম হয়ে উঠছিলো লঞ্চের ফ্লোরগুলোও। লঞ্চের বেঁচে ফেরা কয়েকজন যাত্রী এ তথ্য জানিয়েছেন। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, লঞ্চটি বরিশাল ঘাট ধরে বরগুনা যাওয়ার পথে রাত দুইটার দিকে আগুন ধরে যায়। এ সময় আর্তনাদ, হৈ-চৈ আর চিৎকারে অবর্ণনীয় এক পরিবেশ তৈরি হয়। আগুন থেকে প্রাণ বাঁচাতে নারী, পুরুষ ও শিশুরা নদীতে ঝাঁপ দিতে থাকেন, যাদের অনেকে এখনও নিখোঁজ। একজন যাত্রী বলছেন, যখন মাঝরাতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে তখন একদিকে আগুন আর অন্যদিকে পানি-এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না। লঞ্চের তিন তলার একটি কেবিনে থাকা যাত্রী জহিরুল বলেন, ‘আমরা অনেকেই বুঝতে পারছিলাম যে একটা ঝামেলা হচ্ছে। লঞ্চের ফ্লোরগুলোও গরম হয়ে উঠছিলো। ইঞ্জিনে প্রচণ্ড শব্দ। আর ব্যাপক কালো ধোঁয়া দেখছিলাম। স্টাফরা বলছিলো- সমস্যা হবে না। এরপর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ব্যাপক চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে যায়। দরজা খুলে দেখি আগুন। স্টাফরা তখনও বলছিল ধৈর্য্য ধরেন। কিন্তু আগুনের উত্তাপ সইতে না পেরে নদীতে ঝাঁপ দিলাম।’ জহিরুল প্রায় এক ঘণ্টা ভাসার পর তীরে আসতে সক্ষম হন। আগুনে তার দুই পা পুড়ে গেছে। হাসপাতাল থেকে কথাগুলো বলছিলেন তিনি। যাত্রীরা বলছেন, লঞ্চটি বরিশাল ঘাট ধরে সুগন্ধা নদী হয়ে বরগুনা যাচ্ছিলো। হঠাৎই প্রচণ্ড শব্দ শোনা যায় এবং রাত দু’টার পর থেকে রাত তিনটার মধ্যে সম্পূর্ণ লঞ্চটিতে আগুন ধরে যায়। একপর্যায়ে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলেও গতির কারণে লঞ্চটি রানিং ছিলো বেশ কিছুটা সময়। এ সময়ে বাতাসে আগুন আরও ছড়িয়ে পড়ে। আগুন লেগে যাওয়ার পর নেভানোর কোনো চেষ্টা না করে লঞ্চটির মাস্টার ও শ্রমিক-কর্মচারীরা লঞ্চ থেকে সটকে পড়েন।
লঞ্চ স্টাফদের দুষছেন দগ্ধরা : এমভি অভিযান-১০ লঞ্চ দুর্ঘটনায় স্টাফদের দুষছেন দগ্ধরা। স্বজনহারা দগ্ধ রোগীদের চোখের পানি যেন থামছে না। তাদেরকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও নেই কারও কাছে। শনিবার (২৫ ডিসেম্বর) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কয়েকজন জানান, বরিশাল নদীবন্দর পার হওয়ার আগেই এমভি অভিযান-১০ লঞ্চের দ্বিতীয় তলার ডেক গরম হয়ে যায়। এর ওপর বসা যাচ্ছিল না। বিষয়টি লঞ্চ স্টাফদের একাধিকবার জানানোর পর তারা কম্বল পেতে দেয়। এতেও কাজ হচ্ছিল না। বিষয়টি গুরুত্বেই দেয়নি তারা। লঞ্চটি বরিশাল নৌবন্দরে নোঙর করলে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটতো না। যান্ত্রিক ত্রুটি নিয়ে এভাবে কোনও লঞ্চ চলাচল করতে না পারে। লঞ্চ স্টাফদের কঠোর শাস্তির দাবি জানান চিকিৎসাধীন দগ্ধরা। যান্ত্রিক ত্রুটি নিয়েই ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছিল এমভি অভিযাত্রী–১০। যাত্রীরাই বলছেন, শুরু থেকেই ছিল বেপরোয়া গতি। ত্রুটি থাকায় টেকনিশিয়ানরা ইঞ্জিন মেরামতের কাজ করছিলেন। এ জন্য পুরো গতিতে দুটি ইঞ্জিন চালিয়ে ট্রায়াল দেওয়া হচ্ছিল। আর এতেই মূলত: ইঞ্জিনের অতিরিক্ত তাপে আগুন ধরে যায়। আগুন লেগে যাওয়ার পর নেভানোর কোনো চেষ্টা না করে লঞ্চটির শ্রমিক-কর্মচারী ও মালিক লঞ্চ থেকে সটকে পড়েন।
