Home মতামত চে’র ৫৬তম মৃত্যুবার্ষিকী

চে’র ৫৬তম মৃত্যুবার্ষিকী

35

মুক্তার হোসেন নাহিদ: ‘একজন মানুষের সঙ্গে সঙ্গে একটি রূপ কথাও চিরতরে বিশ্রামে গেল’-‘চে’র মৃত্যুর পর লিখেছিল নিউইয়র্ক টাইমস। সত্য হয় নি। বিপ্লবীরা মৃত্যুতেও মশাল জ্বালায়। প্রমাণ বলিভিয়ার ভ্যালেগ্রান্দে’র মাল্টা হাসপাতালেই সারারাত লাইন ধরে মৃত চে’কে এক নজর দেখার জন্য সেনা, সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষের ভীড় জমেছিল। তার মৃত্যু সংবাদের পর কিউবায় লাখো জনতার সামনে আবেগঘন কণ্ঠে কমরেড ফিদেল ক্যাস্ত্রো উচ্চারণ করেছিলেন, “ যারা মনে করছে চে গুয়েভারার মৃত্যুর মধ্যদিয়ে তার আদর্শ বা রণকৌশলের পরাজয় ঘটেছে, তারা ভুল করছে”। সত্যিই তাই ৫৬ বছর পরেও কমরেড ‘চে’ আজো দুনিয়ার বিপ্লবীদের প্রেরণা। ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর বলিভিয়ার সেনাবাহিনী তাকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে।
‘চে’র পুরো নাম আর্নেস্তো গুয়েভারা দে লা সেরনা। তবে সারা বিশ্ব পরিচিত লা চে বা কেবলমাত্র চে নামে। জন্ম ১৯২৮ সালের ১৪ জুন আর্জেন্টিনায়। তিনি ছিলেন একজন মার্কসবাদী, বিপ্লবী, চিকিৎসক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ, সামরিক তত্ত্ববিদ এবং কিউবা বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব। তরুণ বয়সে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে চে সমগ্র লাতিন আমেরিকা ভ্রমণ করেছিলেন। এই সময় এই সব অঞ্চলের সর্বব্যাপি দারিদ্র্য তার মনে গভীর রেখাপাত করে। তিনি উলব্ধি করেন এই অঞ্চলে বদ্ধমূল অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্বাভাবিক কারণ হল একচেটিয়া পুঁজিবাদ, নব্য ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ। এর একমাত্র সমাধান হল বিশ্ব বিপ্লব। সেই বিশ্বাসে তিনি গুয়তেমালার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীকালে মেক্সিকো সিটিতে বসবাসের সময় তার সঙ্গে রাউল ও ফিদেল কাস্ত্রোর আলাপ হয়। চে তাদের আন্দোলনে যোগ দিয়ে মার্কিন-মদতপুষ্ট কিউবান একনায়ক ফুলগেনসিও বাতিস্তাকে উৎখাত করার জন্য গ্রানমায় চড়ে সমুদ্রপথে কিউবায় যান। বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করার লক্ষ্যে দুই বছর ধরে চলা গেরিলা সংগ্রামে তার অনন্য সাধারণ অবদান ছিল। বিপ্লবের পর তাকে কিউবার নাগরিকত্ব ও শিল্পমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করা হয়। কিন্তু কিছুদিন দায়িত্ব পালনের পর চে’ বিপ্লবের অমোঘ আহ্বানে বলিভিয়ায় পাড়ি জমান। বলিভিয়ায় অবস্থানকালে তিনি সিআইএ’র মদতপুষ্ট বলিভিয়ান বাহিনীর হাতে ১৯৬৭ সালের ৭ অক্টোবর পায়ে গুলি লেগে এবং গুলিতে হাতের অস্ত্র পড়ে যাওয়ায় ধরা পড়েন। ৯ অক্টোবর বলিভিয়ার লা হিগুয়েরার এক স্কুলঘরে সার্জেন্ট মরিও টেরেন সরকারি নির্দেশ পালন করতে ঢুকেন। চে বুঝতে পেরে উঠে দাঁড়ানো পর্যন্ত টেরেনকে অপেক্ষা করতে বলেন। এ সময় কমরেড ‘চে’র শেষ উক্তি ছিল, “ জানি তোমরা আমাকে হত্যা করতে এসেছ। ভীরুর দল গুলি করো। তোমরা কেবল একটি মানুষকেই মারতে যাচ্ছ। বিপ্লবী চেতনাকে নয়।” সার্জেন্ট টেরেন ভীত হয়ে কাঁপতে কাঁপতে প্রথমে ঘর থেকে দৌড়ে পালিয়ে যান। পুনরায় ফিরে এসে চে’র দিকে না তাকিয়ে পর পর ৯টি গুলি করে। নিভে যায় চে’র জীবনপ্রদীপ। তারপর তার রক্তাক্ত দেহ নিয়ে যাওয়া হয় ভ্যালেন্দ্রে’র মাল্টা হাসপাতালে। সেখানেই ধুয়েমুছে পরিষ্কার করা হয় তার দেহের রক্ত। সেখানকার কোথাও সাথীদের সাথে সমাধিস্ত করা হয় চে’কে। কেটে রাখা হয় তার দু’হাত। রাসায়নিক উপায়ে সংরক্ষিত ওই দু’টি হাত প্রথমে কমিউনিস্ট, পরে সিআইএ’র এজেন্ট এবং তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্তনিও আরগুয়েডেস তার লেখক বন্ধু জর্জ গুয়ারেসের হাতে তুলে দেন। দুই বছর পর ১৯৭০ সালের ৫ জানুয়ারি তা কিউবায় পৌঁছে। ১৯৯৭ সালে আজেন্টিনা ও কিউবার ফরেনসিক বিশেজ্ঞরা ভ্যালেন্দ্রেতে হাত বিহীন ‘চে’ ও তার সাথীদের খুঁজে পান। তারপর চে ও তাদের দেহাবশেষ কিউবার সান্তা ক্লারায় নতুন স্মৃতিসৌধ করে সেখানেই সমাহিত করা হয়।
আজো বিশ্বজুড়ে এই বিপ্লবী অগ্নিপুরুষের নামই ধ্বনিত হয়। এই মহান বিপ্লবীর মৃত্যুর পর তার প্রতিকৃতি একটি সার্বজনীন বিপ্লবের মুখছবি হিসেবে বিশ্বপ্রতীকে পরিণত হয়। মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী পরও টাইম ম্যাগাজিনে বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকায় চে’র নাম ওঠে আসে। পৃথিবীর দরিদ্র, নিঃস্ব, নিপীড়িত, শোষিত, প্রান্তিক মানুষের মুক্তির বার্তা নিয়ে চে’ যুগে যুগে জন্ম নেবে। ল্যাটিন আমেরিকায়, এশিয়ায় বা অন্য কোথাও। কারণ “বিপ্লব ও বিপ্লবীর মৃত্যু নাই।”

-লেখক: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী।