Home স্বাস্থ্য মাইগ্রেনে ভুগছেন মেডিকেল পড়ুয়া ২৭ শতাংশ ছাত্রী

মাইগ্রেনে ভুগছেন মেডিকেল পড়ুয়া ২৭ শতাংশ ছাত্রী

60

ডেস্ক রিপোর্ট: মানসিক চাপ ও ঘুমস্বল্পতাসহ নানা কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাইগ্রেনের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। বিশেষ করে মেডিকেল কলেজের নারী শিক্ষার্থীদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে বেশি। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশে মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত ২৭ শতাংশ ছাত্রী মাইগ্রেনের সমস্যায় ভুগছেন, ছাত্রদের তুলনায় যা তিন গুণেরও বেশি।

মাইগ্রেনের সমস্যার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাঝারি থেকে গুরুতর শারীরিক অক্ষমতা দেখা যায়। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যগত নানা ধরনের ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এসব শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন। সম্প্রতি দেশের ছয়টি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর পরিচালিত ‘প্রিভ্যালেন্স অব মাইগ্রেন অ্যান্ড ইটস অ্যাসোসিয়েটেড ফ্যাক্টরস অ্যামং মেডিকেল স্টুডেন্টস অব বাংলাদেশ: আ ক্রস সেকশনাল স্টাডি’ শীর্ষক গবেষণায় বিষয়টি উঠে এসেছে। গবেষণাটি একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশের জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে। দেশের কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও চিকিৎসকদের সংগঠন প্লাটফর্ম রিসার্চ উইংয়ের নয় গবেষক এতে কাজ করেছেন।

গবেষণায় উঠে আসে, দেশের মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাথাব্যথার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ১৯ শতাংশের মধ্যে মাইগ্রেন বা মাথাব্যথার প্রবণতা দেখা গেছে। যার মধ্যে ২৭ শতাংশ নারী ও ৮ শতাংশ পুরুষ শিক্ষার্থী। নারীদের মাইগ্রেন বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে গবেষকরা বলছেন, হরমোন ও ঘুমস্বল্পতা এক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। রোগটিতে আক্রান্তদের ৯০ শতাংশ মাঝারি থেকে গুরুতর সমস্যায় ভুগছেন বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।

চলতি বছরের মার্চে খুলনা মেডিকেল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল, মুগদা মেডিকেল, জেড এইচ সিকদার, সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল ও এনাম মেডিকেল কলেজের ১ হাজার ৩০০ শিক্ষার্থীর তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ১৭ থেকে ২৫ বছর বয়সী নারী ও পুরুষ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অনলাইনের মাধ্যমে গুণ ও পরিমাণগত গবেষণা পদ্ধতির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

গবেষণায় অংশ নেয়া ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাথাব্যথার প্রবণতা দেখা গেছে। যাদের মধ্যে ২৪ শতাংশের বয়স ১৭ থেকে ১৯ বছর। নিয়মিত ব্যায়ামের অভাব, ধূমপান, অ্যালকোহল গ্রহণ ও খারাপ ঘুমের গুণমান মাথাব্যথার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ভুক্তভোগীদের ৪২ শতাংশ মাঝারি এবং ৪৮ শতাংশ গুরুতর মাথাব্যথায় ভুগছেন। তাদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ এক মাসের মধ্যে ১০ বারেরও বেশি আক্রমণের শিকার হয়েছেন। একইভাবে আক্রান্তদের মধ্যে ৮৪ শতাংশের বমিভাব হয়েছে, ফটোফোবিয়ায় ভুগেছেন ৭২ শতাংশ এবং ৫৩ শতাংশ ভুক্তভোগী বমিও করেছেন। তিন-চতুর্থাংশ সমস্যাগ্রস্তরা একতরফা মাথাব্যথার শিকার হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৮৩ শতাংশের মাথার শিরায় ব্যথা অনুভব হয়।

মানসিক চাপের ফলে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী মাথাব্যথার সমস্যায় পড়েছেন। এতে ৫৫ শতাংশ ভুক্তভোগী পাওয়া গেছে। অনিয়মিত ঘুম ৪৬ শতাংশ, অতিরিক্ত অধ্যয়নের ফলে ২৭ শতাংশ, শব্দের কারণে ৩৩ শতাংশ, ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহারের কারণে ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থী মাথাব্যথার মতো স্বাস্থ্যগত সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। মাইগ্রেন সম্পর্কিত অক্ষমতার মধ্যে শারীরিক ক্রিয়াকলাপের সমস্যায় পড়েছেন ২৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। এছাড়াও রোদের আলোয় অস্বস্তি, ছাত্রীদের মাসিকের সমস্যা, ধূমপান, মদ্যপানসহ আরো বেশকিছু কারণ মাইগ্রেনের সমস্যা বাড়িয়ে তোলে।

