Home মতামত গতবর্ষের যন্ত্রণা; নববর্ষের মন্ত্রণা!!!

গতবর্ষের যন্ত্রণা; নববর্ষের মন্ত্রণা!!!

23

সরদার মোঃ শাহীন:

নববর্ষের ঢোল নয়, নিজের ঢোল নিজে পেটানো আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। একেবারে না ঠেকলে সাধারণত পেটাই না। তবে প্রাসঙ্গিক কারণে নিজের ঢোলের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি আজ। এবং ঢোলের লাঠিটা হাতে নিয়েই বলতে হচ্ছে, এই জীবনে নিজ দায়িত্বে বহু মানুষের অপারেশন করিয়েছি। প্রতিদিন না হলেও সপ্তাহে অন্তত একাধিক করানোর অভিজ্ঞতাও আমার আছে। এই সেদিনও করালাম। নিজে ওটিতে উপস্থিত থেকেই করালাম।
কিন্তু নিজ দায়িত্বে নিজের অপারেশন করানোর কোন সুযোগ কোন কালেই পাইনি। পাবো কিভাবে? খুঁজলে তো পাবো! নিজের ওটি নিজে কি কেউ খোঁজে? খোঁজেও না; খোঁজার কথাও না। কাটাকাটি আর রক্তারক্তি কর্ম কে খোঁজে? আর ওটি করা কি যেমন তেমন বিষয়? বড়োই জটিল বিষয়। জটিল কর্ম গায়ে পড়ে কেউ খোঁজে না। তবে, না খুঁজলেও এবার এই সুযোগও আমার হয়েছিল। জীবনের প্রথম অপারেশনের সুযোগ।
হাতে কেনোলা পড়িয়ে স্যালাইন লাগিয়ে আমাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে কেবিন বেড এ। সামান্য দূরে বসা আমার শোনিমের মা। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ভেতরকার অবস্থা বুঝতে পারছিলাম না। তবে কেবিনে সবার আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় এটা বোঝা যাচ্ছিল, ওটিতে ঢোকার সময় ঘনিয়েছে আমার। মেজর ওটি। ঘণ্টা তিনেক তো লাগবেই। বড় পেরেশানের কথা। তবে আমি কাউকে বুঝতে দিচ্ছি না। আমার পালপিটিশন বেড়ে গেলেও মুখের হাসি ধরে রেখেছি। একটুও কমাইনি।
সব সময় সব কিছু কমাতে নেই। আজ কমালে শোনিমের মাকে সামাল দেয়া কঠিন হবে। তাই অভিনয়টা বাড়িয়ে দিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। বেশি তাকাচ্ছি কেবিনের সিলিং এর দিকে। খোলা আকাশ দেখতে মন চাইছে খুব। তারাভরা রাতের আকাশ। মন চাইছে বাবামায়ের মুখটা দেখার। আর চাইছে আমার শোনিমের মুখ। ঘুরেফিরে ওর মুখটাই কেবল সামনে আসছে। পরীক্ষার জন্যে এই সময়ে ছেলেটা পাশে থাকতে পারেনি। কী নির্মম এই পৃথিবীর বাস্তবতা! জীবনের কঠিন এই সময়ে আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটি পড়ে আছে সবচেয়ে দূরে!
আমার কেবিন থেকে ওটি বেশি দূরে নয়। জাস্ট নীচের ফ্লোরে। ওখান থেকে ওটির পোশাক পড়া জনাকয়েক এবার হুড়মুড় করে কেবিনে আসলো। বুঝতে বাকী রইলো না, আমাকে সাজাতে এসেছে। অনেকটা বিয়ের সাজের মত। ঘর থেকে বরকে রেডী করে বের করে আনার কর্ম যাকে বলে। বিয়েতে বরকে পড়ায় সেরোয়ানি আর ওটিতে রোগীকে গাউন। প্যাশেন্ট গাউন। আমাকে গাউন পড়াচ্ছে। জামাইয়ের মত শুধু রুমাল দিচ্ছে না। রোগীর মুখে রুমাল থাকে না। থাকে প্রচন্ড ভয়ার্ত বেদনামাখা টেনশান এর ছাপ ।
