Home সাহিত্য ও বিনোদন অনুগল্প : নিশির ডাক

অনুগল্প : নিশির ডাক

62

পলাশ কলি হোসেন শোভা: চারিদিকে ঝিঁঝি পোকার ডাক আর দুএকটা জোনাকির মিটি মিটি আলো। আমবশ্যার অন্ধকার এক হাত সামনেও কিছু দেখা যাচ্ছে না কুয়াশার কারণে। শিকদার বাড়ির পূবের ঘরের দরজা টা খুলে গেলো। ঘর থেকে একজন বয়স্ক মানুষের ছায়ামূর্তি যেন বের হয়ে আসে। বাড়ির সবাই ঘুমে অচেতন। মধ্য রাতের এই সময়টাতে নাম না জানা পাখির ডাক শোনা যায়।
ধীরে ধীরে ছায়ামূর্তি টি ইটের সোলিং করা রাস্তায় নেমে আসে।

কি গো মিয়া এতক্ষণ করলা কেরে?
কাশেম তুমি এহানে কি করো?
তোমার লাইগা অপেক্ষা করতেছি সেই কখন থন, চলো সামনে হাটি।
দুজনে হাটতে থাকে রাস্তা ছেড়ে মেঠো পথ দিয়ে।
আইচ্ছা কাশেম তুমি এতদিন কই আছিলা?
দুরু কই থাকমু বাড়িত আছিলাম, তুমি তো আমার খোঁজ নেও না, তাই আমিই আইলাম।
ভালা করছো কতদিন একলগে গল্প করিনা। এভাবে কথা বলতে বলতে সামনের দিকে এগোতে থাকে। কোথাও কোন আলো নেই। ভৌতিক চারপাশটা এগিয়ে চলছে দুজন।

দুই বন্ধু কাশেম আর নুরুল ইসলাম। ছোট বেলা থেকেই একসাথে সব কাজ করে বেড়ায়। ডাব চুরি কাউকে ভয় দেখানো। এমনকি স্কুলে একই মেয়েকে দুজনের পছন্দ করে বসা। কাশেম পরি রে এতটাই পছন্দ করতো যা নুরু মেনে নিতে পারতো না ঝগড়াটা এমন পর্যায়ে যেতো যে বিএসসি সাদেক স্যারের কানে গিয়ে উঠলো। আর যায় কই। দুজনকে ধরে এত মেরেছিলো যে তিনটা বেত ভেঙে গিয়েছিলো। সে কথা মনে করে দুজনে খুব হাসলো।
কাশেম জানতে চায়,
নুরুরে পরি এখন কই?

পরি কই তুই জানোস না? শুনছি কুমিল্লা বিয়া হইছে। দ্যাশে তো আহে না। তয় এতদিনে দাদী নানী তো হইছেই।
হবে হয়তো। তুই ওরে পছন্দ না করলে তো আমিই…
বাদ দে এসব।
দুই বন্ধু হেটেই চলেছে।

মোবাইলে সময় দেখে রাজু রাত তিনটা পাঁচ মিনিট। বিছানা ছেড়ে খুব আস্তে আস্তে মাটির ঘরের দুয়ার খুলে বের হয়। গোপনে পারুর সাথে দেখা করতে যাবে। পারু তার বিয়ে করা বউ। দুই পরিবারের কেউ এই বিয়েতে রাজী নয়। তাই গত তিনমাস শেষ রাতে দুজন এক হয়। কথা কয়, পারু কাঁদে রাজুর বুকে। কবে এই কষ্টের জীবন শেষ হবে।
রাজু চলো আমরা এহানথন পালাই

আমরা তো ভীনদেশী আব্বা এখানের মিলে চাকরী করে। আমরা পালাইলে আব্বার চাকরি থাকবো না। তুমি তোমার বাবারে রাজী করাও। প্রতি রাতেই এই একই কথা নিয়ে দুজনের সময় কাটে কখন যে ভোর হতে শুরু করে। রাজু জলদি বাড়ির পথে হাটা দেয়।
আজ পারুর জন্য পায়ের নুপুর কিনেছে নিজ হাতে পরিয়ে দিবে।

গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে খেতের পথ দিয়ে হেটে যায় সামনের বিশাল বাঁশঝাড়। গা কেমন ছমছম করে এখানে আসলেই, এখন আর ভয় করেনা রাজুর। তার চিন্তা ধ্যান তখন পারু। এই গ্রামটা পার হলেই পারুদের গ্রাম। নওগাঁ থেকে এই গ্রামে সাত বছর আগে আসে রাজুদের পরিবার পেপার মিলে কাজ করে আব্বা আর ও এখনো কলেজে পড়ছে।

বড় ফসলি মাঠ পার হতেই কানে আসে মানুষের গুন গুন কথার শব্দ । ভয় পেয়ে যায় রাজু। মোবাইলে সময় দেখে তিনটা চল্লিশ। হঠাৎ পুবপাশে একটা পরিত্যক্ত পুকুরে চোখ যেতেই চমকে উঠে। কাঁদায় পরিপূর্ণ পুকুরের মাঝখানে মানুষের মত ওটা কে?
পা থেমে যায় রাজুর। শরীর ভার হয়ে আসে, কি দেখছে সে। জ্বীনভুত কিছু নাকি? কিন্তু বিড়বিড় করে কি বলছে? সব কিছু ভুলে যায় সে কিছুক্ষণের জন্য । একসময় বুঝতে পারে কোন মানুষ হবে হয়তো। সে মোবাইলের টর্চ দিয়ে দেখে কোমর পর্যন্ত ডেবে আছে মানুষ টা আর বলছে। আমরে তোলো। কেউ আমারে তোলো। রাজু সম্বিৎ ফিরে পায় এই শীতের রাতে বৃদ্ধ লোকটা কাঁপছে। রাজু পুকুরের কাঁদা থেকে অনেক কষ্টে উপরে তুলে আনে।
আপনে কেডা গো?
আমি শিকদার বাড়ির….

আর বলতে পারে না। রাজু নিজের চাদরটা দিয়ে জড়িয়ে দেয়
কাকা আপনে বাড়ি চিনবেন?
হ, চিনমু। মসজিদের ধারো নিলেই চিনমু।
আলেয়া বেগম তাহাজ্জুদ পড়ার জন্য চারটার সময় উঠে।
ওজু করার জন্য বিছানা ছাড়তেই দেখে স্বামী বিছানায় নেই।

এঘর ওঘর খুঁজতে গিয়ে চোখে পড়ে পুবের দরজটা খোলা। এক চিৎকার দিয়ে বড় ছেলে কে ডাকে। কোথায় গেলো এত রাতে। নিশির ডাক শুনে বের হয় নাই তো? কান্নার রোল পড়ে যায় বাড়িতে পাশের শরীক ঘর থেকে লোকজন চলে আসে। এমন সময় সবাই দেখতে পায় দুজন লোক হেটে আসছে। ছেলেরা সব দৌড়ে যায়।
বাড়ির উঠানে টুলে বসতে দেয়ে সজল।
আব্বা আপনি কই গেছিলেন? সারা শরীরে কাঁদা কেন?

আমি তো নামাজ পড়ার জন্য ওজু করতে বাইর হইছে, মিয়া বাড়ির কাশেম আমার লগে কথা কইতে কইতে কই যে নিলো। কইতে পারিনা। ওজু করতে নাইমা দেখি পানি নাই কেদার মধ্যে ডাইবা গেছি।
সলিম বলে উঠলো,
আফনে কাশেমরে কই পাইছেন? হে তো তিন বছর আগেই মইরা গেছে।
আরে না আমার লগে কত কথা…..

সবাই বলাবলি শুরু করলো ওনারে নিশি ডাইকা নিসে কাশেম সাইজা আইছে।
নিশি মানুষের আওয়াজ পাইলে মারতে পারেনা। রাজু সময় মত ওইহানে থাকোনে বাইচা গেছে। লও ওনারে গোসল দাও। দাও এর আগায় লবন নিয়া খাওয়াও। এরপর গরম দুধ দাও।
আলেয়া বেগম নাকি সুরে কাঁদছে আর স্বামীর যত্ন করছে। গ্রামের লোকজন বলাবলি করতে করতে বাড়ি যাচ্ছে,
সামনের শুক্রবার গ্রামে দোয়া খায়ের করা লাগবো আল্লাহ্ বড় বিপদ থন বাঁচায়ছে।

-লেখক : সাবেক অধ্যাপক, মিরপুর গার্লস আইডিয়াল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ঢাকা।