Home জাতীয় দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ৬৩.৬০% এবং প্রাণহানি ৭১.৩৫% বেড়েছে

দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ৬৩.৬০% এবং প্রাণহানি ৭১.৩৫% বেড়েছে

29

সৈয়দ আমিরুজ্জামান, বিশেষ প্রতিনিধি: চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ১৬৫৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৭৫৮ জন নিহত হয়েছে। আহত ১১২৩ জন। নিহতদের মধ্যে ১৩২৭ জন (৭৫.৪৮%) ১৪ থেকে ৪৫ বছর বয়সী। দুর্ঘটনায় ৭২ জন শিক্ষক এবং ৬৬৯ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে। মোটরসাইকেলের ধাক্কায় ১৫১ জন পথচারী নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ৮.৫৮ শতাংশ।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ৭টি জাতীয় দৈনিক, ৫টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।

দুর্ঘটনার ধরন:

পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাসমূহের মধ্যে অন্য যানবাহনের সঙ্গে মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ৩৪৯টি (২১.১১%), মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫৮৩টি (৩৫.২৬%), মোটরসাইকেলে অন্য যানবাহনের চাপা ও ধাক্কা দেয়ার ঘটনা ঘটেছে ৭১৫টি (৪৩.২৫%) এবং অন্যান্য কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬টি (০.৩৬%)।

দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বিভিন্ন যানবাহনের চালক ও পথচারী:

দুর্ঘটনাসমূহ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৬৭২টি (৪০.৬৫%) দুর্ঘটনার জন্য মোটরসাইকেল চালক এককভাবে দায়ী। বাস চালক দায়ী ১০.৭৬% (১৭৮টি দুর্ঘটনা), ট্রাক চালক দায়ী ২৬.৭৯% (৪৪৩টি দুর্ঘটনা), কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি চালক দায়ী ৯.৫৫% (১৫৮টি দুর্ঘটনা), প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাস চালক দায়ী ২.৭২% (৪৫টি দুর্ঘটনা), থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-অটোরিকশা-অটোভ্যান-নসিমন-ভটভটি-টমটম) চালক দায়ী ৫.৮০% (৯৬টি দুর্ঘটনা), প্যাডেল রিকশা ও বাই-সাইকেল চালক দায়ী ০.৫৪% (৯টি দুর্ঘটনা) এবং পথচারী দায়ী ৩.১৪% (৫২টি দুর্ঘটনা)।

দুর্ঘটনা সংঘটিত সড়কের ধরন:

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ৫৭৭টি (৩৪.৯০%) জাতীয় মহাসড়কে, ৫২৮টি (৩১.৯৪%) আঞ্চলিক সড়কে, ২৯১টি (১৭.৬০%) গ্রামীণ সড়কে এবং ২৫৭টি (১৫.৫৪%) শহরের সড়কে সংঘটিত হয়েছে।

দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনসমূহের সংখ্যা:

দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা ২৭৪৯টি। মোটরসাইকেল ১৭১৯টি, বাস ১৯৪টি, ট্রাক ৪৮১টি, কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি ১৭২টি, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার ৫৬টি, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-অটোরিকশা-অটোভ্যান-নসিমন-ভটভটি-টমটম) ১১৩টি, এবং প্যাডেল রিকশা ও বাই-সাইকেল ১৪টি।

দুর্ঘটনার সময় বিশ্লেষণ:

সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাসমূহ ঘটেছে ভোরে ১.০৮%, সকালে ২৩.৩৫%, দুপুরে ১৭.৬০%, বিকালে ২৬.৩৭%, সন্ধ্যায় ১১.৯৭% এবং রাতে ১৯.৬০%।

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার কারণসমূহ:

১. কিশোর-যুবকদের বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালানো;

২. অতি উচ্চগতির মোটরসাইকেল ক্রয় এবং ব্যবহারে সহজলভ্যতা ও বাধাহীন সংস্কৃতি;

৩. ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা;

৪. দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা;

৫. সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির শিথিলতা;

৬. বাস-ট্রাক-পিকআপ-প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাসসহ দ্রুতগতির যানবাহনের বেপরোয়া গতি;

৭. চালকদের অদক্ষতা ও অস্থিরতা;

৮. ইজিবাইক-সিএনজি-নসিমন-ভটভটি ইত্যাদি স্বল্পগতির যানবাহন অপরিকল্পিত ও অদক্ষ হাতে চালানো;

৯. সড়ক-মহাসড়কে ডিভাইডার না থাকা;

