Home রাজনীতি নেপথ্যে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক হিসাব নিকাশ

নেপথ্যে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক হিসাব নিকাশ

46

ডেস্ক রিপোর্ট: রাজধানীর মতিঝিলের আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে ফিল্মি স্টাইলে গুলি করে হত্যার তদন্তে সাফল্যের খুব কাছাকাছি রয়েছেন গোয়েন্দারা। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে কারা লাভবান এবং কারা ক্ষতির সম্মুখীন হলো-তা নিয়েও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
এ ব্যাপারে ইতোমধ্যেই ঘটনাসংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজনকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। পাওয়া গেছে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত। পাশাপাশি টিপুকে ফোনে হত্যার হুমকি বা সতর্ককারীর সূত্র ধরে এগিয়ে চলছে তদন্ত। এ হত্যার আগে টিপুকে ফোন করে ‘চাচা’ বলে সম্বোধন করা হয়েছিল। ফলে টিপুকে কারা ‘চাচা’ ডাকেন তা নিয়েও চলছে অনুসন্ধান।

এছাড়া ঘটনাস্থল ও আশপাশের অন্তত সাতটি সিটিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মিলেছে কিলারদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের নম্বর। গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছেন ‘কিলিং মিশন’-এ অংশ নেওয়া এক যুবক। খুব শিগগিরই চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের জট খুলবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে আশার কথা শুনিয়েছেন। শনিবার রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের এক অনুষ্ঠান শেষে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। মন্ত্রী বলেন, ‘এটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড কিনা, সে বিষয়ে এখনই মন্তব্য করতে চাই না। আশা করি, খুব শিগগিরই এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করতে পারব।’ তিনি বলেন, ‘অবশ্যই এর পেছনে কারা, নাটের গুরু কারা, কারা ঘটনা ঘটিয়েছে, সবকিছুই খোলাসা করে আপনাদের জানিয়ে দেব। হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তদন্ত চলছে। যারাই এ ঘটনায় জড়িত থাকুক, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে পুলিশ, র‌্যাব ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রগুলো বলছে, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত অন্তত সাতজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তারা। শনিবার রাত পৌনে ১টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাদের মধ্যে পাঁচজনকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের আগে-পরের ভূমিকা জানতে কয়েকজনের মুঠোফোন জব্দ করেছেন গোয়েন্দারা। তাদের মধ্যে টিপুর খুব ঘনিষ্ঠ একজনও রয়েছেন। অর্থাৎ এই হত্যাকাণ্ডে টিপুর ঘনিষ্ঠ ও রাজনৈতিক দূরত্ব রয়েছে এমন কাউকেই সন্দেহের বাইরে রাখা হচ্ছে না। বিশেষ করে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও তার সামনের ফুটপাতের নিয়ন্ত্রণ এবং এজিবি কলোনি ও পাশের বাজার নিয়ন্ত্রণের রাজনীতিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন গোয়েন্দারা। এই নিয়ন্ত্রণে অর্থনৈতিকভাবে কারা কীভাবে লাভবান-তাও জানার চেষ্টা চলছে। হত্যাকাণ্ডের আগে-পরের বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়েও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। সূত্রগুলো বলছে, সিসিটিভির ফুটেজের পাশাপাশি জিজ্ঞাসাবাদ করা ব্যক্তিদের ফোনের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন তারা।

গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, সড়কে প্রকাশ্যে গুলি করে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পরিকল্পিত। সে কারণেই ঘটনার রাতে এজিবি কলোনির কাঁচাবাজার থেকে শাহজাহানপুরের হত্যাকাণ্ডের স্থানটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কিলাররা আগে থেকেই ওৎপেতে ছিল ঘটনাস্থলে। তাকে অনুসরণ করা হয়েছে আরও আগে থেকেই। ফলে এই সময়টাতে পুরো এলাকায় মানুষের চলাচল নিয়ে চলছে বিশ্লেষণ। বিশেষ করে ঘটনার দিন ছেলেকে নিয়ে সেলুনে চুল কাটাতে যাওয়া এবং সেখান থেকে ফিরে নিজ প্রতিষ্ঠান ‘গ্র্যান্ড সুলতান’-এ বসা-এসবই দেখা হচ্ছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। সেক্ষেত্রে সিসিটিভি ফুটেজের পাশাপাশি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানও অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হচ্ছে।

থমথমে এজিবি কলোনি এলাকা : মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুর জীবনের বড় সময় কেটেছে এজিবি কলোনি এলাকায়। ১৯৭৫ সাল থেকেই এই এলাকায় টিপুকে পেয়েছেন বলে যুগান্তরকে জানান তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মিজানুর রহমান। এই সময়ে বহু চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে। এই এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছিলেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে এজিবি কলোনির মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের ‘গ্র্যান্ড সুলতান হোটেল’ ও ‘এ টু জেড’ ফার্মেসি এবং কলোনির ভেতরের ‘স্পাইস অ্যান্ড স্পাইস’ রেস্টুরেন্ট। কলোনির ভেতরের রেস্টুরেন্ট চত্বরে মহিলাদের জন্য একটি জিম সেন্টারও চালু করেছিলেন তিনি। এই জায়গাটি একসময় শিশুদের খেলার মাঠ ছিল।

