Home মতামত ও সাগর! ও পাহাড়!!

ও সাগর! ও পাহাড়!!

34

সাইফুল ইসলাম শিশির: সাগরস্নানে হোটেল কল্লোল আমাকে দারুণ ভাবে টানে। উপর- নিচ তলা মিলে রেস্টুরেন্ট ‘কাসুন্দি’ ছিমছাম পরিবেশ। বার-বি কিউ, পরিপাটি সাজানো গোছানো টেবিল। পাশে কনসার্টে সুরের মূর্ছনা। যেন পূর্ণিমাসন্ধ্যা।
কাসুন্দিতে বসে সাগর- পাহাড় ভ্রমণের কাসুন্দি ঘাটছি। কক্সবাজারে আমার অনেক স্মৃতি আছে। যা আমাকে বেশ আনন্দ দেয়, ভাবায়।
পুত্রধন সিয়াম সাইফ, সহকর্মী মুনিরকে নিয়ে বান্দরবান জেলার লামা- আলীকদমের উদ্দেশ্যে বের হলাম। মুনির এবং ড্রাইভার রাজ দু’জনেই কক্স-এর বাসিন্দা। তারা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলে সে ভাষা বোঝা বড় দায়। তবে শুনতে বেশ ভালো লাগে। সিয়াম সাইফ খুব এনজয় করছে।
রাস্তায় অনেকগুলো ব্রিজের উপর দিয়ে পার হলাম। দুধার উঁচু গাছপালায় ঢাকা, নিচ দিয়ে সর্পিলাকারে স্রোতস্বিনী বয়ে চলেছে। পাহাড়ের ছড়া বেয়ে দুএকজন নদীতে নামছে। পাহাড়-নদী- নীল আকাশ আমাকে দারুণ ভাবে নস্টালজিক করে তোলে। মন ছুটে যায় সিরাজ সিকদারের কবিতায়। “পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামছে এক মুরং মেয়ে/ কী নিটোল স্বাস্থ্যবতী/ কবে তার কাধে শোভা পাবে রাইফেল একখানি।”
যতবার ব্রিজে উঠি, সিয়াম জিজ্ঞেস করে, এটা কোন নদী? মুনির বলে মাতামুহুরি। ঘুরে ফিরে সামনে পড়ে মাতামুহুরি। এই নদীর উৎপত্তিস্থল নিয়ে বিতর্ক আছে। এটি কোন একক উৎস থেকে উৎসারিত নয়। কিংবদন্তি আছে, মাতৃস্তন সদৃশ অনেক গুলো পর্বত চুয়ে চুয়ে এই জলধারার সৃষ্টি হয়েছে। মুহুরি শব্দের অর্থ ছিদ্র সমূহ- ঝাজর, ইংরেজিতে যাকে বলে শাওয়ার। এ নদীর মোট দৈর্ঘ ২৮৭ কিলোমিটার। বাংলাদেশের অংশে ১৪৬ কিলোমিটার। লামার দুর্গম পাহাড়ি এলাকা মাইভার পর্বত থেকে এর উৎপত্তি। উজানে আদি উৎস লুসাই পাহাড়। লামা- চকরিয়া ঘুরে পেকুয়ার পশ্চিম পাশ ঘেঁষে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। মাতামুহুরির মোহনায় যে ব-দ্বীপ গড়ে উঠেছে ভোলাখাল থেকে খোটাখুটি পর্যন্ত বিস্তৃত।
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে এগিয়ে চলেছি লামা সদরের দিকে। চারিদিকে সবুজে ঘেরা শুধু পাহাড় আর পাহাড়। কী অপূর্ব সৌন্দর্যের লীলাভূমি। সিয়াম সাইফের চোখে এক অপার বিস্ময়। বিউটিফুল বাংলাদেশ। ছিয়াংছা বাজার পার হতেই সেনা চেকপোস্ট চোখে পড়লো। অদূরে উঁচু টিলার উপর নজরকাড়া সরকারী পর্যটন কেন্দ্র। শুধু মাত্র উঁচুতে পানি উঠাতে না পারার কারণে কেন্দ্রটি আজও সফলতার মুখ দেখেনি। অল্প সংখ্যক দর্শনার্থী এখানে আসে, ঘুরেফিরে চলে যায়। রেস্টুরেন্টে / কটেজগুলো এখনো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে।
পর্যটনের সামনে পাহাড়ের ঢাল ঘেঁষে কাঠ- বাঁশ দিয়ে তৈরী ঝুপড়ি ঘর। তার নিচে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান। সামনে মাচান পাতা, তাতে গিয়ে বসলাম। দৃষ্টি আটকে গেল রাস্তার পাশে ছোট্ট একটি সাইনবোর্ডের উপর। “মনে আঁকাবাঁকা পথ।” ব্যাপার কি? বাংলায় লেখা অথচ মর্মার্থ খুঁজে পাচ্ছি না! আমার তো আবার বুদ্ধির গোড়ায় ধুঁয়া দেবার অভ্যাস নেই। বুদ্ধি বের হবে কী করে? অবশেষে অনেক ভেবে চিন্তে বের করা গেল মনে আঁকাবাঁকা পথ। মনে-এর আগে সা ছুটে গেছে। সামনে আঁকাবাঁকা পথ– সাইনবোর্ড দেখে আমার মতো আয়োডিনের অভাব- কত মানুষ যে ধাধায় পড়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই।