গবেষকরা বলছেন, এ ধরনে রোগতাত্ত্বিক গবেষণা কোনো রোগ এবং তার প্রাদুর্ভাব খুঁজে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের মেডিকেল শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাইগ্রেনের মতো অতি সাধারণ কিন্তু ভয়াবহ স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ও বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে এসব সমস্যা দেখা গেছে। তবে নির্দিষ্ট গবেষণার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্টরা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছেন। স্বাস্থ্যশিক্ষা নিতে এসে শিক্ষার্থীরা মাথাব্যথার শিকার হয়েছেন। এ স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুক্তভোগীরা ধারাবাহিকভাবে অস্বস্তির মধ্যে দিন পার করেন। ছাত্রীদের মধ্যে মাইগ্রেনের সমস্যা বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট গবেষকরা বলছেন, মেয়েদের হরমোনের প্রভাবে তাদের মধ্যে পুরুষের চেয়ে মাথাব্যথার সমস্যা বেশি থাকে।

গবেষণায় কাজ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. গোলাম হোসেন। তিনি বলেন, আমাদের গবেষণায় মানসিক চাপের ফলে মাইগ্রেনের আক্রমণের তথ্য বেশি পাওয়া গেছে। মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা, উচ্চস্তরের কর্মক্ষমতা, শিক্ষার দীর্ঘ সময়কাল এবং কোর্সের প্রতি অবিচ্ছিন্ন দায়িত্বসংক্রান্ত চাপের সম্মুখীন হচ্ছেন। জীবনাচারের বিভিন্ন দিকও এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

বাংলাদেশের মেডিকেল শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাইগ্রেনের প্রকোপ বেশি। নারী ও বয়ঃকনিষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা প্রায়ই মাইগ্রেনে আক্রান্ত হন। এতে তাদের একাডেমিক কর্মক্ষমতা কমার শঙ্কা রয়েছে। একই সঙ্গে জীবনেও পড়তে পারে নেতিবাচক প্রভাব। অক্ষমতার এ মারাত্মক মাত্রা কমাতে এবং উদ্দীপকের নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন গবেষণাটির গবেষক ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ইন্টার্ন চিকিৎসক ডা. আব্দুর রাফি। মাইগ্রেনের ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে অক্ষমতা সৃষ্টি হয়, তাতে তাদের উৎপাদনশীলতা কমার শঙ্কা রয়েছে বলে মন্তব্য করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, মাইগ্রেন বা মাথাব্যথা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। এর সঙ্গে জীবনাচার থেকে শুরু করে পরিবার, লেখাপড়া ও সামাজিক বিষয়ও জড়িত। এগুলো মূলত মানসিক চাপের কারণে হয়। আনন্দময় পরিবেশ না থাকার কারণে এ স্বাস্থ্যগত সমস্যা সৃষ্টি হয়। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগী হতে হবে।

তার মতে, শিক্ষার্থীদের শিক্ষকদের সঙ্গে একটি হূদ্যতার সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। তাদের পরীক্ষাসংক্রান্ত চাপ থেকে বের করে আনতে উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে তাদের উদ্দীপ্ত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের বিনোদন ও সহশিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত করতে হবে। তবে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করে ব্যবস্থা নিলে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের এ গুরুতর সমস্যা থেকে বের করে আনা যাবে।

মাইগ্রেন বা মাথাব্যথার বিভিন্ন কারণ ও ধরন রয়েছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবু ইউসুফ ফকির বলেন, বহু ধরনের মাথাব্যথা রয়েছে। এর কারণও ভিন্ন। শুধু একটি মাত্র গবেষণার আলোকে মাইগ্রেনকে নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। কী কারণে এটি হচ্ছে এবং এর কোনো ইতিহাস রয়েছে কিনা তা আগে ভালো করে জানতে হবে। এরপর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। বিভিন্ন বয়সী ও পেশায় এমন স্বাস্থ্যগত সমস্যা রয়েছে। তবে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাইগ্রেনের সমস্যা নিয়ে নির্দিষ্ট ফলাফল পেলে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী তা সমাধানে পদক্ষেপ নেয়া যাবে। –আমাদের সময়.কম