Home রাজনীতি রাষ্ট্র পার্বত্য চট্টগ্রামকে কারাগারে পরিণত করে রেখেছে: ঢাকায় গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা

রাষ্ট্র পার্বত্য চট্টগ্রামকে কারাগারে পরিণত করে রেখেছে: ঢাকায় গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা

12

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি: বাংলাদেশ রাষ্ট্র পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি কারাগারে পরিণত করে রেখেছে। এই বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিপুলদের হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে না। জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। আজ মঙ্গলবার (১৯ মার্চ ২০২৪) বিপুল চাকমাসহ ৪ নেতা হত্যাকাণ্ডের ১০০তম দিনে ঢাকায় গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। বক্তারা আরো বলেন, “জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ছাড়া পাহাড়ের সমস্যা সমাধান হবে না। পাহাড়িদের পূর্ণ-স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দিতে হবে”।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ক্যাফেটেরিয়ার শিক্ষক লাউঞ্জে সকাল ১১টায় অনুষ্ঠিত ‘জাতিসত্তার মুক্তি সংগ্রাম’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের সমন্বয়ক ও বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি অংকন চাকমা এবং প্রবন্ধ পাঠ করেন বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তাওফিকা প্রিয়া। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি রাগীব নাঈমের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনা করেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডাক্তার হারুন অর রশিদ, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কাফি রতন, বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য আব্দুস সাত্তার, নয়াগণতান্ত্রিক গণমোর্চার সভাপতি জাফর হোসেন, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর প্রতিনিধি থুইক্যচিং মারমা, বাসদ (মার্কসবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা প্রমুখ।

গোলটেবিল বৈঠকে থুইক্যচিং মারমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বেদখল, নারী নির্যাতন, শোষণ, নিপীড়ন চলছে। তারই বিরুদ্ধে ইউপিডিএফ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। গত বছর ১১ ডিসেম্বর বিপুল চাকমাদের চারজনসহ চলতি তিন মাসে ৯ জন ইউপিডিএফ সংগঠককে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে পাহাড়ের গণতান্ত্রিক পথ রুদ্ধ করতে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, বিপুলদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আদালতে মামলা করা হয়েছে। আদালত মামলার তদন্ত পিবিআইকে দিয়েছে। কিন্তু, মামলার পর আসামীদের গ্রেফতার না করে উল্টো মামলার বাদীকে পুলিশ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্রাঞ্চের লোকজন কর্তৃক নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। পাহাড়ের ন্যায়সঙ্গত রাজনৈতিক আন্দোলন দমনের লক্ষ্যে রাষ্ট্র হত্যাকাণ্ডের পথ বেছে নিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা না হলে, স্থায়ী শান্তি ফিরে আসবে না। তিনি আরো বলেন, পাহাড়ে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ নামে পাহাড়িদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। উন্নয়নের নামে রাবার বাগান, ঝিরি থেকে পাথর উত্তোলন করে পাহাড়ে পরিবেশের ক্ষতি করা হচ্ছে।

আব্দুস সাত্তার বলেন, আজকের গোলটেবিল বৈঠক অতি গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি কারাগারে পরিণত করে রেখেছে। বিপুল চাকমাসহ চারজনকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১০০তম দিনে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট যে দাবি তুলে ধরেছে তা মেনে নিতে হবে। হয়ত, এই সরকার তা মেনে নেবে না। তাই জনগণের রাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে বিপুল চাকমাদের হত্যার বিচার করতে হবে। তিনি আরো বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে পাহাড়িদের বলা হয়েছিল বাঙালি হয়ে যেতে! তিনি মন্তব্য করেন, পাহাড়ের ইস্যুটি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনের কথা বলা উচিত এবং বলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের সংগ্রামের সাথে একাত্ম হয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

বৈঠকে ফয়জুল হাকিম বলেন, পাহাড়ের ভাগ করে শাসন করার নীতি প্রয়োগ করে পাহাড়িদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতন চালানো হচ্ছে। এই সরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করেছে। পাহাড়ের লড়াইকে শাসকগোষ্ঠী ভয় পায়। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে ষড়যন্ত্র চলছে মন্তব্য করে এর থেকে সকলকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। তিনি আরো বলেন, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তা বেস্টনিতে ২০১৮ সালে খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর বাজারে ছয়জনকে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে অনিমেষ চাকমা, রূপক চাকমা, মিঠুন চাকমাকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিপুলদের মৃত্যু গৌরবের মৃত্যু। তাদেরকে লাল সালাম জানাই। সমগ্র মানুষের মুক্তির লড়াইয়ের অসীন হাওয়ায় বিপুলসহ চারজন হত্যার শিকার হয়েছে। বাংলাদেশকে ফ্যাসিস্ট সরকারের হাত থেকে মুক্ত করতে না পারলে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে না মন্তব্য করে তিনি নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তরুণ সমাজকে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

কাফি রতন বলেন, এই বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিপুলদের হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে না। জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এর বিচার করতে হবে। জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ছাড়া পাহাড়ের সমস্যা সমাধান হবে না। পাহাড়িদের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দিতে হবে। তিনি বলেন, পাহাড়িদের ক্ষুদ্র জাতি ও নৃ-গোষ্ঠী বলা হচ্ছে তা আমি তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করছি। জাতিসত্তার স্বীকৃতির জন্য লড়াই করতে হবে। তিনি আরো বলেন, পাহাড়ের নিপীড়নের কারণ হলো পাহাড়িদের মধ্যকার বিভক্তি। এই কারণে সরকার সেনাবাহিনী শোষণ নিপীড়ন করার সুযোগ পাচ্ছে। পাহাড়ের সরকার সেনাবাহিনীর দালালদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। আশির দশকে একজন মেজর খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি বাঙালিদের গর্ত খুড়ে রাখার ঘটনা আমরা শুনেছি। বর্তমানে তিনি এমপি, এরাই রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। পাহাড় সমতলের জাতিসত্তার ওপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

