Home মতামত অতএব, সাধু সাবধান!!!

অতএব, সাধু সাবধান!!!

26

সরদার মোঃ শাহীন:

আজকাল দেশের পত্রিকার পাতায় চোখ ফেলা যায় না। চোখ ফেললেই ভন ভন করে মাথা ঘোরা শুরু হয় আর শরীর দুর্বল অনুভূত হতে থাকে। রক্তের প্রেসার নেমে যাবার কারণেই এমনটা মনে হয় বলে আমার ধারণা। হয়তো এ কারণেই লেখাগুলোও ঝাপসা দেখতে শুরু করি। প্রথমে ভাবি, চোখের সমস্যা। চোখের সমস্যা ভেবেই বারবার চোখ মুছি; চশমাটাও মুছি। কাজ হয় না। অবস্থার পরিবর্তন হয় না। চোখ টেষ্ট করার নামে এদিক ওদিক তাকাই। সবকিছু ফকফকা দেখি; স্পষ্ট দেখি।
শুধু বাংলা খবরের পাতায় পরিষ্কার করে কিছু দেখি না। ঝাপসা দেখি। এখানে পাতা বলতে আমি পত্রিকার কাগজের পাতা বলছি না। বলছি মনিটরের কথা। ল্যাপটপের কিংবা মোবাইলের মনিটর। কাগজের পত্রিকা বিদেশে বসে পড়বো কিভাবে? যখন দেশীয় পত্রিকাগুলো অনলাইনে আসেনি তখন দেশ থেকে কাগজের পত্রিকা ডাকে এনে পড়তাম। এখন ডাকে আনতে হয় না। ল্যাপটপের মনিটরে মুহূর্তের মাঝেই তরতাজা সংবাদগুলো পড়ে ফেলতে পারি।
যেটা আগে পারতাম না। আগেও নিয়ম করে রোজ পত্রিকা পড়তাম। কাগজের পত্রিকা। প্রবাসে বসেও পড়তাম। প্রবাসের এই ২৮ বছরে বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকা একদিন পড়িনি বা বাদ পরেছে এমনটা ঘটেনি একবারের জন্যেও। প্রতি সাতদিন পরপর শুক্রবার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে করে দেশের পত্রিকা টোকিওতে আসতো। বিকেলে হাতে পেয়ে সব কিছু ফেলে গোগ্রাসে গিলতাম পত্রিকার খবরগুলো। সাত দিনের পুরানো খবর। তাতে কি! আমার কাছে তো নতুন! নতুন নতুন খবরগুলো না ঘুমিয়ে পড়ে শেষ করে ফেলতাম প্রথম রাতেই।
নিয়ম করে পত্রিকা পড়ি কেবল এই ২৮ বছর ধরেই নয়। গেল ৫২টি বছর ধরেই পড়ি। ক্লাস ওয়ান থেকে পত্রিকা পড়া বাধ্যতামূলক করে দিয়েছিলেন আমার আব্বা এবং গৃহশিক্ষক। তাই কিছু বুঝতাম বা না বুঝতাম, পত্রিকা পড়তেই হতো। ব্যাপারটি এমন ছিল না যে মাঝেমধ্যে পড়লেই হবে। নিয়ম ছিল রোজকার পত্রিকা রোজই পড়তে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটেনি জীবনে একবারের জন্যেও, একদিনের জন্যেও।
আজ জীবনের এতটা বছর পেরিয়ে খুব শক্ত করেই বলতে পারি, গেল ৫২টি বছরে বাংলাদেশে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকার আমি নিয়মিত পাঠক। ভুল করেও কোন একদিনের পত্রিকা বাদ পড়েনি এই জীবনে। আর শুধু যে দৈনিক একটি মাত্র পত্রিকা পড়ি, তাই নয়। অনলাইনের সুযোগে এমন কোন দিন যায় না, যেদিন অন্তত দশটা পত্রিকা পড়া হয় না। বেশিও পড়া হয়। অনেকেই অনেক ভাবে অবসর কাটায়। আমি কাটাই পত্রিকা পড়ে।
পত্রিকা পড়ার এই পোকা আমি বাংলাদেশের পত্রিকা দেখলেই আজকাল ভয় পাই। আজকাল পাতার পর পাতা জুড়ে শুধু নেতিবাচক খবরের ছড়াছড়ি। ভয়ানক আতঙ্কগ্রস্ত সব খারাপ সংবাদে ভরা। এমন কোন সমস্যা নেই, যা পাতাজুড়ে নেই। এত্ত এত্ত খারাপের ভীড়ে ভাল সংবাদ খুঁজে পাওয়াই কঠিন। ছাপানোর মত ভাল সংবাদ থাকলেও এসব ছাপাতে কোথায় যেন অনীহা আছে পত্রিকাগুলোর। সবাই যেন খারাপের দিকে ছুটছে। খারাপ সংবাদের দিকে ছুটছে।