দুপুরে খাবারের জন্য লামা সদরে গিয়ে হাজির হলাম। আচার, নানা জাতের শাক সব্জি, শুটকি ভর্তা, ভাজি শতপদের বাহারি খাবার। হোটেল ‘কুটুম বাড়ি।’ বেশ সুস্বাদু খাবার, তবে ঝাল লবণ একটু বেশি। শীতের মধ্যেও কপাল ঘেমে উঠে।
পৌর ভবনের পাশে ছোট্ট একটি বেইলি ব্রিজ। একটি বোঝাই ট্রাক পার হতে গিয়ে আটকে গেছে। আমরা জ্যামে আটকে আছি, বিরক্তির এক শেষ। পাশেই সাইনবোর্ডে লেখা সামনে ঝুঁকি পূর্ণ ব্রিজ। — টনের অধিক মাল বোঝাই যান চলাচল নিষেধ। কত টনের অধিক তা বোঝা যাচ্ছেনা। শুধু —- ড্যাশ চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। কোন দুষ্ট লোক হয়তো পান খেয়ে চুন লাগিয়ে গেছে।
৭০ দশকের শেষ দিকের কথা। এক অগ্রজ মতো পার্থক্য /বিভেদের কারণে ছাত্র জীবন শেষে সক্রিয় রাজনীতি থেকে বলতে গেলে হারিয়ে যান। মাঝে মাঝে বিভিন্ন দিবসকে কেন্দ্র করে তার দু’একটা বিবৃতি পত্রিকায় আসে। তিনি বাম ঘরানার জাতীয় নেতৃবৃন্দের জন্মদিবস/ মৃত্যু দিবস পালনের জন্য কমিটি গঠন করেন। একটি মাত্র ব্যানার ছিল যা নিম্ন রূপ, শহীদ / বিপ্লবী/ বুদ্ধিজীবি —— উদযাপন কমিটি। যখন যার মৃত্যু- জন্মদিন তাঁর নাম লিখে শুন্য স্থানে বসিয়ে দিতেন। সবাই রসিকতা করে বলতো ড্যাশ উদযাপন কমিটি।
ছোট বেলা থেকে শুনে এসেছি টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া — এক পলল ভূমি, প্রিয় বাংলাদেশ। আবেগ ভরা হৃদয়ে সিয়াম সাইফকে নিয়ে মেরিন ড্রাইভ ধরে ছুটে চলেছি টেকনাফের দিকে। সেখান থেকে আরও দূরে বাংলাদেশের শেষ দক্ষিণ- পূর্ব সীমানা সাবরং। সূর্যোদয়ের দেশ জাপান। আমাদের সূর্যোদয় সাবরং-এ।
কলম্ব থেকে গল, দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ পাড়ি দেবার অভিজ্ঞতা আমার আছে। বন্ধুবর শরীফ উজ- জামান স্বপন ছিলেন সাথী। আজ আমার সাথে সিয়াম সাইফ। আবেগটা একটু বেশি- উপচে পড়া।
সাবরং এর বুকে এখন শুধু রাশি রাশি বালি। এখনো পর্যটনের বনেদি তকমা তার গায়ে লাগেনি। তবে লাগলো বলে। বাংলাদেশ নৌ-বাহিনী এবং পর্যটন কর্পোরেশন যৌথ ভাবে গড়ে তুলছে আন্তর্জাতিক মানের দেশের সর্ববৃহৎ পর্যটন কেন্দ্র- সাবরাং।
সবে শুরু গাছের নিচে দু’একটা দোকান বসেছে। কফি- সফট ড্রিংকস এর দোকানও দেখলাম। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা কনকনে শীতের মধ্যে পেপসি কোকা কোলা পান করছে। আমি এক কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম।কেতলিতে চা ঢালতে ঢালতে দোকানদার- ‘কী চা খাবেন স্যার? লবণ চা, দুধ চা, লাল চা,আদা চা, তেতুল চা!’ আগ্রহ ভরে লবণ চায়ের অর্ডার দিলাম।
অদূরে বাঁশ দিয়ে এক চিলতে যায়গা ঘেরাও করে রাখা আছে। টিউবওয়েলের পাশে দু’টো বদনা গড়াগড়ি খাচ্ছে। হাতে লেখা একখানা ছোট্ট সাইনবোর্ড,’ নামাজ ঘর।’
দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনের কথা মনে হলো। ভারত সাগর আর আটলান্টিকের মিলন স্থল কেপ অব হোপ- উত্তমাশাঅন্তরিপ। প্রকৃতির সৌন্দর্যময়।লীলা ভূমি। জিরো পয়েন্টের সন্নিকটে পাথরের উপর পাথর বসিয়ে তৈরী ছোট একটি মসজিদ। কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
লবন চা খেতে খেতে ভাবলাম একদিন হয়তো সাবরাংও কেপ অব হোপ’র ন্যায় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে। সারা পৃথিবীর পর্যটকরা এসে এখানে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। কর্মজজ্ঞ শুরু হয়েছে। আমি দারুণ আশাবাদী।

৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সাল
লেক সার্কাস, উত্তর ধানমণ্ডি
ঢাকা