Home মতামত ভাষার মাস! আশার মাস!!

ভাষার মাস! আশার মাস!!

51

ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীন:

ছেলেবেলার স্কুল জীবন। হাসি আনন্দ, ঠাট্টা মশকরা আর দুরন্তপনায় কেটে যাওয়া বড় সুখের জীবন। সন্দেহ নেই, পড়াশুনার চাপে মাঝেমাঝে মনে বিষন্নতা দেখা দিত। কষ্ট পেত মন। ভাবতাম, কবে পড়াশুনা শেষ হবে? কবে বড় হবো? কিন্তু সে সব বিষন্নতা খুব সামান্য। খুব অল্প সময়ের। দীর্ঘ সময় ছিল সুখের সময়। সীমাহীন আনন্দ ভোগের সময়। অনাবিল আনন্দ আর মাতোয়ারা মনে ডানা মেলে ভাসতাম আকাশে। স্কুল জীবনের স্বপ্নীল সব আকাশ।
স্কুল জীবনের প্রতিটি দিনই স্বপ্নের দিন। এর মাঝেও বিশেষ বিশেষ স্বপ্নের দিন থাকতো। অনেক অনেক বিশেষ দিবসের মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিবস ছিল তিনটি। অতীব গুরত্বপূর্ণ দিবস; শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবস। অন্যান্য দিবসগুলোর তাৎপর্য থাকলেও গুরুত্ব তেমন ছিল না। গুরত্ব ছিল উল্লেখিত তিনটি দিবসের। বিশেষ গুরত্ব। এই তিনটি দিবস ছিল একেবারেই আলাদা। এসব দিবসে যেমনি ভাবগম্ভীর্যময় অনুভ‚তি ছিল, তেমনি ছিল আনুষ্ঠানিকতাও। ঘরে বাইরে, বাজার ঘাটে এবং স্কুল আঙিনা সর্বত্র।
ঘরে ঘরে আনুষ্ঠানিকতা ছিল না, তবে অনুভুতি ছিল প্রবল। বাইরের বৈঠকখানা থেকে ভেতর বাড়ির রান্নাঘর। অনুভুতিগুলো চোখে পড়ার মত ছিল। অনুভুতি সবার চোখে ছিল, অন্তরেও ছিল। আর হাটবাজার ছিল রশিতে ঝুলানো ছোটছোট রঙিন কাগজ এবং জাতীয় পতাকায় সুসজ্জিত। দোকানে দোকানে ছোট লাঠির মাথায় ঝোলানো পতাকার পতপত আওয়াজে মুখরিত হতো বাজার। আমরা পতাকা বরাবর নীচে দাঁড়িয়ে ওপরে তাকিয়ে তাকিয়ে পতাকা উড়া দেখতাম। পতাকা পতপত করে তেমন উড়তো না। তবে আমরা উড়তাম।
পতপত করে মনে মনে উড়তাম। কঠিনভাবে দুলে উঠতাম। বেশি দোলতাম মাইকে বাজানো দেশাত্মবোধক গানে। দেশের গান, যুদ্ধের গান। আর গানের ফাঁকে ফাঁকে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ। এটা মনকে দোলা দেবার পাশাপাশি উত্তেজিত করতো। দেশপ্রেমের উত্তেজনা। পুরো বাজার কাঁপিয়ে তুলতো গগণবিদারী সেই ভাষণ। মনে হতো আমরা ভাষণ শুনছি না, সাক্ষাত রেসকোর্সে দাঁড়িয়ে একেবারে সামনে থেকে মহানায়কের কবিতা আবৃতি শুনছি।
যেই না সেই আবৃতির ভাষণ শুরু হতো, অমনি লোকজন জড়ো হয়ে যেত। লোকজন আসতেই থাকতো। বেশি না, পুরো বাজার জুড়ে মাত্র একটা মাইক থাকতো। মোটে একটা। সেটাই কাঁপিয়ে দিত পুরো বাজার। কাঁপিয়ে দিত সবার মন। চেয়ারপাতা খোলা জায়গায় চৌকি পেতে খুব সাধারণ মানের মঞ্চ করে বাঁধা হতো সেই মাইক। মাইকে কিছুক্ষণ গান বাজে, কিছুক্ষণ ভাষণ। আর কিছুক্ষণ পরপরই আসে ঘোষকের ঘোষণা; ভাইসব, ভাইসব! আজ বিকেলের ঐতিহাসিক জনসভায় প্রধান অতিথি ……!!!
