Home মতামত সভ্যতার দিকেই বদলায়, অসভ্যতার দিকে নিশ্চয়ই নয়!!!

সভ্যতার দিকেই বদলায়, অসভ্যতার দিকে নিশ্চয়ই নয়!!!

34

সরদার মোঃ শাহীন:

২০২২ সালে মিডিয়ায় সর্বোচ্চ আলোচিত চরিত্র পরীমনি। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া। এ বছর সোশ্যাল মিডিয়া ছিল পরীমনিময়। মেইনস্ট্রিম মিডিয়াও বা কম কিসে! তাকে পুলিশ ধরতে এসেছে। বাইরে লাইভে প্রচারের জন্যে ক্যামেরা আর সাংবাদিকের ধাক্কাধাক্কি। চ্যানেলে চ্যানেলে লাইভ শুরু হয়ে গেল। তিনি থানা থেকে হাজত খেটে বের হচ্ছেন। বের হবার পথ পাচ্ছেন না। মিডিয়ার কর্মীদের ভীড়ে জনারণ্য। হাজিরা দিতে কোর্টে যাচ্ছেন। শুরু হলো লাইভ।

বেশ কিছুদিন ধরে সংবাদের শিরোনাম হবার জন্যে জুতসই নাম একটা পরীমনি। প্রচন্ড রকমের হিট নাম। হিট নিউজ আইটেম। প্রিন্ট কিংবা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কোথায়ও এর ব্যতিক্রম নেই। তার প্রতিটি ফেসবুক পোস্ট সংবাদের শিরোনাম হয় বাঘা বাঘা সংবাদপত্রের প্রধান প্রধান পৃষ্ঠার প্রথম কলামে। আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে দিয়েছেন সেটাও শিরোনাম, আবার “উফ! অসম্ভব গরম পড়েছে” বলে এক লাইনের পোস্ট দিয়েছেন সেটাও।

আমাদের সময়ের রাজ্জাক-কবরী কিংবা আলমগীর-শাবানারা কখনো সংবাদের শিরোনাম হননি। একমাত্র মৃত্যু সংবাদ ব্যতিত তাদের আমলের কেউ কখনোই সংবাদের শিরোনাম হননি। তাদের নিয়ে যা কিছু সংবাদ হতো সব বিনোদন পাতায়। যত না ব্যক্তিগত সংবাদ তার চেয়ে অনেক বেশি হতো তাদের অভিনয় সংশ্লি−ষ্ট সংবাদ। বিনোদন জগতের মানুষ বলেই তাদের সংবাদ নিয়মিত ছাপা হতো বিনোদন পাতায়। যেমনি খেলার সংবাদ নিয়মিত ছাপা হয় খেলার পাতায়।

এখন দিন বদলেছে। বদলেছে সংবাদ প্রকাশের ধরণও। সময়ের আবর্তে বিবর্তনবাদের জন্যেই এটা হয়েছে। এটা হবেই। এইটুকু মেনেও নেয়া যায়। কিংবা নিতে আমরা বাধ্য। তাই বলে সময়ের বিবর্তনে সমাজ খারাপের দিকে যাবে, আর সংবাদ মাধ্যম সে সবকেই আলিঙ্গন করে সমাজ এগিয়ে নিয়ে যাবে, সেটাও মেনে নিতে হবে? মিডিয়ার কাজ তো এর ঠিক উল্টো হওয়া উচিত। অধপতিত সমাজকে টেনে তুলে আনা উচিত।

এই জায়গাটিতে মিডিয়া সঠিক ভূমিকা পালন করছে কি না, তা বোধ হয় ভেবে দেখার সময় হয়েছে। আমি সোশ্যাল মিডিয়ার কথা বলছি না। বলছি মেইনস্ট্রিম সংবাদপত্র কিংবা রেডিও টিভির কথা। সোশ্যাল মিডিয়ায় যার যা মন চায়, লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে যখন তখন তাই সে পোস্ট দিতে পারে। এবং অহরহ সেটা দিয়েও যাচ্ছে। কেউ অন্তত এইটুকু বিবেচনায় নিচ্ছে না যে এতে করে সমাজ কতটা নষ্ট হচ্ছে। কিংবা সমাজের নিরেট ভদ্রলোকেরা কতটা বিব্রত হচ্ছে।