টেনশান আমার এনেস্থেশিয়া দিয়ে বেহুশ করার দলকে নিয়েও। অত্যন্ত চমৎকার সুশিক্ষিত এবং প্রশিক্ষিত এই দলটি থাকার পরেও চিন্তা আমার মলম পার্টি নিয়ে। একবার গুলিস্থানে ওদের খপ্পড়ে পড়েছিলাম। ভীড়ের মধ্যে বলা নেই, কওয়া নেই; মুখে রুমাল লাগিয়ে দিল। কী ছিল রুমালে, কে জানে! আমার জ্ঞান আছে। আমি সব দেখছি, সব বুঝছি। কিন্তু মুখে কিচ্ছু বলতে পারছি না। কে জানে আজও এমন হবে কি না। এনেস্থেশিয়া দেবার পর আমি সব দেখবো, সব বুঝবো। শুধু মুখে শব্দ থাকবে না কোন।
অনেকটা বাঙালীর মত। বাঙালীও সব দেখে, সব বুঝে; কিন্তু মুখে শব্দ করে না। কিচ্ছু বলে না। বলতে পারে না। ভাবখানা এমন যে বাঙালীকেও এনেস্থেশিয়া দিয়ে রাখা হয়েছে। গেল মাসে বেইলী রোডে একটি রেস্তোরায় আগুন লাগার মর্মান্তিক ঘটনার পরপর সরকারি বিভিন্ন সংস্থার তথাকথিত অভিযানের নামে ক’টা দিন যা হলো! সারা ঢাকা শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। আতঙ্ক যেমনি শহরের সব ভবন মালিকদের, তেমনি সকল ব্যবসায়ীদের। এসব দেখেও কোন মানুষ কি কিছু বলতে পেরেছে? একটা টুশব্দ হয়েছে?
হয়নি। এসব এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। হবে না কেন? এবারই তো প্রথম নয়। যেই না কোথায়ও একটা কিছু অঘটন ঘটে, অমনি লাফিয়ে পড়ে বিভিন্ন সংস্থার লোকজন। বিশেষ করে ভবনের আগুন আর হাসপাতালে রোগীর মৃত্যু। অথচ সারা বছর চুপচাপ। জেনেও না জানার ভান করে ওত পেতে অপেক্ষায় থাকে অঘটন ঘটার। যখনই ঘটে, অমনি লাফিয়ে পড়ে। আইনের শাসনের নামে আইনের শোষণে নামে। দেখানো হয় তাদের তড়িৎকর্মা কাজকামের বহর। কেবল দেখানো হয় না পর্দার আড়ালের গোপন ইনকামের খবর।
মূলত এসব ইনকামধারীরা ইচ্ছে করেই আইনকে জটিল করে। জনগণকে বাধ্য করে আইনের ব্যত্যয় ঘটাতে। ব্যত্যয়ে তারা সহযোগীর ভূমিকাই পালন করে। অনুমোদন বা লাইসেন্স করতে হলে এমন কিছু ডকুমেন্ট চাওয়া হয় যা বাস্তবসম্মত নয় বা প্রদান করাও সম্ভব নয়। অথচ ইচ্ছে করেই সে সব চাওয়া হয়। বলা যায়, সিস্টেমটাই সাজানো হয়েছে জটিলভাবে। অনুমোদন বা লাইসেন্স গ্রহণের প্রক্রিয়া জটিল করাই হয়েছে যেন অসাধুতার আশ্রয় নিয়ে জনগণ সবকিছু গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
বাধ্য হয়েই জনগণ গ্রহণও করে। এবং শুরু করে ব্যবসা। এদেশে ব্যবসা তো নয়, যেন যুদ্ধ। করোনা যুদ্ধের চেয়েও জটিল, ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ কঠিন এ যুদ্ধ। যেভাবে পদে পদে সরকারি-বেসরকারি চাঁদাবাজী, ঘুষ আর দালালদের দৌরাত্মে আস্টেপিস্টে আছে দেশের ব্যবসা, সে দেশে ব্যবসায়ীরা চুরি আর মজুতদারী ছাড়া লাভের মুখ দেখতে পারে না। ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয় অপরাধ করতে, অসাধু হতে। অসাধু হয় ভ্রান্ত নীতি আর দুর্নীতিগ্রস্ত সিস্টেমের কারণে।
