Home জাতীয় অবহেলা আর বঞ্চনার বৃত্তে বন্দি যাদের জীবন

অবহেলা আর বঞ্চনার বৃত্তে বন্দি যাদের জীবন

50

ডেস্ক রিপোর্ট: চা-শ্রমিকদের জীবন নিরন্তর সংগ্রামের। এই লড়াই রুটিরুজির, এই সংগ্রাম কোনো রকমে বেঁচে থাকার। দুমুঠো ভাতের জন্য আমৃতু্য লড়াই করাটা যেন তাদের নিয়তিতে বাঁধা। এই জীবনে একঝলকের জন্য ধরা দেয় না হাসি-আনন্দ, পূর্ণতা, প্রাপ্তি। তাদের দুর্দশার ইতিহাস আর বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে বিভিন্ন চা-বাগান প্রতিষ্ঠার ইতিহাস একই সমান্তরালে এগিয়েছে। এরই মধ্যে ইতিহাসের নানা বাঁক বদল হলেও, চা-শ্রমিকদের জীবনমান যেখানে ছিল, সেখানেই রয়ে গেছে। অবহেলা আর বঞ্চনার বৃত্তে আটকে আছে চা-শ্রমিকদের জীবনচক্র।

তত্কালীন ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে চা-শ্রমিকদের এই অঞ্চলে নিয়ে আসে। জানা যায়, ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়া চা-বাগানে সর্বপ্রথম চায়ের বাণিজ্যিক আবাদ শুরু হয়। এতে অনেকটা সফলতা পাওয়া গেলে ক্রমেই ব্রিটিশরা বিভিন্ন স্হানে অসংখ্য চা-বাগান সৃষ্টি করে বিনিয়োগ শুরু করে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে অতিদরিদ্র চাষিদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে চা-শ্রমিক হিসেবে আনা হয় সিলেটে। ব্রিটিশরা তাদের দেখিয়েছিল উন্নত জীবনের স্বপ্ন। শুধু ছলনা দিয়ে নয়, অনেককে আবার রাষ্ট্রযন্ত্রের ভয়-ভীতি দেখিয়েও এ কাজে আসতে বাধ্য করেছে তারা।

বাংলাদেশে চা-শ্রমিকদের অধিকাংশই এসেছেন ভারতের বিহার, ওড়িশা, মাদ্রাজ, অন্ধ্র প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন দুর্ভিক্ষপীড়িত এলাকা থেকে; যাদের বেশির ভাগই ছিলেন গরিব, নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত।

সর্বস্ব ত্যাগ করে ভারত ছেড়ে এ দেশে এসে চা-শ্রমিকেরা যখন বুঝতে পারলেন তাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে; তাদের বাগানমালিকের কাছে বিক্রি করা হয়েছে; তখন তারা নিজেদের ভাগ্যের পরিহাস মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে জীবন রক্ষার নতুন লড়াইয়ের মুখোমুখি হন তারা। চা-বাগান তৈরির জন্য গহিন জঙ্গল পরিষ্কারের কাজে নিয়োজিত এসব চা-শ্রমিকের অনেকেই বন্যপ্রাণীর আক্রমণে কিংবা নানা রোগব্যাধি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়সহ নানা দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। ফলে অনেকে বাগান ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তখন ব্রিটিশ সরকারের নতুন আইনের মাধ্যমে ঘোষণা করা হয়, কোনো শ্রমিক বাগান থেকে পালিয়ে গেলে তাকে কোনো পরোয়ানা ছাড়াই বন্দি করে রাখতে পারবেন বাগানমালিকেরা। মারধর করা, আটকে রাখা বা অপহরণ করাকে একরকমের আইনি বৈধতা দেওয়া হয়। ব্রিটিশ সরকারে বিরুদ্ধে যখন অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়, তখন এই অমানবিক পরিবেশে অতিষ্ঠ হয়ে চা-শ্রমিকেরা তাদের জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নেন।

১৯২১ সালের ২০ মে চা-শ্রমিকেরা তাদের জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সিলেট ও আসামের বিভিন্ন বাগান থেকে চাঁদপুরের মেঘনাঘাটে জড়ো হন। সেখান থেকে স্টিমারে করে গোয়ালন্দে পৌঁছে ট্রেনে করে তারা জন্মভূমিতে ফিরতে চান। তখন ইউরোপিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশন ও স্হানীয় ম্যাজিস্ট্রেট তাদের বাধা দেন। এ সময় তাড়াহুড়ো করে স্টিমারে উঠতে গিয়ে পদদলিত হয়ে অনেকের মৃতু্য হয়। অন্য যারা ছিলেন, তারা আর বাগানে না ফিরে চাঁদপুরে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সেখানে তাদের মধ্যে কলেরা ছড়িয়ে পড়ে। তখন সরকার কলেরা ঠেকানোর নামে বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করে। রাতের বেলায় গুর্খা সৈন্যরা তাদের ওপর হামলা করে এবং গুলি চালায়। এতে প্রায় ৩০০ চা-শ্রমিক নিহত হন। এর পর থেকে আর কখনোই নিজেদের জন্মভূমিতে ফেরার চেষ্টা করেননি চা-শ্রমিকেরা।

এরপর বিভিন্ন সময়ে চা-বাগানের চাহিদার কারণে সর্দারদের মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে ছোট ছোট দলে এই অঞ্চলের জন্য শ্রমিক নিয়ে আসা হয়। সর্বশেষ ১৯৪৬ সালে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশ থেকে চা-শ্রমিকের একটি দল নিয়ে আসা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর সিলেট ও চট্টগ্রামের চা-শ্রমিকেরা পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যান। এর পর থেকে তাদের বংশধররাই এখনো দেশের চা-বাগানগুলোয় কাজ করে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধেও চা-শ্রমিকেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। যুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সময় এসব চা-বাগানে অবস্হান নিয়েছিলেন। তখন এই চা-শ্রমিকেরা তাদের খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে সহায়তা করেছেন। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর আদেশে এই চা-শ্রমিকেরা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে পরিগণিত হন।

চা বাংলাদেশের জন্য একটি প্রধান অর্থকরী ফসল। বিশ্বের প্রায় ২৫টি দেশে চা রপ্তানি হয় বাংলাদেশ থেকে। চা-শ্রমিকদের প্রত্যক্ষ শ্রমের কারণে চা-শিল্পের মাধ্যমে সচল হয়ে উঠেছে দেশের অর্থনীতি। তবে চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে মালিকপক্ষের কোনো ভূমিকা নেই বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন চা-শ্রমিকেরা।

দেশে চা-শ্রমিকের সংখ্যা দেড় লাখেরও বেশি। অনেক চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে চা-শ্রমিকেরা এখন অনেক সোচ্চার হয়েছেন। নামমাত্র মজুরিতে আর তাদের শ্রম বিক্রি করতে চান না। তাই দৈনিক নূ্যনতম মজুরি ৩০০ টাকার দাবিতে আবারও রুটিরুজির সংগ্রামে নেমেছেন তারা।
ইত্তেফাক