শনিবার টিপুর নিয়ন্ত্রণ করা এলাকায় গিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পাওয়া যায়। তবে টিপু হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই বন্ধ রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। এলাকায় বিরাজ করছে থমথমে অবস্থা। স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ মুখ খুলতে চাইছেন না। এমনকি সরকারি কলোনির ভেতরের কেউও কোনো কথা বলতে রাজি হননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলোনির ছয় বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয় যুগান্তরের। প্রায় একই ধরনের তথ্য দিয়ে তারা জানান, সরকারিভাবে এখানে বাসা বরাদ্দ পেলেও তারা অনেকটা বহিরাগতর মতো থাকেন। এসব নিয়ে তাদের মন্তব্য করার কোনো সুযোগ নেই। আর টিপু হত্যাকাণ্ডের পর সবার মধ্যে এক ধরনের ভীতি বিরাজ করছে। কারণ এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় যে কোনো সময় আরেকটি দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সে কারণেই বিনা প্রয়োজনে পরিবারের সদস্যদের বাসার বাইরে বের হতেও না করছেন তারা।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল বিভাগের ডিসি রিফাত রহমান শামীম বলেন, টিপু হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনেকগুলো বিষয় সামনে রেখে কাজ করছে ডিবি। আশার করছি শিগগির একটা ভালো খবর জানানো যাবে।

জনপ্রিয়তাই কাল হয়েছে টিপুর-স্ত্রী ডলি : শনিবার বিকালে শাহজাহানপুরের বাসায় এই হত্যাকাণ্ড, হুমকি ও টিপুর শত্রু-মিত্রসহ নানা বিষয় নিয়ে তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা হয় যুগান্তরের। ‘জনপ্রিয়তাই টিপুর কাল হয়েছে’-এমন মন্তব্য করেন টিপুর স্ত্রী ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১, ১১, ১২নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর ফারহানা ইসলাম ডলি। তিনি বলেন, আমাদের মাথার ওপরের ছায়া আর রইল না। আমার পরিবারের কেউ এখন নিরাপদ নয়। কেউ তাকে খুন করতে পারে এমনটা চিন্তাতেও আসেনি কখনো। ১০ বছর সে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিল। আইডিয়াল স্কুলের গভর্নিং বডির পাঁচবারের সদস্য ছিল। কেউ কোনোদিন তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ আনতে পারেনি।

অনেক আগে থেকে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছিল জানিয়ে স্ত্রী বলেন, বিভিন্ন সময়ে তার বিরুদ্ধে ৮-১০টি মামলা করা হয়েছে। মিল্কী হত্যার মামলায় তাকে জড়ানোর চেষ্টা হয়েছে। বোচা বাবু হত্যার পরও তাই হয়েছে। পরে এর বেশিরভাগই মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।

হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কিছু আঁচ করতে পেরেছিলেন কিনা-জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই ঘটনার তিন-চার দিন আগে সে শুধু একবার বলেছিল, ‘আমাকে বোধহয় মেরে ফেলবে।’ তাছাড়া এমন কিছু কখনোই কাউকে বলেননি তিনি। ঘটনার দিনের কথা জানিয়ে ফারহানা ইসলাম ডলি বলেন, সেদিন ছেলের চুল কাটাতে এজিবি কলোনিতে গিয়েছিলেন। আর রাতে বাসায় ফেরার উদ্দেশে যখন রওয়ানা হন, তখন মোবাইল ফোনে মটরশুঁটি রান্না করতে বলেন। আমিও তার জন্য রাতের খাবার প্রস্তুত করছিলাম। এর মধ্যেই ড্রাইভার ফোন করে জানায় তাকে গুলি করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর কাছে ঘটনার বিচার দাবি করে তিনি বলেন, আমার পুরো পরিবার আওয়ামী লীগের জন্য সারাজীবন কাজ করেছে। আমার স্বামী ছিলেন আওয়ামী লীগের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। আমি মহিলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। আমার অভিভাবক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমি তার কাছেই বিচার চাই। আমাদের নিরাপত্তা চাই। ঢাকায় আমাদের একটা বাড়ি নেই, জমি নেই, ভাড়া বাসায় থাকি। আগামীতে কীভাবে আমরা চলব তা নিয়েও অনিশ্চয়তায় আছি।

মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি বাণিজ্যের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, কোনো ভর্তি বাণিজ্য টিপু করেননি। অনেক সময় নেতাকর্মীরা এসেছে সন্তানকে ভর্তির জন্য। এভাবে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষও এসেছে। হয়তো ভর্তিতে তাদের সহযোগিতা করেছে। এজন্য কোনো টাকা তিনি নেননি। এটা কোনো বাাণিজ্য নয়।

রাজনৈতিকভাবে উপেক্ষিত ছিলেন টিপু : এদিকে মতিঝিল এলাকার আওয়ামী লীগের দাপুটে নেতা টিপু এক সময় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েন। দলীয় কোনো কর্মসূচিতে তাকে ডাকা হতো না। এ নিয়ে তিনি মানসিকভাবে ভালো ছিলেন না বলে জানিয়েছেন টিপুর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা। জানতে চাইলে টিপুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত হীরক যুগান্তরকে বলেন, কিছুদিন আগে ১০নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয় টিপু ভাইয়ের হোটেলের সামনে।

সেখানেও তাকে ডাকা হয়নি। নানাভাবে তাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে শাহজাহানপুরের আমতলা এলাকায় টিপুকে খুনের

মিশনে অংশ নেয় পেশাদার কিলার বাহিনী। এক থেকে দেড় মিনিটের অপারেশন শেষে পালিয়ে যায় কিলাররা। ১২ রাউন্ড গুলি ছোড়ে টিপুর দিকে। এর মধ্যে তার শরীরে সাত রাউন্ড গুলি লাগে। ঘটনাস্থলের আশপাশে কিলার বাহিনীর আরও কয়েক সদস্যের অবস্থান ছিল। প্রয়োজনে গুলি ছুড়ে এলাকায় আতঙ্ক ছড়াতে প্রস্তুত ছিল তারা। সুচারু পরিকল্পনায় খুব কাছ থেকে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ সময় গুলিতে নিহত হন কলেজছাত্রী সামিয়া আফরান জামাল প্রীতি।-যুগান্তর