Home বাণিজ্য ও অর্থনীতি মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধির আশঙ্কা

মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধির আশঙ্কা

41

ডেস্ক রিপোর্ট: করোনার বিরূপ প্রভাব শেষ না হতেই বিশ্ব দেখল ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম। খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে শিল্পের কাঁচামাল তথা সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। কোনো কোনো পণ্যের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ।

এদিকে, করোনা শেষ হয়েও হলো না শেষ। নতুন ভ্যারিয়েন্ট কোনো কোনো দেশে হানা দিয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আসছে এপ্রিলের শেষ কিংবা মে মাসে করোনার নতুন ধরন ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই যদি সত্যি হয়, তবে জনজীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দেবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কেননা, চলমান যুদ্ধ আর করোনার কারণে এরই মধ্যে কর্মচাঞ্চল্যে ফিরে যাওয়া দেশগুলোর গতি শ্লথ হয়ে পড়বে। তাতে বেশি সংকটে পড়বে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলো। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা—আংকটাড এরই মধ্যে হুঁশিয়ার করে বলেছে, যে হারে পণ্য মূল্য বাড়ছে তাতে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে।

বিশ্বায়নের এ যুগে বাংলাদেশও আর বিচ্ছিন্ন নয়। সংগত কারণেই বাংলাদেশেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। করোনার অভিঘাতে গত দুই বছর কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষ এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। লকডাউনে বন্ধ থাকা কলকারখানাগুলো এখনো পুরোদমে চালু করা যায়নি। কাঁচামালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে শিল্পমালিকরা ধরাশায়ী হচ্ছেন। অনেকেই ব্যাংক ঋণের কিস্তি শোধ করতে পারছেন না। আবার সরবরাহ ব্যবস্থায় সংকট তো রয়েছেই। বিদেশি জাহাজগুলো বাংলাদেশে আসতে অনাগ্রহী। জাহাজ ভাড়া তো বেড়েছেই। বাড়তি ভাড়া দিলেও বাংলাদেশি পণ্য বিদেশি বন্দরে ফেলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

ফলে, ধরাশায়ী উদ্যোক্তারা। এরই মধ্যে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টের খবরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যদি নতুন ভ্যারিয়েন্ট সত্যিই ছড়িয়ে পড়ে তাহলে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলোর অর্থনৈতিক কাঠামো ঠিক রাখা সম্ভব হবে না। উপরন্তু চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যার প্রভাবে এরই মধ্যে অস্থির তেলের বাজার। জ্বালানি সংকট হলে তো অর্থনীতির গতি থমকে যাবে—এটাই স্বাভাবিক।

অভ্যন্তরীণভাবে করোনার গত দুই বছর পর সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে কিছুটা গতি আসতে শুরু করে। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে কাঁচামালের দাম বেড়ে যায়। পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে সরবরাহ সংকটে পড়ে পণ্য মজুত পরিস্থিতিও স্বস্তিকর থাকবে না। খাদ্যপণ্যের মূল্য ইতিমধ্যে বেড়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে সামাজিক অস্থিরতার বিকল্প নেই।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব বেশি পড়বে গরিব দেশগুলোতে। সংস্থাটির এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করার পর থেকেই বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের জিনিসের দাম বাড়তে থাকে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। লাগামহীনভাবে বাড়ছে সব পণ্যের দাম। যুদ্ধের ডামাডোলে জ্বালানি তেলের দর বেড়েই চলেছে। তার প্রভাব পড়ছে পণ্যমূল্যে। ইউক্রেনে হামলার কারণে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুটি কৃষি উৎপাদনকারী দেশের কোনো পণ্য অন্য দেশে যাচ্ছে না। যুদ্ধের কারণে পণ্য উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। এখন দেশ দুটির সব বন্দর বন্ধ থাকায় সবকিছুই বন্ধ। সে কারণে গমের দাম সম্প্রতি রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। ইউক্রেনের খাদ্যশস্য রপ্তানির ৯০ শতাংশই যায় সমুদ্রপথে। ফলে সরবরাহব্যবস্থা এরই মধ্যে বিঘ্নিত হওয়ায় খাদ্যপণ্যের দাম আরো বাড়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে গম সরবরাহের ২৯ শতাংশ, ভুট্টার ১৯ শতাংশ এবং সূর্যমুখী তেলের ৮০ শতাংশ আসে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে। এরই মধ্যে ফেব্র‚য়ারি পর্যন্ত গমের দাম এক-পঞ্চমাংশ বেড়ে ১০ বছরে সর্বোচ্চ হয়েছে। ভুট্টার দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ। যুদ্ধ উত্তেজনায় বিশ্ববাজারে সোনা, রুপা, তামাসহ মূল্যবান সব ধাতুর দামই বাড়ছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি লোহা, নিকেল ও কপার উৎপাদিত হয় রাশিয়া ও ইউক্রেনে।