বাংলাদেশ কার্গো ট্রলার বাল্কহেড শ্রমিক ইউনিয়নের ঝালকাঠি জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মো. সাইফুল ইসলাম ঘটনার পর পরই ঝালকাঠি পৌর শহরের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হুমায়ুন কবির সাগরের সঙ্গে ট্রলার নিয়ে উদ্ধার অভিযানে ঝাপিয়ে পড়েন। তিনি বলেন, অভিযান-১০ লঞ্চটি আগুন লাগার পর ঝালকাঠির ধানসিঁড়ি ইউনিয়নের চরকাঠির নদী সংলগ্ন এলাকায় গিয়েছিল। সেখানে যাত্রীরা নামার চেষ্টাও করেন, কয়েকজন নেমেও যান। কিন্তু হঠাৎ করেই লঞ্চটি পেছনের দিকে আসতে শুরু করে এবং সুগন্ধা নদীর দক্ষিণ প্রান্তে দিয়াকুলে গিয়ে নোঙ্গর করে। আর এ সময়ের মধ্যেই পুরো লঞ্চে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। চরকাঠিতে লঞ্চটিকে নোঙ্গর করে রাখা হলে হতাহতের সংখ্যা অনেক কম হতো বলে দাবি করেন সাইফুল ইসলাম। প্রায় সব যাত্রীই ভালোভাবে লঞ্চ থেকে নেমে যেতে পারতেন বলে মনে করেন তিনি। বলেন, কয়েকটি ট্রলার নিয়ে যাত্রীদের উদ্ধারে আমরা যখন এগিয়ে যাই তখন আগুনের তাপে লঞ্চের কাছে যেতে পারিনি। প্রথমে নদী থেকে দুই পা পুড়ে যাওয়া একজনকে উদ্ধার করি। এরপর আরও ২০ জনকে এবং তারপর একবার ৭০-৮০ জনকে উদ্ধার করেছি। যাত্রীদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, নলছিটির পরেই যাত্রীরা লঞ্চের ইঞ্জিন রুমে বিকট শব্দ পেয়েছেন। আর ইঞ্জিন রুম থেকেই আগুন লেগেছে। পরে যাত্রীরা বাঁচার জন্য যে যেভাবে পারেন লাফিয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ শিশু সন্তানের কথা চিন্তা করে নদীতে লাফ দেননি। সাইফুল ইসলাম বলেন, চরকাঠিতে লঞ্চটি যখন তীরের সঙ্গে ধাক্কা লাগে তখন ওদের (স্টাফদের) উচিত ছিল কোনো কিছুর সঙ্গে বেঁধে দেওয়া। তাহলে হতাহতের সংখ্যা কম হতো। কিন্তু ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লঞ্চটি ভাসতে ভাসতে দিয়াকুলে চলে আসায় হতাহতের সংখ্যা এত হলো। যাত্রীরা জানিয়েছেন, লঞ্চটি যখন চরকাঠিতে পৌঁছায় তখন স্টাফরা লঞ্চের সামনের গেট খোলেননি। টিকিটের কথা চিন্তা করে স্টাফরা গেট খোলেননি বলেও অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। তবে স্টাফরা নদীতে লাফিয়ে পড়ে চলে গেছেন। দিয়াকুলের নদী তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা বলেন, এখানে লঞ্চটি পৌঁছানোর পর স্টাফরা লঞ্চ না বেঁধে চলে যান। স্থানীয়রা অনেকেই লঞ্চটিকে বেঁধে যাত্রীদের উদ্ধার করতে বললেও তারা তা শোনেননি। একই কথা বলেন ওই লঞ্চের যাত্রী নাছিমা। তিনি বলেন, আগুন নেভানো তো দূরের কথা, স্টাফরা যাত্রীদের কোনো ধরনের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেননি। লঞ্চটি তীরে আসার সঙ্গে সঙ্গে তারা লাফিয়ে পড়ে চলে যান।
অভিজ্ঞমহল বলছেন, দেশের প্রতিটি লঞ্চেই ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ যাত্রী বহন করে। লঞ্চে আপদকালীন সময়ে জীবন রক্ষার জন্য বেশকিছু সরঞ্জাম থাকার কথা। লঞ্চের ধারণ ক্ষমতা অনুসারে এসব সরঞ্জাম থাকার কথা। এরমধ্যে লাইফ-বয়া, লঞ্চের ছাদে ছোট বোট অন্যতম। অতীতে যাত্রীবাহী কোনও লঞ্চ বা জাহাজে এমন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনি। পানির উপরে আগুনে পুড়ে এতো মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় লঞ্চ মালিক, যাত্রী ও নৌ মন্ত্রণালয়সহ সবাই হতবিহব্বল। শীতের লেপ, কম্বল ও পোশাক থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে বলে ধারণা অনেকের; যা দাহ্য পদার্থ হিসেবে কাজ করে। সপ্তাহের শেষ দিন থাকায় বৃহস্পতিবার লঞ্চটিতে অনেক যাত্রী ছিল। ঘটনার সময় সবাই ছিল ঘুমে। এজন্য প্রাণহানি বেশি হয়েছে, লঞ্চটিও ছিল মাঝনদীতে। তাছাড়া লঞ্চটি চলতে থাকায় বাতাসে আগুনে আরও ছড়িয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অভিযান-১০ নামের এই লঞ্চটিতে পর্যাপ্ত জীবন রক্ষার সরঞ্জাম ও অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ছিল কিনা, তা তদন্ত করে দেখা হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ
বিআইডব্লিউটিএ)।
বিআইডব্লিউটিএ এর পরিচালক (ট্রাফিক) রফিকুল ইসলাম এর ভাষ্য, ‘লঞ্চে জীবন রক্ষার সরঞ্জাম থাকার কথা। সেটা কতগুলো ছিল, যাত্রীরা সেগুলো ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছিল কিনা, তাও দেখার বিষয়।’ ‘আগুন দোতালায় সূত্রপাত হলে সেখানে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র বা ফায়ার ইস্টিংগুইসার ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। তবে লঞ্চটির ছাদে কোন ছোট বোট ছিল না।’ দেশে এমন ঘটনা অতীতে আর ঘটেনি। ডক ইয়ার্ডে কাজ করার সময় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আছে। তবে যাত্রীবাহী লঞ্চে আগুনের ঘটনা এবং প্রাণহানি এটাই প্রথম।’ তিনি বলেন, ‘এর আগে ডর্ক ইয়ার্ডে মেরামতে থাকা লঞ্চে, যাত্রীবাহী লঞ্চের ইঞ্জিন কক্ষে, কোনও একটি কেবিন বা কক্ষে আগুনের ছোটখাটো ঘটনা ঘটলেও বড় কোনও আগুনের ঘটনা নেই, এটাই প্রথম।’ তিনি বলেন, ‘সাধারণত অনেকসময় ইঞ্জিন রুমে আগুনের ঘটনা ঘটে। সেখানে অগ্নিনির্বাপকের সকল ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু অভিযান-১০ এর ক্ষেত্রে আমরা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি আগুন দোতলা থেকে সূত্রপাত হয়েছে। কীভাবে এই আগুনের সূত্রপাত হলো, তা আমরা তদন্ত করে দেখবো।’ বাংলাদেশ লঞ্চ মালিক সমিতির মহাসচিব শহীদুল হক বলেন, আমি লঞ্চে এমন অগ্নিকাণ্ডের কথা আর শুনিনি। ঘটনার পর আমিও খোঁজ নিয়েছি, এমন ঘটনা আর অতীতে ঘটেনি। এটি কেন ঘটলো, কীভাবে ঘটলো তা তদন্ত করে বের করতে হবে।’
বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) দিনগত রাত ৩টার দিকে ঝালকাঠি সদর উপজেলার গাবখান ধানসিঁড়ি ইউনিয়নের গাবখান চ্যানেলের কাছে সুগন্ধা নদীতে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে বরগুনাগামী অভিযান-১০ লঞ্চটি। অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে কতো যাত্রী ছিলেন, তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সেইসঙ্গে নিশ্চিত হওয়া যায়নি নিখোঁজের সংখ্যাও। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনা থেকে প্রাণে বেঁচে ফেরা যাত্রীদের অভিযোগ, অভিযান-১০ লঞ্চটি ধারণ ক্ষমতার অধিক যাত্রী নিয়ে ঢাকা থেকে বরগুনার উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। লঞ্চে ছিল না অগ্নিনির্বাপণের কোনও ব্যবস্থা। অগ্নিনির্বাপণের জন্য গ্যাস সিলিন্ডার থাকলেও সেগুলো ছিল বিকল। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বছর দুয়েক আগে চালু হয় বিলাসবহুল এমভি অভিযান-১০ লঞ্চ। বরিশালসহ, বরগুনার, বেতাগী কাঁকচিড়া ঘাটে যাত্রী বহন করতো নৌযানটি। মাত্র ১৫ দিন আগে মেরামতের কাজ হয় এটির। এরপর চারটি ট্রিপ সম্পন্ন করে।