আফছা আফছা মনে পড়ছে কোন একবারের স্বাধীনতা দিবসের কথা। সময়টা সকালই হবে। মঞ্চ সাজাবার কাজ চলছে। অনুষ্ঠান হবে বিকেলে। মাইকম্যান মাইক নিয়ে চলে এসেছেন। মঞ্চের পাশের আমগাছে বাঁধবেন। মোটামুটিভাবে গাছের যতটুকু চূঁড়ায় যাওয়া যায় ততটুকু চূঁড়াতেই বাঁধার কাজ করছেন। নীচে খালি মঞ্চ। সামিয়ানা টানানো মঞ্চ। আশেপাশে কেউ নেই। শুধু মাইক্রোফোনটা পড়ে আছে। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে সুযোগ নিলাম। মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়েই “হ্যালো হ্যালো! মাইক্রোফোন টেস্টিং!! হ্যালো হ্যালো!!!” বলা শুরু করলাম। বহুদিনের স্বপ্ন একদমে পূরণ করে ফেললাম।
মনের মধ্যে বহুদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ করলাম বটে, কিন্তু নিজেকে রক্ষা করতে পারলাম না। ধরা পড়ে গেলাম। আমি বলা শেষ করতে পারিনি, অমনি হুরমুর করে গাছ থেকে নেমে খপ করে আমাকে ধরে ফেললেন মাইকম্যান। তার নামটা এখন আর পরিস্কার মনে নেই। হয়ত হাসমত বা এমন কিছু একটা হবে। তবে এটুকু মনে আছে, বেজায় ঠান্ডা প্রকৃতির মানুষ ছিলেন তিনি। এমনি ঠান্ডা ধরণের মানুষটি এতটা গরম হয়ে আমাকে জাপটে ধরবেন বুঝি নাই। হাসমত ভাই জাপটে ধরেই জোরে জোরে বললেন, আইয়া পড়ছে, আইয়া পড়ছে। আজকের প্রধান অতিথি আইয়া পড়ছে।
মহা বিপদে পড়ে গেলাম। এই যে তিনি জাপটে ধরেছেন আর ছাড়ছেন না। গাইগুই করে সামনে পেছনে ধাক্কাধোক্কা মেরেও ছাড়াতে পারলাম না। মাথা নীচু করে তার হাতের নীচ দিয়ে বেরিয়ে যাবার বৃথা চেষ্টা করলাম। কাজ হলো না। তার শক্ত হাত থেকে ছাড়া পেলাম না। কথা তার একটাই; কবিতা আবৃতি না করে যাওয়া যাবে না। এবং শেষমেষ মাইকে কবিতা পড়তেই হলো; চির সুখীজন ভ্রমে কি কখন, ব্যথিত বেদন বুঝিতে কি পারে?