অথচ দেশের সবচেয়ে বেশি এবং বড় করদাতা এই ব্যবসায়ী সমাজই। দেশকে নিত্য নতুন কর্মসংস্থান দিয়ে, ডালা ভরা কর দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে এই ব্যবসায়ী মহল। দুঃখজনক হলো, এদেরকে বাঁচাবার কেউ নেই এদেশে। সরকারি সিলগালা নাটকের মঞ্চায়নে এরা মৃতপ্রায়। এটা নিঃসন্দেহে নৈরাজ্য। এসব নৈরাজ্য কোনোভাবেই কাম্য নয়। অথচ চলছে। দিনের পর দিন চলছে। এসব দেখারও কেউ নেই। বলারও কেউ নেই। অগত্যা দেশের ইতিহাসে এই নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে প্রথমবারের মত এগিয়ে আসে হাইকোর্ট। মহামান্য কোর্ট রুল জারি করে অভিযানের উপর। আপাত স্থগিত হয় অভিযান। আপাত হাঁফ ছেড়ে বাঁচে ব্যবসায়ী মহল।
আগেকার দিনে এই ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে গ্রামবাংলায় বাংলা নববর্ষ আসতো মেলার হাট নিয়ে। ঢোল, বাদ্য আর বাজনায় উচ্ছ্বসিত হতো গ্রাম। গ্রামে গ্রামে বসতো মেলা। পটকা, বেলুন আর বাঁশির প্যাঁ পোঁ শব্দে মুখরিত হতো মেলার আঙিনা। ফসলের মাঠ ভরে যেত সোনালী ধানের শীষে। কিষাণ কিষাণীর মনে লাগতো নতুন ফসলের দোলা। নবান্নের উৎসব হতো ঘরে ঘরে। পিঠা-পুলী, আর চিড়া-মুড়িতে ভরে উঠতো গৃহস্তের উঠোন।
ব্যবসায়ীদের জন্যে নববর্ষ আসতো হালখাতা নিয়ে। হিসেবের নতুন খাতা খুলতো ব্যবসায়ীগণ। পুরোনো বছরের পাওনা আদায়ে মাসটির ঐতিহ্য ছিল উল্লেখ করার মত। অথচ এবারের নববর্ষ এসেছে ব্যবসায়ীদের জন্যে আতঙ্ক নিয়ে। আতঙ্ক প্রতিষ্ঠান বন্ধের নোটিশে, আতঙ্ক সিলগালা নাটকের দৌরাত্মে আর কর্মকর্তা কর্মচারীদের গ্রেফতারে। বাংলাদেশের মত দেশে যে সব প্রতিষ্ঠান সরকারি কোষাগারে নিয়মিত ট্যাক্স দেয়, সে সব প্রতিষ্ঠানে কোন না কোন ছুতানাতায় হয়রানী করা আর তৎক্ষনাৎ শাস্তি দেয়া জুলুম এবং অবিচার ছাড়া আর কিছু নয়।
দুঃখজনক হলো, জুলুম আর অবিচারে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে দেশের ট্যাক্স দাতারা। এ থেকে মুক্তির বিকল্প নেই। তাই নববর্ষে তাদের মুক্তির পথ কামনা করছি। বাংলা নববর্ষে ঢালাও জুলুম থেকে দেশের ব্যবসায়ী মহল স্বস্থির মুক্তি পাক। জনগণ পাক কাঙ্খিত ন্যায্যমূল্যে ভেজালমুক্ত পণ্য। ব্যবসাবান্ধব সুস্থ্য সুন্দর পরিবেশ গড়ে উঠুক এদেশে। ব্যবসায়ীরা লসের নয়, লাভের দেখা পাক। আর আমজনতা পাক ক্রয়সীমার মধ্যে তার পণ্য। দেশে ফিরে আসুক শান্তি! নববর্ষের বাংলা হোক শান্তির সোনার বাংলা!! শুভ নববর্ষ!!!

-লেখক: সম্পাদক, সিমেকনিউজ ডটকম।