Home বাণিজ্য ও অর্থনীতি অবৈধভাবে চাল মজুত করেছে বড় ছয় প্রতিষ্ঠান

অবৈধভাবে চাল মজুত করেছে বড় ছয় প্রতিষ্ঠান

42

ডেস্ক রিপোর্ট: চালের অবৈধ মজুতদারদের ধরতে রাজধানীসহ সারা দেশে গতকালও সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েছে সরকার। এ অভিযানে স্কয়ার-এসিআইসহ বড় বড় প্রতিষ্ঠানের চালের মজুত সংশ্লিষ্টতা বেরিয়ে এসেছে। বেশ কয়েক জায়গায় নামিদামি করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর মজুত করা চালের অস্তিত্ব পেয়েছেন অভিযানকারীরা। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সরাসরি বলেছেন, ছয়টি কোম্পানি অবৈধভাবে চাল মজুত করছে। এ সময় তিনি কয়েকটি কোম্পানির নামও উল্লেখ করেন।

বুধবার সারা দেশে চলা অভিযানে বিপুল পরিমাণ চাল উদ্ধার করা হয়। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় মজুতটি ছিল দিনাজপুরের চোহেলগাজীতে স্কয়ারের গুদামে। সেখান থেকে প্রায় ৫ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন চাল জব্দ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি মাত্র ১৫৬ মেট্রিক টন চাল মজুতের অনুমতি নিয়েছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, চালের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে যারা বাজার অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা করছে তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না। গত সোমবার মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে বোরোর ভরা মৌসুমে চালের দাম এত বেশি কেন? তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরই খাদ্য মন্ত্রণালয়সহ প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। গতকাল রাজধানীসহ সারা দেশে বড় বড় মিল ও প্রতিষ্ঠানের গুদামে অভিযান চালানো হয়।

আমাদের দিনাজপুর প্রতিনিধি মতিউর রহমান জানান, দিনাজপুরের চোহেলগাজীতে স্কয়ারের গুদামে ভ্রাম্যমাণ আদালত গত মঙ্গলবার সারারাত অভিযান চালায়। দিনাজপুরের কোতোয়ালি থানার ওসি মোজাফ্ফর হোসেন জানান, স্কয়ারের গুদামে অনুমতির অতিরিক্ত চালের মজুত পাওয়ায় সদর খাদ্য নিয়ন্ত্রক চিত্তরঞ্জন সিংহ বাদী হয়ে মামলা করেছেন। মামলার তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্কয়ারের বৈধ অনুমতি রয়েছে ১৫৬ টন চাল রাখার। কিন্তু অভিযান চালিয়ে ৫ হাজার ৪০০ টনের বেশি চাল পাওয়া গেছে। এই অতিরিক্ত চাল মজুতের জন্য স্কয়ারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

জরিমানা করা হয়েছে দেশের আরেক বড় প্রতিষ্ঠান এসিআইকেও। নওগাঁ প্রতিনিধি তন্ময় ভৌমিক জানান, নওগাঁয় মহাদেবপুর উপজেলার সরস্বতী বাজার এলাকায় এসিআই ফুডস লিমিটেড রাইস ইউনিটে মেয়াদের অতিরিক্ত সময় ধরে ৫০০ টন ধান মজুত করায় তাদের ৮০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। বুধবার বিকেলে নওগাঁ জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট আরাফাত হোসেন এ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন। প্রসঙ্গত, কিছুদিন আগেও এসিআই ফুডস লিমিটেড রাইস ইউনিটে একই অভিযোগে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