আমার কবিতা শোনার শ্রোতা কিংবা দর্শক একজনও সেদিন ছিল না। কিন্তু কবিতা বলায় আমার উম্মাদনা ছিল। উত্তেজনা ছিল। উত্তেজনা দৌঁড়ের মধ্যেও ছিল। মঞ্চ থেকে নেমে সোজা দৌঁড়ে বাসায় যাচ্ছি। বলা তো যায় না, মঞ্চের আশেপাশে থাকলে হাসমত ভাই আবারো ডাক দেয় কি না। সর্বনাশা সে ডাক। ঘাম ছুটে যায় শরীরে। মাইক্রোফোনটাও দেখতে আজকের দিনের মাইক্রোফোনের মত ছিল না। একটা আস্ত বড় আকারের কাঁচা বেল দেখতে যেমন, মাইক্রোফোনটা দেখতে অনেকটা তেমন ছিল।
এমনি এক মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বিজয় দিবসের এক বিকেলে মঞ্জুভাই অনুষ্ঠান শুরুর আগে আগে উপস্থাপনা করে যাচ্ছেন। উপস্থাপনা আর কি! একটু একটু কথা বলেন আর কথার ফাঁকে ফাঁকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাজান। খারাপ লাগছিল না। বেশি ভাল লাগছিল মানুষের উপস্থিতি দেখে। সামনে থাকা খোলা জায়গায় মানুষ এসে বসতে শুরু করেছে। তখনকার সময় বসার জন্যে কোন চেয়ারের ব্যবস্থা ছিল না। খোলা আকাশের নীচে খোলা জায়গা। ধুলো ময়লায় মাখানো দর্শকদের খোলামেলা বসার জায়গা।
আমি ১৯৭৮ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কথা বলছিলাম। জিয়াউর রহমানের শাসনামল। বঙ্গবন্ধু নেই আজ তিন বছরের বেশি হয়েছে। কেবল যে বঙ্গবন্ধু বেঁচে নেই তাই নয়, বঙ্গবন্ধু সারাবাংলার কোথায়ও নেই। এমনকি পত্রিকার পাতাতেও নেই। রেডিওতে নেই। সব জায়গায় বাংলার মহানায়ক নিষিদ্ধ। ব্লাকআউট। যেন তাঁর নাম মুখে আনা রাষ্ট্রদ্রোহীতা। মঞ্জুভাই রাষ্ট্রদোহী কাজ করে ফেললেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাজিয়ে ফেললেন!
এলাকার উঠতি বয়সের জিয়াপ্রেমী যুবকের চিৎকার চেঁচামেচীতে অনুষ্ঠান পন্ড হবার পালা। ভাষণ বাজানো বন্ধ করতেই হবে। নচেৎ অনুষ্ঠানই সে বন্ধ করে দেবে। স্মৃতির পাতায় আজো জ্বলজ্বল করছে সেই অনাকাঙ্খিত বিকেলের কথা। আজ এত বছর পরে তাঁকেই যখন মুজিব কোর্ট গাঁয়ে এলাকার আওয়ামীলীগের নেতৃত্ব দিতে দেখি তখন হাসি। চুপচাপ হাসি বলে আমার হাসি সে টের পায় না। কিন্তু তাঁদের মত নব্য আওয়ামীলীগারদের দাপট এলাকাবাসী হাঁড়ে হাঁড়ে টের পায়।
টের পায় কোমলমতি শিক্ষার্থীবৃন্দ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দাবীদার এসব বর্ণচোরাদের উদ্দেশ্যমূলক নিস্ক্রিয়তায় দেশের অনেক অনেক স্কুল কলেজ থেকে সব দিবস উঠে গেছে। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস আর শহীদ দিবস তথা ভাষা দিবসে এখন স্কুল কলেজ বন্ধ থাকে। সুনসান নিরবতায় আচ্ছন্ন থাকে পুরো গ্রামবাংলার হাটবাজার। এমনকি দিবসগুলোর আগের দিন বা পরের দিনও কোন আয়োজন থাকে না, প্রোগ্রাম হয় না। নির্জনতায় নীরবে দাঁড়িয়ে গুমরে কাঁদে অধিকাংশ শিক্ষাঙ্গনের পবিত্র শহীদ মিনার।
চেতনার সরকার ক্ষমতায় থাকার পরেও এমনি করে দিনে দিনে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মন থেকে খুব কৌশলে মুছে ফেলা হচ্ছে বাঙালীর চেতনা। মুছে ফেলা হচ্ছে ভাষা আর স্বাধীনতার গৌরবময় ইতিহাস। আজকের শিক্ষার্থীরা জানে না ভাষা দিবসের প্রভাত ফেরী কাকে বলে। জানে না, খালি পায়ে শীতের ভোরে হাতে ফুল নিয়ে মিছিল করে কিভাবে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে হয়। কিভাবে দলবেঁধে কোরাসে গাইতে হয়, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি! আমি কি ভুলিতে পারি!!