গরিব দেশগুলোর দরিদ্র পরিবারের ওপর পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কতোটা প্রভাব ফেলবে তার একটি তুলনামূলক চিত্র উপস্থাপন করে প্রতিবেদনে বলা হয়, উন্নত দেশগুলোতে ভোক্তা ব্যয়ের ১৭ শতাংশ ব্যয় হয় খাদ্য কিনতে। আর সাব-সাহারান আফ্রিকাসহ অন্য গরিব দেশগুলোতে ভোক্তাদের ব্যয়ের ৪০ শতাংশই খাদ্যের জন্য। পূর্ব ইউরোপ, ককেশাস এবং মধ্য এশিয়াসহ রাশিয়া এবং ইউক্রেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য সংযোগ রয়েছে এমন দেশগুলোর জন্য আঘাত আরো বেশি হতে পারে। উচ্চ গমের দাম মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার অর্থনীতির ওপর আরো বেশি প্রভাব ফেলবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সামনের দিনগুলোতে সার সরবরাহ হ্রাস এবং জ্বালানি তেলের উচ্চ মূল্য খাদ্য সংগ্রহ, পরিবহন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের খরচ অনেক বাড়িয়ে দেবে। তাই নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই দরিদ্রদের জন্য সামাজিক সহায়তা বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্হার তথ্যানুয়ায়ী, বিদায়ি ২০২১ সালে আগের বছরের তুলনায় খাদ্য পণ্যের দাম ২৩ দশমিক ১ শতাংশ বেশি ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে মাংস, দুগ্ধজাত পণ্য, সিরিয়াল, ভোজ্য তেল এবং চিনির দাম ১৯৬১ সালের পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে। বর্তমান এই পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ। বিশ্বের কৃষিপণ্য রপ্তানিকারক এই বৃহৎ দুটি দেশ বিশ্বের ৩০ শতাংশ গম এবং ১৮ শতাংশ ভুট্টার জোগান দেয়। এর এখন এই রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। বিশ্ববাজারে খাদ্যের দামের এই পরিস্হিতি দরিদ্র দেশগুলোকে বেশি ভোগাবে বলে আশঙ্কা করেছে আইএমএফ।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দ্রুতই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার আহ্বান জানিয় বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। স্কুলে ঝরে পড়ার হার বেড়েছে। অনেক পরিবার ঋণ করে দৈনন্দিন জীবন যাপন করছে বলে জরিপে উঠে এসেছে। এই শ্রেণির মানুষের জন্য বিশেষ কর্মসূচি নেওয়া আবশ্যক।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নগর এলাকায় সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী আরো বাড়াতে হবে। তথ্য উপাত্তের ঘাটতির কারণে সরকার সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে পৌঁছুতে পারছে না। তথ্য উপাত্ত সঠিক হলে যে কোনো কর্মসূচির লক্ষ্য বাস্তবায়ন সম্ভব হয়।-ইত্তেফাক