গতকাল অভিযান পরিচালনা করা হয় নারায়ণগঞ্জর সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার নিতাইগঞ্জে। নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি হাবিবুর রহমান বাদল জানান, নিতাইগঞ্জের পরশমনি রাইজ এজেন্সি, সবুজ ট্রেডিং ও এক কে রাইজ এজেন্সিতে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিপ্তি অদিতি ইসলামের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় চাল আমদানি, বিক্রিমূল্য রশিদ ও মজুতের পরিমাণ মনিটরিং করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এ সময় আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করেন তিনি। ব্যবসায়ীরা জানান, গত কয়েক সপ্তাহে মিল মালিকরা প্রতি বস্তায় চালের দাম ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা বাড়িয়েছে। খুচরা বাজারে চালের কেজিপ্রতি ছয় থেকে আট টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। মিল মালিকদের কাছ থেকে চাল পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। চাল ব্যবসায়ী শাকিল আলী বলেন, ‘এই সময়ে চালের দাম কমার কথা। কারণ বাজারে নতুন চাল আসে। কিন্তু এবার উলটো দাম বেড়ে যাচ্ছে।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চাল ব্যবসায়ী বলেন, ‘মিল মালিকরা নানা অজুহাতে চাল দেওয়া কমিয়ে দিয়েছে।’

চট্টগ্রাম অফিস জানিয়েছে, চট্টগ্রামে চালের দাম বৃদ্ধি ও মজুত করার দায়ে চার আড়তদারকে অর্থদণ্ড ও একটি আড়ত সিলগালা করেছে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। গতকাল নগরীর পাহাড়তলি চালের বাজারে এ অভিযান পরিচালনা করেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার উমর ফারুক। অভিযানে মেসার্স বাগদাদ ট্রেডিংকে ২০ হাজার টাকা, মেসার্স শাহজালাল স্টোরকে ১০ হাজার টাকা, বিসমিল্লাহ ট্রেডার্সকে ২ হাজার টাকা, মেসার্স রাইস হাউজকে ১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ফুড গ্রেইন লাইসেন্স না থাকার কারণে আমেনা ট্রেডার্সকে সিলগালা করা হয়।

এদিকে গতকাল রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানাধীন কাজলা ও কলাপট্টি এলাকায় অভিযান পরিচালনা করেন ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরে ঢাকা জেলা কার্যালয়ের অফিস প্রধান মো. আব্দুল জব্বার মন্ডল এবং প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. শরিফুল ইসলাম। অভিযান পরিচালনাকালে চালের মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করা, মূল্য তালিকায় প্রদর্শনকৃত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে চাল বিক্রি করা, ক্যাশ মেমো সংরক্ষণ না করা, পূর্বের দরে ক্রয়কৃত চালে এক দিনের ব্যবধানে মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করা ইত্যাদি অপরাধে কাজলা এলাকার কুতুবদিয়ার মেসার্স মুছা রাইস এজেন্সিকে ৫০ হাজার টাকা, মেসার্স খাদ্য ভান্ডারকে ৫০ হাজার টাকা, মেসার্স কাজী ট্রেডার্সকে ২০ হাজার টাকা এবং কলাপট্টি এলাকার মেসার্স হাজী নয়ন ট্রেডার্সকে ৫০ হাজার টাকা এবং মেসার্স করিম রাইস এজেন্সিকে ৫০ হাজার টাকাসহ পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে সর্বমোট ২ লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

গতকাল সচিবালয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিজেও বাজার মনিটর করছেন। যারা মজুত করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আওয়ামী লীগের কেউ হলেও তাকে ছাড় দেওয়া হবে না। তিনি জানান, এসিআই, স্কয়ারসহ ছয়টি গ্রুপের চালের মজুত পাওয়া গেছে। স্কুলের শিক্ষকদের কাছেও চালের মজুত পাওয়া গেছে। আমি কোনো চালের ব্যবসা করি না, এটা স্পষ্ট। তিনি বলেন, যারা মজুতদার তাদের কোনো দল নেই। মজুতদাররাই আলাদা একটা দল। আমি তো নির্দেশ দিয়েছি ১৯৭৪ এর স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্টে মজুতদারদের বিরুদ্ধে মামলা করতে। দেশে চালের কোনো সংকট হবে না উল্লেখ করে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, যদি হয় তাহলে আমদানি করতে হতে পারে। প্রয়োজনে শুল্ক কমিয়ে চাল আমদানি করে ভোক্তাকে স্বস্তিতে রাখা হবে। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, বোরোর ভরা মৌসুমে চালের সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই, কিন্তু কেন চালের দাম বাড়ছে? এটা ব্যবসায়ীদের কারসাজি। মন্ত্রী বলেন, ছয়টি প্রতিষ্ঠান ব্যাগিং করে একই চাল যেটা ৬০ থেকে ৬৫ টাকা পড়ছে, সেটা প্যাকেটজাত করে ৮০ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি করছে। একই সঙ্গে আগাম টাকা মিলারদের দিয়ে আসছে, এমনকি প্যাকেটও দিয়ে আসছে নওগাঁ, দিনাজপুর, বগুড়া ইত্যাদি স্থানে। তিনি বলেন, একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, এই যে বিপুল পরিমাণ চাল যখন এরা তুলে নিচ্ছে, প্যাকেট করতে লাগে তিন টাকা, বিক্রি করছে ১০ টাকা ১৫ টাকা বেশি দামে। এর জন্য তাদের বেশি দামে কিনে আনতেও সমস্যা নেই। এ কারণে যারা এদের কাছে চাল বিক্রি করছে তারা বাজারের ধানটাও প্রতিযোগিতা করে কিনছে। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, দেশের বাজার থেকে চাল কিনে প্যাকেটজাত করে তা আবার বিক্রি করা যাবে না। এজন্য একটি সাকু‌র্লার জারির চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।

অবৈধ মজুতদারদের ধরতে এখন সারা দেশে অভিযান চলছে জানিয়ে সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, দিনাজপুরে দেশের বড় একটি শিল্প গ্রুপের মিলের যে পাক্ষিক ক্ষমতা দেওয়া আছে সর্বোচ্চ এর তিন গুণ তারা মজুত করতে পারবে। একটি বাজারে যাবে, একটি উৎপাদনে যাবে, আরেকটি মজুত থাকবে। সেটার পরও প্রায় ৫ হাজার টন চাল উদ্বৃত্ত ছিল। এটাকে সিলগালা করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। তাদের মালামাল জব্দ করা হয়েছে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে তিনি জানান। এ সময় খাদ্যমন্ত্রী বলেন, অনেকে বলার চেষ্টা করছেন বৃষ্টিতে ও বন্যায় ফসলের ক্ষতি হয়েছে, আসলে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা জানতে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত তাদের কাছে যে তথ্য এসেছে, তাতে দেখা গেছে, অতি বৃষ্টি, ঝড় ও পাহাড়ি ঢলে মোট ৭৮ হাজার ৯৮৭ টন চাল নষ্ট হয়েছে। তবে বাস্তবে এই ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি হবে বলে সূত্রটি মনে করছে। এ বছর ২ কোটি ১১ লাখ ৫৭ হাজার ৮৬৩ টন চাল উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা গত বছর ছিল ২ কোটি ৮ লাখ ৮৫ হাজার ২৬৩ টন। তাই এখন পর্যন্ত ঝড়, বৃষ্টিতে যে পরিমাণ ফসল নষ্ট হয়েছে তাতে মোট চাল উৎপাদনে বড় ধরনের কোনো প্রভাব পড়বে না। কিন্তু একটি অসাধু ব্যবসায়ী চক্র চালের বাজার অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা করছে। অবৈধ মজুতদারদের ধরতে অভিযানের পাশাপাশি খাদ্য মন্ত্রণালয়ে একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। অবৈধ মজুতের তথ্য জানাতে কন্ট্রোল রুমের +৮৮০২২২৩৩৮০২১১৩, ০১৭৯০-৪৯৯৯৪২ এবং ০১৭১৩-০০৩৫০৬ নম্বরে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানানো হয়েছে ।ইত্তেফাক