এসব ভাবার সময় কোথায়! তাই ওসব না ভেবে বরং চলমান স্রোতধারায় গা ভাসিয়ে পরীমনি এবং রাজ মিলে যার যার পেইজ থেকে মনের মাধুরী মিশিয়ে পোস্ট দিয়ে যাচ্ছিলেন। সকালে পোস্ট, বিকেলে পোস্ট। পোস্টবিহীন কোন দিন ছিল না। প্রথম দিকে সে সব ছিল প্রেমের ফুলঝুড়িতে ভরা। আহ! কী মধুর সে প্রেম! যা কিছু শুনলে সমাজ বলবে শ্যাম, শ্যাম; ওসব না ভেবে তারা প্রকাশ করে গেছে তাদের দু’জনার পুলকিত প্রেম।

কিন্তু পুলকিত প্রেম বেশিদিন টেকেনি। ক’দিন না যেতেই শ্যাম মার্কা সেই প্রেমে ভাটির টান পড়লো। সম্পর্কের মাঝে পুট্টুস করে তৃতীয় ব্যক্তির উদয় হলো। ফলে যা হবার তাই হলো। ত্রিভুজ প্রেমের ঝলকানি দেখা দিল। এমন কিছু দেখা দিলে যা হয় সাধারণত, তাই হলো। প্রেমের ছন্দপতন শুরু হলো। শুরু হলো সুরের পরিবর্তন। গভীর প্রেম অগভীরের দিকে যেতে লাগলো। মিষ্টি কথাগুলো ঝাঁঝালো কথায় পরিবর্তিত হতে লাগলো।

ফলত যা হবার তাই হলো। কোনরূপ রাগঢাক না করেই দু’জন দু’জনার বিষেদাগার শুরু করে দিলেন। অন্দরে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে এসব হরহামেশা হয়। হতেই পারে। কিন্তু সেটা তো বেড রুমের কথা। গোপন ঘরের গোপন কথা। সে কথা দুনিয়ার মানুষ জানবে কেন? মজার বিষয় হলো তারা নিজেরাই এসব জানান দেন। ঘরের কথা পরকে জানানোর জন্যেই তারা এসব করছিলেন। ঝগড়া বাঁধতে তাদের সময় লাগে। কিন্তু মানুষকে জানাতে তাদের একটুও সময় লাগে না।

সময় না ক্ষেপন করার জন্যে তারা এসব ঝগড়া ইনবক্সে না করে ইচ্ছে করেই ওপেন পেইজে করছিলেন। ঝগড়া এবং তার প্রকাশ দুটোই করছিলেন বীরদর্পে। এখানেও সময়ের অপচয় করেননি। বেশি ক্লান্ত হলে মাঝে মাঝে কিছুটা দম নিয়েছেন মাত্র। বিষয়টা এমন; প্রথমে দু’জন ফাটিয়ে ঝগড়া করার পর কিংবা শরীর ফাটিয়ে রক্তারক্তি করার পর একটু দম নেন। সঙ্গত কারণেই নেন। ক্লান্ত হবার কারণে কিছুটা বিশ্রাম নিতেই হয়। হয়ত একই রুমে কাছাকাছি থেকেও নেন, নয়ত ভিন্ন রুমে যেয়ে নেন।

