Home জাতীয় সপরিবারে পলাতক থাকা সেই বিতর্কিত ও দণ্ডিত কর্নেল (অব.) শহীদ উদ্দিন খানের...

সপরিবারে পলাতক থাকা সেই বিতর্কিত ও দণ্ডিত কর্নেল (অব.) শহীদ উদ্দিন খানের বাড়ি নলছিটিতে

71

আহমেদ জালাল : জাল টাকা রাখার দায়ে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল শহীদ উদ্দিন খান এবং তাঁর স্ত্রী ফারজানা আনজুমকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। ঢাকার অষ্টম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ সৈয়দা হাফসা ঝুমা বুধবার (১ সেপ্টেম্বর) এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ের সময় আসামিদের দুজনই ছিলেন পলাতক।
১০ বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও ৬ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে রায়ে। এ মামলার পাঁচ আসামির মধ্যে সৈয়দ আজিজুল আলী ও খোরশেদ আলম পাটোয়ারিকে খালাস দিয়েছেন বিচারক। অপর আসামি জহুরুল হক খন্দকার মামলার বিচার চলাকালেই মারা যান।
কে এই সেনাবাহিনীর বরখাস্ত কর্নেল শহীদ উদ্দিন খান?
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বরখাস্ত কর্নেল শহীদ উদ্দিন খানের গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার সুবিদপুর ইউনিয়নে। তবে তাঁর পরিবারের লোকজন নলছিটি পৌরসভার সামনে সুজন ভিলায় দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছেন। এরা হলেন মুক্তা খান ও রতন খান। এদের মধ্যে মুক্তা খান বেকার ও রতন খান বরিশালের রূপাতলী জাগুয়া কলেজের শিক্ষক।
বরখাস্ত কর্নেল শহীদ উদ্দিন খানের বিরুদ্ধে জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগ : বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বরখাস্ত কর্নেল শহীদ উদ্দিন খানের বিরুদ্ধে জঙ্গি অর্থায়নসহ বেশকিছু অভিযোগ আনা হয়েছে। তাঁর বিরেুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র কেনাবেচা, প্রতারণা ও অর্থ পাচারের একাধিক মামলা রয়েছে। বর্তমানে লন্ডনে অবস্থানরত শহীদ উদ্দিন খান বৃটেনে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির একজন দাতাও।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত কর্নেল শহীদ উদ্দিন খান সম্পর্কে বেশকিছু তথ্য প্রকাশ করেছে ইংল্যান্ডের জাতীয় দৈনিক দ্য সানডে টাইমস। ২০১৯ সালের ২৬ মে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অস্ত্র ব্যবসা ও জঙ্গিবাদ সংক্রান্ত মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি শহীদ উদ্দিন বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ইংল্যান্ডের টোরি পার্টির ফান্ডে ২০ হাজার পাউন্ড অনুদান দিয়েছেন। এতে আর বলা হয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে বরখাস্ত এ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদে মদদ দেয়া, অস্ত্র ব্যবসা, প্রতারণা ও অর্থ পাচারের একাধিক মামলা রয়েছে। তাঁর ঢাকার বাসায় অভিযান চালিয়ে জিহাদি বই, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করে বাংলাদেশের কাউন্টার টেরোরিজম পুলিশ।
এদিকে, মামলার বিবরণে বলা হয়, ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি বারিধারার একটি ছয় তলা ভবনের তৃতীয় তলায় শহীদ উদ্দিন খানের ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে দুটি পিস্তল, ছয়টি গুলি ও দুটি শটগান এবং শোবার ঘরে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে এক হাজার টাকার জাল নোটের তিনটি বান্ডেল উদ্ধার করে পুলিশ। ওই ঘটনায় অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল শহীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র, সন্ত্রাস দমন আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়। এর মধ্যে জাল টাকা উদ্ধারের ঘটনায় ক্যান্টনমেন্ট থানায় শহীদ ও তার স্ত্রীসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে এই মামলা করেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক বিপ্লব কুমার শীল। মামলার এজাহারে বলা হয়, “আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে সরকার ও রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি ও জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডের ষড়যন্ত্র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।” তদন্ত শেষে পুলিশ কর্মকর্তা নৃপেন্দ্র কুমার ভৌমিক অভিযোগপত্র দেন। মামলার বিচারকালে রাষ্ট্রপক্ষে ২১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১০ জনের জবানবন্দি নেওয়া হয়। এ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী কবির আহাম্মদ রুমী জানান, আসামিদের মধ্যে সৈয়দ আজিজুল আলী ও খোরশেদ আলম পাটোয়ারি কারাগারে ছিলেন। রায়ের সময় তাদের এজলাসে হাজির করা হয়।
অস্ত্র মামলায় অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল শহীদসহ ৪ জনের যাবজ্জীবন : গত বছরের ১০ নভেম্বর অস্ত্র আইনের মামলায় অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল শহীদ উদ্দিন খানসহ চারজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ঢাকার আরেকটি আদালত। আর ২০ ডিসেম্বর আয়কর ফাঁকির অভিযোগে এনবিআরের দায়ের করা মামলায় ঢাকার ১০ নম্বর বিশেষ জজ আদালত শহীদ উদ্দিন খানকে নয় বছরের কারাদণ্ড দেয়।
