Home মতামত বাঁকা চোখে আঁকা ছবি (পর্ব-৩)!!!

বাঁকা চোখে আঁকা ছবি (পর্ব-৩)!!!

31

সরদার মোঃ শাহীন:

ফ্লাইটে ওঠার সময় ভালোই লাগছিল। এবারের ফ্লাইট যে একেবারেই রাইট টাইমে ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলবে সেটা আগেভাগে জানতাম না। আগেভাগে জানতাম, মাঝেমধ্যেই এই ফ্লাইট ডিলে করে। সময় মত আসে কদাচিৎ। অবশ্য এটা শোনা কথা। নিজের অভিজ্ঞতা ছিল না বিধায় নিশ্চিত ছিলাম না। বোর্ডিং নিতে এসে দেখলাম পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। মিনিট গুণে গুণে সময় মত যাত্রী উঠাচ্ছে ফ্লাইটে।
এক সময় খুব বদনাম ছিল দেশের ট্রেন নিয়ে। “নয়টার ট্রেন কয়টায় আসবে?” কথাটি হরহামেশা সবাই বলতাম ব্যঙ্গ করে। তবে ট্রেন নিয়ে এমন ভাবে ব্যঙ্গ করার দিন অনেকটাই শেষ হয়েছে। বিমানের অবস্থাও হয়ত অনেকটা এমনই। তাই আজকে সময় মত ফ্লাইট ছাড়তে দেখে কিছুটা অবাক হলেও খুব ভাল লাগছিল এই ভেবে যে নিজের দেশের ফ্লাইট যথা সময়ে এসে যথা সময়ে ছাড়তে যাচ্ছে। এর চেয়ে শান্তি আর গর্বের কী হয়! এ যে আমার দেশের পতাকাবাহী উড়োজাহাজ! দেশমাতৃকার ভাল কিছু দেখলেই ভাল লাগে।
ধরা যাক গাজীপুরের নির্বাচন। বেশ চমৎকার একটা নির্বাচন হয়ে গেল গাজীপুরে। খুবই চমৎকার। ভোটার উপস্থিতির হারও ছিল বেজায় ভাল। তাই মনটা ভরে গেছে। মনটা ভরেছে কারো পরাজয়ে কিংবা জয়ে নয়। ভরেছে সুস্থ পরিবেশে, সুষ্ঠু এবং স্বতঃস্ফূর্ত একটি নির্বাচন দেখে। যদিও এটা পারস্পরিক দুই শক্তিশালী রাজনৈতিক পক্ষের নির্বাচন ছিল না। তবুও এখানে কঠিন রাজনীতি ছিল। তাই জয়পরাজয়ের দিকে চোখ ছিল পুরো দেশবাসীর।
ফলাফলে যারা জিতেছে, তারা মহা আনন্দে আছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। আর যারা হেরেছে, তারা ঘরের কোণে লুকিয়েছে। লুকানোটাও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আতেল শ্রেণী যারা নৌকার পরাজয়ে প্রচন্ড আত্মতৃপ্তি পাচ্ছে, তাদের কিন্তু এতটা আত্মতৃপ্ত হওয়া উচিত নয়। আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগে এই নৌকার একই মাঝিই এখানে হেরেছিলেন এক লাখেরও অধিক ভোটে। এবার তিনি হেরেছেন মাত্র ১৬ হাজার ভোটে।
ফলাফল বলে, গেল দশ বছরে নৌকা এখানে এগিয়েছে যথেষ্ঠ মাত্রায়। আর পরিসংখ্যান বলে এন্টি নৌকার সব ভোট এবারের বিজয়ী প্রার্থী পেয়েছেন। কেবল এন্টি নৌকা নয়, প্রকৃত নৌকার প্রচুর ভোটও তিনি পেয়েছেন দলীয় বিভেদের কারণে। তারপরও সব মিলিয়ে ৪৩% ভোট পেয়ে তিনি বিজয়ী হয়েছেন। আর অন্যদিকে নৌকা একাই কিন্তু ৪০ পার্সেন্টেরও বেশি ভোট পেয়েছে। একটি সুষ্ঠ নির্বাচনে ভোট কাস্টিং হয়েছে ৪৯%। ভোটারের এই উপস্থিতিকে যথেষ্ঠ পরিমাণ হিসেবেই ধরা হয় সারা বিশ্বে। আর সেখানে নৌকা পেয়েছে মোট প্রদত্ত ভোটের ৪০%।
এই নির্বাচনে যদি বিএনপি থাকতো আর আওয়ামী বিদ্রোহী হিসেবে জাহাঙ্গীরও থাকতো, তাহলে হিসেবটা কী দাঁড়াতো? নৌকার ভোট তো ঠিক ৪০%ই থাকতো। বিএনপি কিংবা জাহাঙ্গীরের সমর্থক গুষ্ঠির একটি ভোটও নৌকায় পড়তো না। উল্টো তাদের ভোট ভাগাভাগি হয়ে যার যার মার্কায় পড়তো। তাহলে তাদের কেউ কি পাশ করতো? বিষয়টাকে কি ঠিক এভাবে দেখা দরকার নয়? এভাবে না দেখে যারা দিনের পর দিন মিডিয়া ফাটিয়ে ফেলছেন এই বলে যে, সরকারের জনপ্রিয়তা তলানীতে নামতে নামতে এখন আর নামার জায়গা নেই, তারা ঠিক বলছেন তো? না কি তাদের বক্তব্য ভুল প্রমাণ হয়েছে গাজীপুরের নির্বাচনে?
অবশ্য এভাবে ভাবার ক্ষমতাও সরকার বিরোধী আতেলদের তো ভাল, সরকারী দলের অন্তত মাঝারো মানের পন্ডিত মার্কা নেতাকর্মীদেরও নেই আজকাল। কেন্দ্রীয় নেতাদের আছে কি না জানি না। তারা তো ধরাছোঁয়ার বাইরে। সাধারণের উর্ধ্বে উঠে গেছেন। আমাদের দেখার সুযোগ হয় পাতি নেতাদের। এলাকার এখানে সেখানে, রাস্তাঘাটে। রাস্তাঘাটের পোস্টারে যাদের ছবিটবি দেখি, তা দেখে মোটেও মনে হয় না, গাজীপুর নির্বাচন বিশে−ষণ করার ক্ষমতা তাদের আদৌ আছে কি না।
রাখার সময়ই বা তাদের কোথায়! তাদের সময় তো যায় বড় বড় নেতাদের তোষামোদ করতে করতেই। আসছে ঈদকে সামনে রেখে জনগণকে ঈদ শুভেচ্ছা জানাবার যত পোস্টার তারা ছাপিয়েছে, দেখুন না একটু ভাল করে সে সব পোস্টার। সবার উপরে প্রধান জাতীয় নেতা ও নেত্রীর ছবি, তার নীচে মধ্যবর্তী নেতার ছবি। সবার নীচে শুভেচ্ছা জানানো নেতার ছবি। মনে হচ্ছে এ সকল রাজনৈতিক নেতা- কর্মীদের স্বাধীনতা নেই স্বতন্ত্রভাবে ঈদের শুভেচ্ছা জানানোরও। ঈদের শুভেচ্ছাতেও তোষামোদের মাতামাতি আছে।
অথচ আগেকার দিনে ঈদে আনন্দের মাতামাতি থাকতো। থাকতো ধনী গরীব, উপর নীচু ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে সামিল হওয়ার চেষ্টা। ঈদ মানে পরস্পরের সাথে আলিঙ্গন করা, কোলাকুলি করা। আর এখন ঈদ মানে উপরের জনাকে উপরে রেখে তলে বসে তোষামোদ করা। তোষামদের সংস্কৃতি চালু হওয়ায় কোলাকুলির সংস্কৃতিও হারিয়ে গেছে। এবারের ঈদুল ফিতরের নামাজ শেষে আমার শোনিমের সাথে কোলাকুলি করে তাকিয়ে দেখি আশেপাশের সবাই যেন আমাদের দেখছে না। ভূত দেখছে। যেন এমন ভৌতিক কর্মকান্ড এর আগে জীবনেও দেখেনি কোনদিন।
ফ্লাইটের ভেতরে যথাস্থানে লাগেজ রেখে নিজের সিটে বসেছি। বেশি সময় নেয়নি একটুও। ঠিক যথাসময়েই আস্তে আস্তে প্লেনটি ট্যাক্সিওয়েতে যাওয়া শুরু করলো। এত সুন্দর যাত্রায় খুবই ভালো লাগছিল। মনে মনে ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম ফ্লাইট ক্যাপ্টেনকে। সময় মত প্লেনটিকে আকাশে উড়িয়ে নেয়ায় তিনি ধন্যবাদ পেতেই পারেন।