এদিকে, বরগুনাগামী অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনাকে কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করছে গণসংহতি আন্দোলন। দলটি আরও বলছে, এটি নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়। সরকারের সীমাহীন লুটপাট ও অপশাসনের ফলেই একের পর এক এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। আর এসব ঘটনায় ঝরছে সাধারণ মানুষের প্রাণ। শনিবার গণসংহতি আন্দোলনের এক বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়। দলটির প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল স্বাক্ষরিত এই যৌথ বিবৃতিতে হত্যাকাণ্ডে দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, সড়ক ও নৌপথে চলাচলকারী পরিবহনের ফিটনেস, সুরক্ষাব্যবস্থা ও অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা যথাযথ আছে কি না, এগুলো তেমন দেখভাল করা হয় না। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) দুর্নীতি ও জবাবদিহি না থাকায় একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। সরকার এ দায় এড়াতে পারে না। দুর্ঘটনার নামে মানুষ হত্যা বাংলাদেশে সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকার সীমাহীন লুটপাট ও দুর্নীতির পথ প্রশস্ত করতে আইনের শাসন ও জবাবদিহিকে বিদায় করে দিয়েছে। এ ছাড়া জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে বলেও দাবি করা হয়। ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দোষীদের যথাযথ শাস্তি এবং হতাহতদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। ২৫ শে ডিসেম্বর গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সংগঠক সুজয় শুভ ও আলিসা মুনতাজ এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিছকই কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং এটি একটি হত্যাকান্ড। এই হত্যাকান্ডের জন্য লঞ্চের কতৃপক্ষ যেমনভাবে দায়ি, তেমনভাবেই সরকারের নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিএ-ও সমানভাবে দায়ি। গণমাধ্যমের তথ্যমতে বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত তিনটার দিকে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ নামক লঞ্চের ইঞ্জিনরুমের পাশের ক্যান্টিনের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হলে আগুন ধরে যায় ১৩ ব্যারেল ডিজেলে। যা ছড়িয়ে পড়ে পুরো জাহাজে। অসংখ্য মানুষ তাতে হতাহত হয়। এই অগ্নিকান্ডের ঘটনায় দোষীদের যথাযথ শাস্তি এবং হতাহতদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে এবং আহতদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এই দুর্ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এ দুর্ঘটনা নৌপরিবহন খাতে রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনারই একটি অংশ মাত্র। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিএ-এর সঠিক নজরদারি থাকলে এধরণের ভয়াবহ ঘটনা ঘটার কথা নয়। দক্ষিণাঞ্চলের বিলাসবহুল প্রায় সকল লঞ্চেই অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, ফায়ার বাকেট, বালুবাহী বালতি, ফায়ার সেফটি অ্যালার্ম, পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেটের ব্যবস্থা নেই। সরঞ্জামের পাশাপাশি প্রচন্ড সংকট রয়েছে প্রশিক্ষণেরও। নৌপরিবহন কর্মীদের জন্য প্যাসেঞ্জার শিপ এনডোর্সমেন্ট কোর্স, সেফটি ড্রিল, মাস্টার ড্রিল ইত্যাদি নানা প্রশিক্ষণ রয়েছে, যেগুলো বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব আসলে সরকারের নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিএ-এর। লঞ্চে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় মালিক, নাবিক, মাস্টারদের যেমন দোষ রয়েছে, এর থেকেও সরকারের নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিএ এই ঘটনার জন্য অনেক বেশি পরিমানে দোষী। লঞ্চের মালিক, নাবিক, মাস্টারদের বিচারের পাশাপাশি নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিএ-কে বিচারের মুখোমুখি করা সময়ের দাবি। বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, এই দুর্ঘটনা নৌপরিবহন খাতে রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার কারণেই ঘটেছে। কাজেই এই হত্যাকান্ডের দায় সরকার এড়াতে পারে না। সড়ক অথবা নৌপথ সবখানেই জনগণের জান-মালের পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এই অব্যবস্থাপনা এবং মুনাফালোভীদের দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানানো হয়। লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহত পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ, আহতদের সুচিকিৎসা; সকল গণপরিবহনে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক ও সুরক্ষা ব্যবস্থা বাধ্যতামূলকভাবে নিশ্চিত করা, শেবাচিমে অবিলম্বে বার্ন ইউনিট চালুর দাবিতে বরিশালে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) বরিশাল জেলা শাখা। শনিবার সকাল ১১টায় বরিশাল অশ্বিনী কুমার হলের সামনে এই সমাবেশ করে দলটি। বাসদ বরিশাল জেলা সভাপতি ইমরান হাবিব রুমনের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বাসদের সদস্যসচিব ডা. মনীষা চক্রবর্তী, নজরুল ইসলাম খান, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের জোহরা রেখা, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের শহিদুল ইসলাম, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের জেলা সভাপতি সাগর দাস আকাশ, বিজন শিকদার, লামিয়া সাইমুন।
প্রসঙ্গত : বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে নলছিটির সুগন্ধা নদীর পোনাবালীয়া ইউনিয়নের দেউরী এলাকায় বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চের ইঞ্জিন রুম থেকে আগুন লাগে। বরগুনাগামী লঞ্চটি বরিশাল ঘাট থেকে ছাড়ার পর কিছু সময় পরে লঞ্চে এই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটে। এরপর ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীর দেউরী এলাকায় পৌছালে পুরো লঞ্চটিতে আগুন ধরে যায়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।