Home বাণিজ্য ও অর্থনীতি চার বিপদসংকেত বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য

চার বিপদসংকেত বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য

34

ডেস্ক রিপোর্ট: ভারতের অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (ওআরএফ) এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনীতির চারটি চলমান সংকট চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রথমত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে, দ্বিতীয়ত রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমছে এবং তৃতীয়ত বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জ্বালানি সংকট, যার সমাধান সহসাই হবে বলে মনে করা যাচ্ছে না। তবে এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের যে আন্তর্জাতিক ঋণ নিতে যাচ্ছে, সেই ঋণ পরিশোধ ব্যবস্থাপনায় সাফল্য এলেই এসব সংকট কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রশংসা করে বলা হয়েছে, গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতির একটিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে দারিদ্র্য নিরসনের একটি মডেল, যা সারা বিশে^ অনন্য উন্নয়নের উদাহরণ হয়ে গেছে।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশ ছিলো বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ। ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে বৃহৎ আকারে বাণিজ্য উদারীকরণের পথে যায় দেশটি। ২০০০ এর প্রথম দশকে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যা দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে অনেকাংশে প্রশমিত করেছে। ১৯৯১ সালে দারিদ্র ছিলো ৪৩.৫ শতাংশ, সেটি ২০১৬ সালে ১৪.৩ শতাংশে নেমে আসে। তা সত্ত্বেও ১৯৮০ সাল থেকে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২১ সাল পর্যন্ত জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ দেশের জাতীয় আয়ের ১৬.৩ শতাংশ ধারণ করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটি ২০১৫ সালে একটি নিম্নআয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে স্নাতক হয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় স্থান করে নেওয়ার পথে রয়েছে। আর ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এগোচ্ছে বাংলাদেশ।

জনসংখ্যা এবং প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। দেশের শ্রমঘন শিল্প টেক্সটাইল এবং রেডিমেড গার্মেন্টস (আরএমজি)। তৈরি পোশাক শিল্প একদিকে অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান বাড়িয়েছে। অন্যদিকে, দেশে রপ্তানিমুখী শিল্পায়নের পথও তৈরি করেছে।

প্রবাসী আয় এবং কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ খাতও দেশের অর্থনীতির জাগরণে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। অসামান্য ভূমিকা রেখেছে ডিজিটাল বাংলাদেশের মতো উদ্যোগ। তথ্য প্রযুক্তির বিকাশের ফলে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন বেড়েছে। দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে উঠছে। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির বড়ো শক্তি।

ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশকে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যার মোকাবেলা করতে হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলির মধ্যে একটি বাংলাদেশ। জলবায়ুজনিত এই ক্ষয়ক্ষতি দেশের অর্থনীতিতে অকল্পনীয় চাপ সৃষ্টি করে। সহায়সম্পদ হারিয়ে গ্রাম থেকে মানুষ ক্রমশ শহরমুখী হয়। শহরের বস্তিতে বসবাসকারী প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ বন্যা ও নদীভাঙ্গনের কবলে পড়ে গ্রাম ছেড়ে এসেছে।

২০২০ সালের মে মাসে করোনা যখন সবেমাত্র হানা দিতে শুরু করেছে, তখন বাংলাদেশ ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়, আম্ফানের মুখোমুখি হয়েছিল। এই আম্ফান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশা রাজ্যের বিশাল অংশকেও ধ্বংস করেছিল। ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের নয়টি জেলা জুড়ে ১০ লাখের বেশি লোককে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিলো। রাস্তা এবং সেতুর মতো ভৌত অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি করেছিল। ঘুর্ণিঝড়টিতে বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিলৈা ১৩ কোটি মার্কিন ডলার।

কোভিড-১৯ মহামারী শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বিপর্যয়ের কারণ হয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির ধাক্কা বাংলাদেশেও লেগেছে। কিন্তু প্রতিবেশিদের তুলনায় বাংলাদেশ অনেক ভালোভাবে সংকট মোকাবেলা করেছে। শ্রীলঙ্কার মতো দেশ জ্বালানি ও খাদ্যের মতো প্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতিতে পড়েছিলো। সৃষ্টি হয়েছিলো চরম অর্থনৈতিক সংকট। অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া পাকিস্তানকে অত্যন্ত অনিশ্চিত অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে ফেলেছে। নেপাল ব্যাংকিং সেক্টরে তারল্য সংকটের মুখোমুখি, স্থবির তাদের বিদেশী রেমিটেন্স। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দেশটির বাণিজ্য ঘাটতি। একই অবস্থার মুখোমুখি মিয়ানমারও।

বর্তমান সংকট থেকে ভালোভাবে উত্তরণের লক্ষ্যে ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ^ব্যাংক, এডিবি ও আইএমএফ দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের পাশে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে বাংলাদেশ পাবে প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা এক পর্যায়ে ৬ বিলিয়নে দাঁড়াবে।

২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের জন্য প্যাকেজ নিয়ে এগিয়ে যেতে সম্মত হয়েছে এবং এই পরিমাণটি ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সাত কিস্তিতে বিতরণ করা হবে। সরকার ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের কাছ থেকে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ চাইছে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) এবং এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) সঙ্গেও আর্থিক সহায়তার বিষয়ে আলোচনা করবে।

সরকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উন্নতির জন্য বিভিন্ন স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে ঋণ চাওয়ার পদক্ষেপটি একধাপ পিছিয়ে যাওয়ারই নামান্তর। এটি আবার একই সঙ্গে বহুমুখী সংস্কার কর্মসূচির মাধ্যমে প্রবৃদ্ধির কৌশল পুনর্বিবেচনার সুযোগ দেয়। যদিও এই ধরনের আর্থিক সহায়তা চাওয়াকে একটি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে উল্লেখ করেছে সরকার।

চারটি সংকটের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও ২০২০ সালে বাংলাদেশ ৩.৪ শতাংশের ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যখন কোভিডের কারণে ভারতসহ বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশের প্রবৃদ্ধির হার নেতিবাচক ছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশকে এখন চিন্তা করতে হবে ঋণ পরিশোধের বিষয়ে। আইএমএফ এবং অন্যান্য বহুপাক্ষিক সংস্থার কাছ থেকে এই ধরনের ঋণগুলো কিছু শর্ত নিয়ে আসে, যেগুলোর বাস্তবায়ন ঋণগ্রহীতা দেশের জন্য কার্যকর করা প্রায়ই কঠিন। যথানিয়মে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বাধাগ্রস্ত হবে। অন্যান্য বিদেশি ঋণদাতাদের কাছে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। আর সেক্ষেত্রে বহির্বিশ্বের সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বকেও প্রভাবিত করবে। এই বিষয়গুলো মাথায় রেখেই বাংলাদেশকে চলতে হবে, আর এক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনের মধ্যদিয়েই আগামী দশকগুলিতে বাংলাদেশ তার প্রবৃদ্ধি উন্নয়নের গল্পগুলো রচনা করবে।
আমাদের সময়.কম