নিউজের সত্যমিথ্যার দিকে ছুটবো না আমি। ওসব যাচাই বাছাই করার যোগ্যতা আমার নেই। তবে বিশ্বাস আছে। বিশ্বাসটি ঠিক এই রকম; সব নিউজই যেমন সত্য নয়; ঠিক তেমনি সব নিউজ মিথ্যেও নয়। কিন্তু সত্যমিথ্যার বিশ্লে−ষণে না যেয়েও চোখ বুজে বলা যায়, শুধুমাত্র খারাপ সংবাদে ছেয়ে গেছে বর্তমান বাংলাদেশ। বাংলাদেশ নিজেই হয়ে উঠেছে খারাপ সংবাদের প্রতিক। দেশে কিংবা বিদেশে, সবখানেই বাংলাদেশ এখন সংবাদ।
বহির্বিশ্বের পূর্ব থেকে পশ্চিমে কিংবা উত্তর থেকে দক্ষিণে, সবাই যেন মেতে উঠেছে বাংলাদেশকে নিয়ে। জাপান থেকে লন্ডন, লন্ডন থেকে নিউইর্য়ক। সব জায়গার সব পত্রিকায়ই বাংলাদেশের সংবাদ। এটা সত্যি, দেশি-বিদেশি কেউ না কেউ, কোন না কোন গোষ্ঠী এসব প্রমোট করছে। বিনিয়োগ করছে। এসবে যত না বিদেশিরা সরব, তারচেয়ে অনেক বেশি সরব বিদেশে থাকা দেশের মানুষেরাও। তারাই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বিদেশিদের মুখ দিয়ে কথা বের করে আনছে।
প্রায় প্রতিদিনই আনছে। আতঙ্কিত হবার মত সে সব কথা; সে সব নেগেটিভ নিউজ। এসব করে তারা আর কিছু পারুক বা না পারুক, “কঠিন অনিশ্চয়তার মুখে বাংলাদেশ”তকমাটা ইতিমধ্যে বেশ ভালভাবেই বসাতে পেরেছে। সত্যি বলতে, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দায় দেশের মানুষ যতটুকু না খারাপ আছে, মানসিক চাপে আছে; তারচেয়ে ঢের বেশি আছে এইসব নিউজ পড়ে পড়ে এবং শুনে শুনে।
নিউজ আইটেমের কোন অভাব নেই। হরেক রকমের নিউজ। কোনটা রেখে কোনটা বলবো। জিনিসপত্রের মূল্যে উর্ধ্বগতি; লাগামহীনতা। সকালের দশ টাকার মাল বিকেলে ৩০ টাকা। বিশেষ বিশেষ পণ্যের দামে হঠাৎ হঠাৎ আগুন লাগা। আগের দিনে চাল ডালে কিংবা আটা ময়দায় আগুন লাগতো। এখন লাগে কাঁচা মরিচেও। বাকী ছিল ডিম। ওটাও বাদ যায়নি। পেঁয়াজ আর তেল-নুনের কথা নাই বা বললাম।
সমস্যার অন্ত নাই দেশে। মানুষের জীবন নাভিশ্বাস। এদিকে রেমিটেন্সে মন্দা, রফতানী আয় কমতির দিকে। বৈদেশিক রিজার্ভে ধ্বস। কোনভাবেই রিজার্ভ ধরে রাখা যাচ্ছে না। তাই বাড়ছে ডলারের দাম। কথায় কথায় ডলার বারবার ষ্ট্রং হচ্ছে। বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ আসছে সামনে। অথচ রিজার্ভ পরিমিত পরিমাণে নেই বলে সে সব ঋণ পরিশোধ কষ্টসাধ্য হবে। বিদ্যুত উৎপাদনের কয়লা থাকে না মাঝেমধ্যেই। বিদ্যুতও আসা যাওয়া করে।
আসা যাওয়া করে বিদেশিরাও। ঘন ঘন করছে। মিটিং সিটিং তারাও বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুন। তাদের দাবিও পরিষ্কার। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক টানাপোড়েন যতই থাকুক, এসব নিয়ে তাদের কোন দাবী দাওয়া নেই। কোন মাথা ব্যথাও নেই। তাদের মাথা ব্যথা অন্য জায়গায়। তাদের সাফ কথা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে। সেই মত যদি গুজবও হয়। পাশাপাশি থাকতে হবে গণতন্ত্র এবং হতে হবে সুষ্ঠ নির্বাচন।