সাইফুল হক বলেন, বিপুলসহ চারজনকে গভীর সম্মান ও স্মরণ করছি। গুম হাওয়া মাইকেল চাকমাকেও সম্মান জানাই। বাংলাদেশের জাতিসত্তার অধিকারের বিষয়ে কোন তৎপরতা নেই। শেখ মুজিব পাহাড়িদের বাঙালি হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। তার ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত রাখা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়নের মাধ্যমে একটি কারাগারের পর্যবসিত করা হয়েছে। ফলে পাহাড়িদের জানমাল নিরাপত্তার হুমকিতে রয়েছে। তিনি আরো বলেন, ১৯৯৭ সালে পাহাড়ে একটি চুক্তি হয়েছিল। চুক্তির পরবর্তী দুই যুগ অতিক্রান্ত হলেও পাহাড়ের শান্তি ফিরে আসেনি,পাহাড়িদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি। পাহাড়ের উল্লেখযোগ্য কোন পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়নি। সরকার জাতিসত্তাগুলোকে ধ্বংস করতে কয়েক দশক ধরে পরিকল্পিতভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের উপর দমন দমন পীড়ন জারি রেখেছে। পাহাড়ের পরিকল্পিতভাবে উদীয়মান রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা করা হচ্ছে। বিপুলদের হত্যাকাণ্ড কোন বিচ্ছিন্ন নয়, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। পাহাড়ের পরিস্থিতি বিষয়ে দেশের রাজনৈতিক দলের উদ্যোগে জাতীয় কনভেনশন করা যায় কিনা তা সকলে ভেবে দেখা উচিত বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, পাহাড়ের ডেমোগ্রাফি পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে পাহাড়ি-বাঙালি অর্ধেকে অর্ধেক। সরকার পরিকল্পিতভাবে তা করেছে। পাহাড়ের পরিস্থিতিকে আলাদাভাবে দেখলে স্থায়ীভাবে সমাধান সম্ভব নয়। পাহাড়ের পরিস্থিতি বাংলাদেশের পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য রয়েছে। এর বিরুদ্ধে সকলকে যৌথভাবে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

বৈঠকে জাফর হোসেন বলেন, বাংলাদেশের ৫২ বছর পরও পাহাড়ের জাতিসত্তার উপর নিপীড়ন চলছে। পাহাড়ের রাজনৈতিক দলসমূহের বিভেদ নিরসন হাওয়া জরুরি এবং সংঘাত বন্ধ করে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তিনি আরো বলেন, পাহাড় হওয়া উচিত পাহাড়িদের। কিন্তু সেখানে বাঙালি সেটলারদের পুনর্বাসন করা হয়েছে। যার ফলে আমরা দেখেছি সেখানে পাহাড়ি-বাঙালি সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটছে।

জোনায়েদ সাকি বলেন, বিপুল চাকমাসহ চার নেতা হত্যার নিন্দা ও বিচারের দাবি জানাই। পাহাড়ের লড়াইকে স্তব্ধ করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে টার্গেট করে হত্যাকাণ্ড চালানো হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, এ রাষ্ট্র কখনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রথম থেকেই সাম্য মর্যাদা গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করার যে লড়াই সেটি জাতিসত্তার লড়াইয়ের সাথে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। পার্বত্য চুক্তিতে ভূমি অধিকারের বিষয় নিয়ে আলোচনা তেমনি গুরুত্ব পায়নি বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি ঐক্যবদ্ধ লড়াই ছাড়া মুক্তি আসবে না এবং ফ্যাসিস্ট সরকারকে বদলানো যাবে না বলেও মন্তব্য করেন।

হারুন অর রশিদ বলেন, পাহাড়ের বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে আমরা আন্দোলন সংগঠিত করতে পারিনি। মুসলিম ধর্মাবলম্বী হওয়াতে ফিলিস্তিনি জনগণের উপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে আমরা এদেশে কথা বলতে দেখেছি। কিন্তু বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ওপর নিপীড়ন নির্যাতনের কথা আমরা সেভাবে তুলে ধরতে পারিনি। তিনি পাহাড় সমতলে ঐক্যবদ্ধভাবে গণতান্ত্রিক লড়াই গড়ে তুলতে হবে বলে মত প্রকাশ করেন।

মাসুদ রানা বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে পাহাড়িরা লড়াই করেছিল। কিন্তু, স্বাধীন দেশের সংবিধানে জাতিসত্তার স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। পঞ্চদশ সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, কোনো জরুরি অবস্থা ঘোষণা ছাড়াই পার্বত্য চট্টগ্রামে অঘোষিত সেনা শাসন চলছে। এই সেনা শাসনের ফলে পাহাড়িদের উপর নিপীড়ন চালানো হচ্ছে। পাহাড়ের নারী নেত্রী কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচার হয়নি, অপহরণকারী সেনা কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।

গোলটেবিলে আরো উপস্থিত ছিলেন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি সালমান সিদ্দিকী, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি সাদেকুল ইসলাম সোহেল, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সহ-সভাপতি দীপা মল্লিক, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফাহিম আহমদ চৌধুরী, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সভাপতি জিকো ত্রিপুরা, বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি সীমা দত্ত, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সাবেক সভাপতি ইকবাল কবির, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাবেক সভাপতি সুনয়ন চাকমা, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি নজির আমিন চৌধুরী জয় প্রমুখ।