১০. সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা না থাকা;

১১. পারিবারিকভাবে সন্তানদের বেপরোয়া আচরণকে প্রশ্রয় দেয়া;

১২. দেশে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর সংস্কৃতি গড়ে ওঠা ইত্যাদি।

সুপারিশসমূহ:

১. কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে;

২. মাত্রাতিরিক্ত গতিসম্পন্ন মোটরসাইকেল উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে;

৩. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে;

৪. গণপরিবহন চালকদের বেতন ও কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করতে হবে;

৫. বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে;

৬. ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে;

৭. মহাসড়কে মোটরসাইকেলের জন্য আলাদা লেন তৈরি করতে হবে এবং স্বল্পগতির স্থানীয় যানবাহন বন্ধ করতে হবে;

৮. স্বল্পগতির যানবাহনের জন্য মহাসড়কের পাশাপাশি সার্ভিস রোড নির্মাণ করতে হবে;

৯. পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে;

১০. গণপরিবহন উন্নত ও সহজলভ্য করে মোটরসাইকেল নিরুৎসাহিত করতে হবে;

১১. রেল ও নৌ-পথ সংস্কার এবং বিস্তৃত করে সড়ক পথের উপর থেকে ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের মতো পণ্যবাহী যানবাহনের চাপ কমাতে হবে;

১২. সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে;

1৩. “সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮” সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

মন্তব্য: গত বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ১০১১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১০২৬ জন নিহত হয়েছিল। এই হিসেবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে দুর্ঘটনা বেড়েছে ৬৩.৬০% এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৭১.৩৫%।

দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। এসব দুর্ঘটনা মহাসড়কে বেশি ঘটছে। অধিকাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটছে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, পিকআপ ও বাসের ধাক্কা, চাপা ও মুখোমুখি সংঘর্ষে। মোটরসাইকেল চালকদের অধিকাংশই কিশোর-যুবক। এরা চরম বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালিয়ে নিজেরা দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং অন্যদের আক্রান্ত করছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ৩৫ লাখ মোটরসাইকেল চলছে। শুধু রাজধানীতেই চলছে ১২ লাখের বেশি। মানসম্মত গণপরিবহনের অভাব এবং যানজটের কারণে মোটরসাইকেলের ব্যবহার অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। মোটরসাইকেল ৪ চাকার যানবাহনের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এজন্য গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত ও সহজলভ্য করে মোটরসাইকেলের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে হবে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ তা-ই করছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার মোটরসাইকেল আমদানী ও উৎপাদনে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে, প্রণোদনা দিয়ে এটিকে সস্তা ও সহজলভ্য পণ্যে পরিণত করছে। ফলে দেশের সর্বত্র কিশোর-যুবকদের হাতে অধিক গতিসম্পন্ন মোটরসাইকেলের ছড়াছড়ি। এগুলো ক্রয় ও ব্যবহারে নিয়ম-কানুন মানার বালাই নেই। নেই মনিটরিং ব্যবস্থা। উল্লেখ্য, গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত না করে মোটরসাইকেল উৎপাদনকে উৎসাহিত করা সরকারের একটি আত্মঘাতি ও অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত। সরকারের উচিত, এখনই মোটরসাইকেল উৎপাদন, ক্রয় ও ব্যবহারের লাগাম টেনে একটি টেকসই গণপরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ১৬৫৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৭৫৮ জন নিহত হওয়ার রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রতিক্রিয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মৌলভীবাজার জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য, অারপি নিউজের সম্পাদক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট কমরেড সৈয়দ অামিরুজ্জামান বলেন, “বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করা, গণপরিবহন চালকদের বেতন ও কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করা, বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করা, মহাসড়কে মোটরসাইকেলের জন্য আলাদা লেন তৈরি করা এবং স্বল্পগতির স্থানীয় যানবাহন বন্ধ করা, স্বল্পগতির যানবাহনের জন্য মহাসড়কের পাশাপাশি সার্ভিস রোড নির্মাণ করা, পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করা, গণপরিবহন উন্নত ও সহজলভ্য করে মোটরসাইকেল নিরুৎসাহিত করা, রেল ও নৌ-পথ সংস্কার এবং বিস্তৃত করে সড়ক পথের উপর থেকে ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের মতো পণ্যবাহী যানবাহনের চাপ কমানো, সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানোসহ “সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮” বাস্তবায়ন জরুরী বলে মনে করছি।”