গণতন্ত্র এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের ইস্যুতে আমার অভিমতও তাদের মতই। রাষ্ট্র যেহেতু আমার, তাই ভোটাধিকার আমার থাকতেই হবে। এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার অধিকার সংবিধান কাউকে দেয়নি। আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব। এটাই আমার অধিকার। এই অধিকারটুকু আমি বুঝি। কিন্তু ওরা যখন এসে মানবাধিকারের কথা বলে, সেটা আমি বুঝি না। আমার মাথায়ও আসে না।
মাথায় আসে না, কেননা যারা আমাদের এই অধিকার নিয়ে বিশ্ব সরগরম করছে, তারা কি নিজেরা আমাদেরকে সেই অধিকারটুকু দিয়েছে? আমি কি চাইলেই তাদের দেশে ভ্রমণে যেতে পারি? পারি না। কিন্তু তারা আসতে পারে। ভিসা ছাড়া চাইলেই আসতে পারে। অথচ আমার ভিসা লাগে। কিন্তু চাইলেই কি আমি ভিসা পাই? অ্যাম্বাসীতে গেলেই কি আমায় ভিসা দেয়? দেয় না। দিলেও পানিতে চুবিয়ে তারপর দেয়।
সাথে দেয় প্যারা। আর দেয় অসম্মান। কোর্টের আসামীদেরকে পুলিশ যে অসম্মান করে, ভিসা প্রার্থীদেরকে অ্যাম্বাসীর সিকিউিরিটি এরচেয়েও বেশি অসম্মান করে। বাজে আচরণ করে। চিপার মত ছোট্ট ঘরে নিয়ে আটকে রাখে। এটাই তো ওদের কাছ থেকে পাওয়া বাঙালির অধিকার! মানবাধিকার!! আসলেই কি বাঙালির অধিকার আছে? মোটেও নেই। না আছে ওদের দূতাবাসে, না আছে জাতিসংঘে। জাতিসংঘ তো চালায় ক্ষমতাধর ভেটো পাওয়ারসম্পন্ন পাঁচ রাষ্ট্র। সব মানবাধিকার তো কেবল ওদের।
আজকাল সেই ওদের কাছ থেকেই নিতে হয় মানবাধিকারের সবক। শুনতে হয় মানবাধিকারের গীত। আর সে সব গীত শুনে দেশীয় যারা ধীন ধীনা ধীন তালে নেচে ওঠে, তারা জানে তো ওদের দেশে তাদের মানবাধিকারের দৌঁড়? এটা জানার জন্যে ওসব দেশের পাঁচ তারকা হোটেলে একরাত থাকলেই যথেষ্ঠ। হোটেল যত তলারই হোক, বাংলাদেশী পাসপোর্টে তারা পাঁচ তলার উপরে জিন্দিগীতেও থাকতে পারবে না। গত ২৮ বছরে আমি একবারও পারি নাই।
পারি নাই শুধু ওদের দেশেই নয়। হজ্বযাত্রায়ও পারি নাই। হজ্বযাত্রায় মিনা কিংবা আরাফাতে রাত্রি যাপন করে দেখুন না! বাংলাদেশি হয়ে বুঝবেন আপনার অধিকারের সীমানা। বুঝবেন আপনার মানবাধিকার। সোমালিয়ান, ইথিওপিয়ান, পাকিস্তানী আর সুদানীদের সাথে থাকতে থাকতে বুঝবেন মানবাধিকার কাহাকে বলে। পারলে ওদের একটু বলে দেখবেন আপনার অধিকারের কথা; জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদের কথা। চক্ষুটা লাল করে ওরা কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দেবে আপনাকে! আপনার মানবাধিকারের হারিকেন আপনার হাতেই ধরিয়ে দেবে!! অতএব, সাধু সাবধান!!!

-লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা ডট কম।