অস্ত্র মামলায় দণ্ডিত ব্যক্তিরা হলেন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল শহীদ উদ্দিন খান, তাঁর স্ত্রী ফারজানা আঞ্জুম খান এবং খোরশেদ আলম পাটোয়ারী ও সৈয়দ আকিদুল আলী। তাঁদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এবং তাঁর স্ত্রী পলাতক।
মামলার কাগজপত্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি বসরপ্রাপ্ত কর্নেল শহীদ উদ্দিন খানের ক্যান্টনমেন্টের ডিওএইচএসের বাসা থেকে অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় ক্যান্টনমেন্ট থানার মামলা দায়ের করা হয়। অবসরপ্রাপ্ত কর্নেলের বাসায় অভিযান চালিয়ে দুটি পিস্তল, ছয়টি গুলি ও দুটি শটগান উদ্ধার করা হয়। মামলায় বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে সরকার ও রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি ও জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডের ষড়যন্ত্র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মামলাটি তদন্ত করে একই বছরের ৪ এপ্রিল আদালতে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল শহীদ উদ্দিন খানসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। বিচার চলাকালে আসামি জহুরুল হক মারা যান। এই মামলায় ওই বছরের ১৩ আগস্ট অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল শহীদ উদ্দিন খানসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ২১ জন সাক্ষীর মধ্যে নয়জনকে আদালতে হাজির করা হয়।
প্রসঙ্গত, এরআগে লন্ডনে সপরিবারে পলাতক থাকা আয়কর ফাঁকির মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত বিতর্কিত সাবেক সেনা কর্মকর্তা কর্নেল (অব.) শহীদ উদ্দিন খানের কর্নেল পদবি বাতিল করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাঁকে বরখাস্তের পরিবর্তে স্বাভাবিক অবসর গ্রহণের যে আদেশ ২০০৯ সালে দেওয়া হয়েছিল, তা-ও বাতিল করা হয়েছে। গত ৩ মে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ওয়াহিদা সুলতানা স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই বাতিলাদেশ দেওয়া হয়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ইতিপূর্বে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ১৪ ডিসেম্বর ২০০৯ তারিখে জারীকৃত প্রজ্ঞাপনের ছকের ৩৫ নম্বর ক্রমিকের বিএ-২৪২৮ কর্নেল মো. শহীদ উদ্দিন খাঁন, পিএসসি (অব.)-এর বরখাস্তের পরিবর্তে স্বাভাবিক অবসর সংক্রান্ত আদেশ এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ২৩ মার্চ ২০১০ তারিখে জারীকৃত প্রজ্ঞাপনের ছকের ঘ-এর ৩৫ নম্বর ক্রমিকে বর্ণিত কর্মকর্তার কর্নেল পদে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতিসহ অকালীন অবসর সংক্রান্ত আদেশ বাতিল করা হলো।’
শহীদ উদ্দিন খানের বিরুদ্ধে প্রবাসে পলাতক থাকা অবস্থায় রাষ্ট্রবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
গত বছরের ২০ ডিসেম্বর আয়কর ফাঁকির মামলায় শহীদ উদ্দিন খাঁনকে ৯ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১০-এর বিচারক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম এ রায় দেন। তিন অর্থবছরে ১৭ কোটি ছয় লাখ ৪০ হাজার ১০৭ টাকা আয়কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে শহীদ উদ্দিন খানের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার আদালতে মামলা করেন সহকারী কর কমিশনার শেখ আলী হাসান। এই মামলায় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ২০১০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর শহীদ উদ্দিন খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।
এতে বলা হয়, অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল শহীদ উদ্দিন খাঁন ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৭৪ লাখ ১৩ হাজার ৯৮৬ টাকার আয়ের তথ্য গোপন করে আয়কর ফাঁকির অপরাধ করেছেন। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে শহীদ উদ্দিন খানের বিরুদ্ধে ৯ কোটি ২৫ লাখ ১২ হাজার ৬০০ টাকা আয়ের তথ্য গোপন করে আয়কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে শহীদ উদ্দিন খানের বিরুদ্ধে সাত কোটি সাত লাখ ১৪ হাজার ২২১ টাকা আয়ের তথ্য গোপন করার অভিযোগ আনা হয়। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এই মামলায় ১১ জন সাক্ষীকে আদালতে হাজির করা হয়।
মামলার বাদী সহকারী কর কমিশনার শেখ আলী হাসান বলেন, আসামি শহীদ উদ্দিন খাঁন একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তার প্রকৃত আয়-ব্যয় এবং সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। তিনি আয়কর রিটার্ন দাখিলে মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রকৃত আয় ও সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তিনি আয়কর রিটার্ন দাখিল করেননি।