বিশ্রাম নেন অনলাইন ঠিকঠাক করে লাইভে আসার জন্যে। দুনিয়াশুদ্ধ মানুষকে জানানোর জন্যে লাইভও শুরু করেন। লাইভে জানাতে জানাতে সব জানিয়ে দেন। প্রথমে কথা বা টেক্সট দিয়ে জানান, তারপর ছবি দিয়ে। কার কতটা গাল ফেটেছে, কার কতটা মাল। কিছুই বাদ দেন না। এরপর শুরু করেন অতীত ঘাটাঘাটি। ঘাটতে ঘাটতে দু’জনার সব গোপন গল্পগুলো সামনে নিয়ে আসেন। কে কোথায় কার সাথে গোপনে সম্পর্ক করেছেন সব প্রকাশ করে দেন।

প্রকাশের ধরনে দু’জনই খুবই কৌশলী থাকেন। প্রথমে আঁতেল সেজে প্রকাশ করা শুরু করেন। আকারে ইঙ্গিতে প্রতিপক্ষকে ততটা আঘাত না করে শুরু করেন। বিশেষণও লাগান প্রচুর। “ডিভোর্স দিতে পারি, কিন্তু বন্ধুত্ব যাবে না কোনদিনও” জাতীয় কথায় ভূমিকা দেয়া শুরু করেন। প্রথমে একজন দেন। ফেসবুকে মনের ঝাল মাখিয়ে লেখেন। যাকে লেখেন সে পড়ার আগেই পুরো বিশ্ব পড়ে ফেলে তার লেখা। তারপর লিখতে আসেন দ্বিতীয় জনা। তিনিও কম যান না। ইচ্ছেমত লেখেন। ফেসবুকেই লেখেন।

আমার প্রশ্নটা ঠিক এখানেই। যা তারা ব্যক্তিগত ইনবক্সে জানাতে পারতেন, তা কেন পাবলিকলি জানাচ্ছেন? এটা কি ন্যায্যত আইনসঙ্গত হচ্ছে? আইন কি ভঙ্গ হচ্ছে না? অসামাজিক হচ্ছে না? সুস্থ্য সভ্য সমাজে কি এসব যায়? ঘরের নোংরামি সমাজকে জানান দেয়া কি সামাজিক রীতিনীতিতে বৈধ? সমাজ এখান থেকে কি শিখছে? নিজেদের কুকর্মের গল্প নিয়ে প্রকাশ্যে আসা আর প্রকাশ্যে কুকর্ম করার মাঝে আদৌ কি কোন পাথক্য আছে?

শুধু তারা দু’জন নন; প্রায় প্রতিদিন, প্রতিমাসেই কেউ না কেউ এসব করছেন। মোটামুটি এটা একটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। এবং কেউ না কেউ শেষমেষ টেনে আনছেন প্রধানমন্ত্রীকে। প্রকাশ্যে লাইভে এসে তাদের আকামকুকামের বিচার করার জন্যে প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা কামনা করেন। নিজেকে অসহায় দাবী করে অপরপক্ষের কঠিন শাস্তি আশা করেন। খুব সাহসের সাথেই করেন। তবে তাদের সাহস আর স্পর্ধার তারিফ করতে হয়।

প্রধানমন্ত্রীকে এতটা সস্তা মনে করা এদের পক্ষেই সম্ভব। শুধু প্রধানমন্ত্রী কেন? পুরো দেশ ও জাতিকেই তারা সস্তা মনে করেন। তাদের মত লজ্জাহীনদের দ্বারা অনেক কিছুই সম্ভব। কিন্তু মেইনস্ট্রিম মিডিয়া? সকল ধরণের প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া কি এসব নোংরামী ছাপাতে বা প্রচার করতে বাধ্য? বিনোদন জগতের কিছু কিছু অসভ্যতাকে নিত্যদিন লাইম লাইটে এনে মিডিয়া কি অনেকটাই অসভ্যতার দিকে পুরো জাতিকে ঠেলে দিচ্ছে না? মিডিয়ারও তো একটা রীতিনীতি আছে। মিডিয়া সমাজ বদলায়। সভ্যতার দিকেই বদলায়, অসভ্যতার দিকে নিশ্চয়ই নয়!!!

-লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা।