এম এইচ নাহিদ।। উত্তরের মফিজ আর মফিজ নেই। দারিদ্রতা আছে, তবে মঙ্গার দুঃখ ঘুচে গেছে আরো বহু আগেই। তাদের জীবন পাল্টে দিয়েছে বঙ্গবন্ধু সেতু। উত্তরের মতো এবার দক্ষিণ বাংলার মানুষে জীবন বদলে দিবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এ সেতুর কারণে এই জনপদের মানুষের জীবন যেমন পাল্টে যাবে, তেমনি ভাটি অঞ্চল খ্যাত দক্ষিণের মানুষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অবস্থারও আমূল পরিবর্তন হবে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য সহ সামগ্রীক জীবনব্যবস্থায় এক অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটবে। পদ্মা সেতুর কারণে কেবল দক্ষিণ বাংলার ২১ জেলা’ই নয়, পাল্টে যাবে সমগ্র বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চিত্র। অপেক্ষা কেবল ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণের। ২৫ জুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পরেই খুলে যাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সম্ভাবনার দ্বার। এ সেতু কেবল বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে যোগাযোগ, বাণিজ্য বৃদ্ধিসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বাঙালি বীরের জাতি। শত বাধায়  এ জাতি ‘মাথা নোয়াবার নয়’। বিশ্ব দরবারে এ সত্য আবারো প্রমাণ করলো। বিশ্ব ব্যাংক সহ দেশি-বিদেশি সকল অপশক্তির গভীর ষড়যন্ত্র ও ভয়ঙ্কর বাধাকে উপেক্ষা করে বাঙালি  নিজস্ব আয়ে পদ্মা সেতু করেই দেখালেন। আর বাঙালির এই দুঃসাহসকে বাস্তবে পরিণত করেছেন, টানা তিনবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলা ছাড়াও পুরো দেশের অর্থনীতি গতিশীল হবে। এস সেতু’র কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে যাবে। আর বছরে দারিদ্র্য নিরসন হবে শূন্য দশমিক ৮৪ ভাগ। প্রায় ৬ কোটি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের সাথে সাথে গোটা বাংলাদেশের ভাগ্য পাল্টে দিবে পদ্মাসেতু।

ইতোমধ্যেই উদ্যোক্তারা দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিনিয়োগের ডালা খুলে বসছেন। গ্রহণ করা হচ্ছে অসংখ্য মেগা প্রকল্প। আবাসন শিল্প, পর্যটন শিল্প, হাইটেক পার্ক, তাঁতপল্লীসহ অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে। মোংলা বন্দরেরও প্রসার ঘটছে। ইকোনমিক জোন হচ্ছে। সামনে আরো নদী-বন্দর, সমুদ্র বন্দর চালু হতে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ওই এলাকায় একটা অর্থনৈতিক অগ্রগতির বিস্তার ঘটবে। সেতু উদ্বোধনের আগেই এ অঞ্চলের কৃষিজমিগুলো মূল্যবান হয়ে উঠেছে। পিছিয়ে থাকা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া ২১টি জেলা- খুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা। বরিশাল বিভাগের বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি এবং ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী জেলার মানুষের জীবনে আমূল পরিবর্তন আনবে পদ্মা সেতু।

জানাগেছে ঢাকা-চট্টগ্রামের পর  যশোর হতে পারে দেশের তৃতীয় বৃহত্ততম বাণিজ্য নগরী। এর শহরতলীতে আরবপুর এলাকায় ৫শ একর জমির ওপর অটোমোবাইল শিল্পাঞ্চল ও যশোর-বেনাপোল সড়কে ঝিকরগাছা উপজেলায় ৬শ একর জমির ওপর ইলেকট্রনিকস, টেক্সটাইল, ওষুধ, তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান নিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হবে। এখানকার উৎপাদিত পণ্যের রফতানি বাড়বে। মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। বদলে যাবে জীবনযাত্রার মান।

এ সেতু শুধু শিল্প  কেবল খাতেই নয়, সুফল পাওয়া যাবে কৃষি ও পর্যটন খাতেও। দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পায়ন তথা জাতীয় অর্থনীতিতে নতুন দুয়ার খুলে যাবে।

পুরো দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু হবে একটি নতুন মাইলফলক। এ অঞ্চলের কৃষি, মৎস্য, পোলট্রি এবং ডেইরি খাতের উন্নয়নের ক্ষেত্রে নতুন এক সুযোগ সৃষ্টি হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, সেতুটি নির্মিত হলে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে টাকার অঙ্কে জিডিপি বাড়বে ৩৩ হাজার ৫৫৬ কোটি ৫৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

একটি গবেষণা মতে, সেতুকে কেন্দ্র করে দুই পাড়ে ২৯ শতাংশ নির্মাণ কাজ বাড়বে, কাজের প্রবৃদ্ধি বাড়বে ৯ শতাংশ। ৮ শতাংশ বাড়বে উৎপাদন ও পরিবহন খাতের কাজে। এই সেতুর প্রভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে ৫ কোটি লোকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। ফলে পদ্মা নদীর ওপারে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দারিদ্র্যের হার কমবে ১ শতাংশ। ওই অঞ্চলে দারিদ্র্য কমা সারাদেশে দারিদ্র্যের হার কমবে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ।

পদ্মা সেতু মোংলা ও পায়রা বন্দরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করবে। এ সেতুর মাধ্যমে বাংলাদেশ এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হবে। এই বৃহৎ অঞ্চলে গড়ে উঠবে শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ইপিজেড। পিছিয়ে পড়া এই অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার বাড়বে। সারাদেশের অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। পর্যটনের প্রসার বাড়ায় ‘সাগরকন্যা’ কুয়াকাটায় কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে।

ইতোমধ্যে, পর্যটনভিত্তিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি সমন্বিত মাস্টার প্ল্যান হাতে নিয়েছে সরকার। এই মাস্টার প্ল্যানে থাকছে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আধুনিক পর্যটনকেন্দ্র, শিল্পভিত্তিক বন্দরনগরী, পরিকল্পিত নগরায়ন, যোগাযোগ, অর্থনীতি ও কৃষি খাতের উন্নয়ন, পরিবেশ সুরক্ষা ও দুর্যোগ ঝুঁকিসহ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলাভিত্তিক কার্যক্রম। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে পদ্মাপারে হচ্ছে তাঁতপল্লী ও আইটি পার্কও। ইতোমধ্যে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় আইটি পার্ক গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের পাশে শিবচরের কুতুবপুরের কেশবপুরে ‘শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি এ্যান্ড হাইটেক পার্ক’ নির্মাণে ৭০ একর জায়গা নির্ধারণ করেছে আইসিটি মন্ত্রণালয়। প্রকল্প পাস হলেই ভূমি অধিগ্রহণ শুরু হবে।

এর বাইরে আরও অনেক ছোট-বড় প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শেখ হাসিনা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, শেখ রাসেল শিশু পার্ক, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব নার্সিং ইনস্টিটিউট এ্যান্ড কলেজ, আইএইচটি ভবন, ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, শিল্পকলা একাডেমি ভবন, মুক্তমঞ্চ ও অলিম্পিক ভিলেজ। সিঙ্গাপুরের আদলে গড়ে তোলা হবে বিসিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক ও আইকন টাওয়ার। ইলিয়াস আহম্মেদ চৌধুরীর (দাদা ভাই) নামে শিবচর উপজেলায় ‘দাদা ভাই উপশহর’ হাউজিং প্রকল্পের প্লট প্রস্তুতির কাজ ও বরাদ্দ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।

প্রচুর বিনিয়োগের যেমন সুযোগ বাড়বে, তেমনি কৃষিতেও আসবে নতুন বিপ্লব। সেতুর জন্য করা নদীশাসন কাজ এ অঞ্চলে পদ্মার ভাঙন প্রবণতা কমাতে ভূমিকা রাখবে। কর্মসংস্থান, দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং পিছিয়ে থাকা অঞ্চলগুলোর উন্নয়নের মধ্য দিয়ে গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দারিদ্র্য কমবে। শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন নয়, উৎপাদন, কর্মসংস্থান, আয় বৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচনের মধ্য দিয়ে জাতীয় ও আঞ্চলিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে পদ্মা সেতু।

এই তো কয়েক বছর আগেও উত্তরবঙ্গের মানুষ কোথাও যেত না। সেখানে মঙ্গা ছিল, অভাব ছিল। এখন রংপুরের মানুষ কাজের খোঁজে চট্টগ্রাম চলে যায়। তাদের বহির্মুখী যোগাযোগ বেড়েছে বঙ্গবন্ধু সেতুর কারণে। ‘পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক প্রভাব প্রাক্কলন’ শীর্ষক এক গবেষণায় গবেষক দেখিয়েছেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ হলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পণ্য ও সেবার চাহিদা বাড়বে। স্যোশাল এ্যাকাউন্টিং ম্যাট্টিক্স (এসএএম) ব্যবহার করে তাঁরা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, পদ্মা সেতু নির্মাণ হলে দক্ষিণাঞ্চলের শস্যের চাহিদা ২০ শতাংশ, মাছে ২০ শতাংশ, ইউটিলিটি সেবায় ১০ শতাংশ ও পরিবহন সেবায় ৫০ শতাংশ চাহিদা বাড়বে। এর ফলে দেশে চাহিদা ১০ শতাংশ শস্য, মাছে ১০ শতাংশ, ইউটিলিটি সেবা ৫ শতাংশ ও পরিবহন সেবায় ২০ শতাংশ  চাহিদা বাড়বে।

পদ্মা সেতু উত্তরের সঙ্গে দক্ষিণের মেলবন্ধন মেলবন্ধন আরো মজবুত করবে। অর্থনীতির চাকা ঘুরবে আরো তীব্র গতিতে। উত্তরের সুগন্ধি চাল, রংপুরের হাঁড়িভাঙা, রাজশাহীর ফজলি আম, দিনাজপুরের লিচুর নতুন বাজার হবে দক্ষিণের জেলাগুলো। এছাড়া পোলট্রি, গবাদি পশুরও বাজার পাবে উত্তরের মানুষ। অন্যদিকে দক্ষিণের ইলিশ, তরমুজ, নারিকেল ও পান-সুপারির বাজারের দুয়ার খুলবে উত্তরে। উৎপাদিত কৃষিপণ্যও খুব সহজে আনা-নেওয়া করতে পারবে এ দুই অঞ্চলের মানুষ।

উত্তরের আলুর চাহিদা সারা দেশেই। এবার উত্তরের আলু পাবে নতুন বাজার। পাশাপাশি দক্ষিণের আমড়া যাবে উত্তরের বাজারে। দিনাজপুরের মাল্টারও কদর বাড়বে। মোট কথা যমুনা ও পদ্মা এবার উত্তর দক্ষিণকে মিলেমিশে একাকার করে দিবে।

উত্তর দক্ষিণের সাথে সাথে বাংলাদেশের সবজি ও নানা কৃষিপণ্য যাবে ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে। এখনো যায়, তবে এ সেতু চালু হলে আরো বিপুল পরিমাণ পণ্য বিদেশে রপ্তানি করবে। ফলে পদ্মা সেতু যেমন দক্ষিণ বাংলার মানুষের জীবন বদলাবে, তেমনি পাল্টাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির চিত্র। অপেক্ষা কেবল উদ্বোধনের।