Home বাণিজ্য ও অর্থনীতি বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা

বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা

35

ডেস্ক রিপোর্ট: দেশে উচ্চশিক্ষা অর্জনের হার যেমন বাড়ছে, তেমন উচ্চশিক্ষিতদের বেকারত্বের হার বৃদ্ধি যেন নৈমিত্তিক খবর হয়ে উঠছে। উচ্চশিক্ষা এখন আর কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। তরুণরা যত বেশি পড়ালেখা করছেন, তাদের তত বেশি বেকার থাকার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। করোনা মহামারিতে চলতি বছর বিশ্বে বেকার মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২০ কোটি ৭০ লাখ। এই সংখ্যা করোনা মহামারি শুরুর আগের বছর ২০১৯ সালের চেয়ে ২ কোটি ১০ লাখ বেশি। সম্প্রতি প্রকাশিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘ওয়ার্ল্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-ট্রেন্ডস ২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বিশ্বের বেকারত্ব ও কর্মসংস্থানের বর্তমান অবস্থা এবং পূর্বাভাস তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন ও ডেলটা ধরন বিশ্বের সব দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। এতে চলতি বছর বিশ্বে বেকার মানুষের সংখ্যা বেড়ে প্রায় ২০ কোটি ৭০ লাখ হতে পারে। করোনার প্রাদুর্ভাব এবং সময়কাল সম্পর্কে অনিশ্চয়তার কারণে বিশ্বে আগামী বছর পর্যন্ত বেকার মানুষের সংখ্যা ২০১৯ সালের চেয়ে বেশি থাকবে। আগামী দিনে চাকরি হারানো সব মানুষের চাকরি ফিরে পাওয়া ও মহামারির আগের কর্মক্ষমতায় ফিরে যাওয়া বেশির ভাগ দেশের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা অর্থাৎ স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শেষ করতেই একজন শিক্ষার্থীর জীবন থেকে ১৬ থেকে ১৮ বছর অতিবাহিত হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেশনজট মিলিয়ে আরো তিন-চার বছর বেশি লেগে যায়। এরপর পরিবারের হাল ধরতে খুঁজতে হয় চাকরি। সন্তোষজনক চাকরি পাওয়া নিয়ে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে হতাশা ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কত সে বিষয়ে হালনাগাদ কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে এর সংখ্যা যে একেবারে কম নয়, সেটি দেখা যায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জনবল নিয়োগের সময়। হোক তা সরকারি কিংবা বেসরকারি।

বাংলাদেশের শ্রমশক্তি-সম্পর্কিত জরিপে বেকারত্বের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে—১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের এমন ব্যক্তিকে বেকার বিবেচনা করা হয়েছে, যে সক্রিয়ভাবে কাজের সন্ধান করা বা কাজের জন্য প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও কোনো কাজ করে না বা পায়নি।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা যায়, স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ, অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই বেকার। ঐ প্রতিষ্ঠানের মাত্র ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পান এবং মাত্র ৩ শতাংশ স্ব-উদ্যোগে কিছু করছেন। দুই বছর আগেও বিশ্বব্যাংক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর জরিপ করেছিল। তাতেও দেখা গেছে, স্নাতক পাশ করা শিক্ষার্থীদের ৪৬ শতাংশ বেকার, যারা তিন বছর ধরে চাকরি খুঁজছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি অনুযায়ী, দেশে শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই বেকারের হার বেশি, যেখানে ৪৭ শতাংশ শিক্ষিতই বেকার। অন্যদিকে দেশে প্রতি বছর শ্রমশক্তিতে যোগ হচ্ছেন ২০ লাখ মানুষ। কিন্তু সেই অনুপাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। ফলে বড় একটি অংশ বেকার থেকে যাচ্ছেন।

করোনার কারণে বহু প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করেছে, অর্থাৎ অনেক মানুষ চাকরি হারিয়েছে। এতে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে। আবার চাকরি থাকলেও অনেকের বেতন কমেছে। দুটো মিলিয়ে দেশের বিপুল মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। কিন্তু সেই সংখ্যার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান আছে কি না, সেটিই এখন প্রশ্ন।

বেসরকারি একাধিক গবেষণা সংস্থার জরিপ-গবেষণার সুবাদে এ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা মিললেও সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো তথ্য জানা যায়নি। কবে নাগাদ সরকারিভাবে বেকারত্ব ও কর্মসংস্থানের তথ্য মিলবে, তা-ও অজানা। সাধারণত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপের মাধ্যমে বেকারের সংখ্যা উঠে আসে। কিন্তু পাঁচ বছর ধরে দেশে এই জরিপ হয়নি। সর্বশেষ ২০১৬ সালে শ্রমশক্তি জরিপ হয়েছিল। সেটির ফল প্রকাশ করা হয় এক বছর পর, ২০১৭ সালে। অথচ মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশে প্রতি দুই বছর পরপর বিবিএসের এই জরিপ করার কথা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের অনেক দেশই প্রতি মাসে বা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে বেকারত্ব ও কর্মসংস্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত জনগোষ্ঠীর পরিসংখ্যান প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে এই তথ্য জানা যাচ্ছে না।

সর্বশেষ ২০১৬ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ছিল ৬ কোটি ৩৫ লাখ। তাদের মধ্যে কাজ করেন ৬ কোটি ৮ লাখ নারী-পুরুষ। বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। কিন্তু করোনার কারণে দেশে যে বেকারের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই সংখ্যা কত, এমন হিসাব নেই। পাঁচ বছর আগের শ্রমশক্তি জরিপে দেখা গেছে, দেশে স্নাতক পাশ বেকারের হার ৩৯ শতাংশ।

লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) তথ্যমতে, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। অর্থাৎ প্রতি দুই জনে একজনের নাম বেকারের খাতায় অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীভুক্ত প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) এক সমীক্ষায় এসেছে, কোভিড-১৯ এর কারণে দেশের অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত ৩৭ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছেন। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২০ শতাংশ আসে এই অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান থেকে। আইএলও বলছে, করোনা মহামারির কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে তরুণ প্রজন্ম। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সিদের মধ্যে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশই বেকার হয়েছেন। করোনার কারণে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিগুণ হয়েছে। আইএলওর হিসাবে, বাংলাদেশে করোনায় ১৬ লাখ ৭৫ হাজার তরুণ-তরুণী কাজ হারিয়েছে।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই তরুণ। এ দেশের কর্মসংস্থানেও তারুণ্যের ভূমিকা রয়েছে অসামান্য। আজকের তরুণরাই আগামী দিনে দেশ পরিচালনা এবং বড় বড় কাজের নেতৃত্ব দেবে। এখন থেকে যদি তরুণদের দক্ষ করে গড়ে তোলা যায়, তবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ আরো সুন্দর হবে। তাই দেশ গঠনে তরুণদের চাওয়াকে যেমন গুরুত্ব দিতে হবে, ঠিক তেমনি তাদের পর্যাপ্ত সুযোগও দিতে হবে।-ইত্তেফাক