কিন্তু প্লেনখানি যতই ঢাকার দিকে আগাচ্ছিল ফ্লাইটের ভিতরের ম্যানেজমেন্ট ততই এলোমেলো মনে হচ্ছিল। সময় মত বিমানটি ছাড়তে পারলেও সময় মত খাওয়া দিতে পারছিল না। ক্ষুধার্ত পেটে বসেছিলাম কিছু একটু খাবো এই আশায়। যাত্রা শুরুতে কেউ একজন এসে ছোট একখানি পানির বোতল হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। ক্ষুধার্ত পেটে এই পানিটুকুই একমাত্র ভরসা। ২ ঘণ্টা ১০ মিনিটের ফ্লাইট। যাত্রা প্রায় শেষের দিকে। ল্যান্ড করতে মোটে ৩০ মিনিট বাকী আছে। দেখলাম সবে খাবার বিলি শুরু করেছে ফ্লাইট এটেন্ডেন্টগণ।
সাধারণত যাত্রার শেষ ৩০ মিনিট সবাই ল্যান্ডিং এর প্রস্তুতি নেয়। সব কিছু গোছগাছ করে। এমনকি পারতপক্ষে যাত্রীদেরকে টয়লেটে যেতেও বারণ করে। এখানে দেখছি ঠিক উল্টো। খাবারের ট্রলি নিয়ে দু’দিক থেকে দু’জন বেরিয়েছেন। মাঝপথে চীফ পার্সারকে পেয়ে সহযাত্রী ডঃ সঞ্জীব খুবই বিনয়ের সাথে জানতে চাইলো, আপনারা খাবার দেয়ার কাজটি কি ল্যান্ডিয়ের ৩০ মিনিট আগে শুরু করেন? শুনে ভদ্রমহিলা তো রেগেমেগে আগুন। আগুন চোখে কটমট করে বললেন, আমাকে কাজ শেখাতে চান আপনি? ত্রিশ বছর ফ্লাইটে কাজ করি। আর আপনি কাজ শেখাবেন আমায়!
কথাটি পাশ থেকে শুনে আমি খাবার কথা ভুলে তার বয়স অনুমান করা শুরু করলাম। গুণে গুণে মিলাচ্ছি, বিমানের ফ্লাইটে ত্রিশ বছর কাজ করা মানুষটির বয়স কত হতে পারে? নিশ্চিত মাঝ বয়সী হবেন তিনি। এমন বয়সের কারো কি ফ্লাইট এটেন্ডেন্ট হবার ফিটনেস থাকে? না কি থাকলেও রাখা উচিত? আন্তর্জাতিক যাত্রীগণ কি এই বয়সী একজনকে ফ্লাইট এটেন্ডেন্ট হিসেবে একসেপ্ট করবে? নাকি কোন এয়ারলাইন্স এমনটা করে?
প্রায় চলে এসেছি দেশে। ঢাকার আকাশে প্লেন ঘুরছে। খুবই শর্টলি ল্যান্ডিং করার ঘোষণা দিচ্ছেন ক্যাপ্টেন বার বার। বড়জোর আর দশ মিনিট। আমার খাবার নিয়ে আসলেন একজন। খাবার ঠিকভাবে আমার ট্রেতে রাখবেন কি! রীতিমত তার হাত কাঁপছে। ধাপে ধাপে প্লেনটির নীচে নামার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ছেলেটি ঠিক মত দাঁড়াতেই পারছে না। তার হাত থেকে কোনমতে আমার প্যাকেটটি নিতে নিতে শুধু জানতে চাইলাম, আজকে সমস্যাটি কি ছিল ভাইয়া, তোমাদের?
উড়োজাহাজটির একদম পেছনে থাকা ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সেই কটমটা মহিলার দিকে ভীতু ভীতু চোখে তাকিয়ে ছেলেটি শুধু বললো, স্যার কী আর বলবো! পেটের দায়ে চাকুরি করি। সব কথা তো বলতে পারি না। নিজ থেকে বুঝে নিয়েন, স্যার!
বড় করুণ চোখে চাওয়া ভারী করুণ ছেলেটির খেদোক্তি। একেবারে মনের গহীন থেকে বের হয়ে আসে খেদোক্তি। আসলেই তো ছেলেটি সত্যি কথা বলেছে। সব কিছু নিজে থেকে বুঝে নিতে বলেছে। এদেশে কোন কিছু কেউই বুঝিয়ে বলতে পারে না। বুঝিয়ে দিতেও পারে না। সবাই বলে, নিজ থেকে বুঝে নিতে। এদেশের কোন কিছু বোঝার এটাই যেন পথ। পথ হারিয়ে পথচলা পথিকের চলার একমাত্র পথ!!!

-লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা ডট কম।