Home মতামত বাঙালির তিন বিশ্বসমর নেতা

বাঙালির তিন বিশ্বসমর নেতা

324

জিয়াউল হক মুক্তা*

বাঙালির নাকি সামরিক অভিজ্ঞতা নেই। যদিও ইতিহাস বলে বাঙালি যে কেবল স্থানীয় ও আঞ্চলিক সমর-অভিজ্ঞতাঋদ্ধ তাই নয়, বাঙালি সাফল্যের সাথে বিশ্বযুদ্ধের মতো বৈশ্বিক সামরিক অভিজ্ঞতা ও ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। যে তিনজন বাঙালি বিশ্বরাজনীতি, যুদ্ধ ও শীতল যুদ্ধকে ব্যবহার করেছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের জাতিসমষ্টি ও বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য, সে মহতিগণ হলেন— রাসবিহারী বসু ও সুভাষ চন্দ্র বসু পুরোমাত্রায়, আর সামান্য পরিমাণে হলেও তাজউদ্দীন আহমদ।

রাসবিহারী বসু (২৫ মে ১৮৮৬ — ২১ জানুয়ারি ১৯৪৫) ইউনাইটেড স্টেটস অব ইন্ডিয়ার স্বাধীনতার জন্য এক্সপ্লোর করেছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪—১৯১৭) ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯—১৯৪৫)। ১৯১২ সালের ২৩ ডিসেম্বর রাজা পঞ্চম জর্জের অভিষেকের দিন ভারতে বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জকে হত্যাপ্রয়াস ও আরও বেশ কিছু সশস্ত্র তৎপরতা পরিচালনা করার পর— ১৯১৫ সালে আন্তর্জাতিক যোগসাজসে তাঁর নেতৃত্বে ব্রিটিশ সরকার উৎখাতের ঐতিহাসিক গদর বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে তিনি জাপান পালিয়ে যান। পরবর্তীতে গঠন করেন ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ ও ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি। কাজ করেন বিশ্বব্যাপী। ১৯৪২ সালে তিনি জার্মানিতে অবস্থানরত নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুকে আহ্বান জানান ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির দায়িত্ব নিতে।

সুভাষ চন্দ্র বসু (২৩ জানুয়ারি ১৮৯৭ — ১৮ আগস্ট ১৯৪৫) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কারাগার থেকে গৃহে অন্তরীণ থাকার সময় ১৯৪১ সালের ১৭ জানুয়ারি রাতে ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের চোখে ধূলো দিয়ে দুর্গম পাহাড়ি পথে আফগানিস্তান পালিয়ে যান। সেখান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন গিয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পক্ষে তাদের সহায়তা মবিলাইজ করতে ব্যর্থ হয়ে— ইটালিয়ান সরকারের সহায়তায় জার্মানিতে গিয়ে গঠন করেন আজাদ হিন্দ ফৌজ ও সবশেষে জাপানের সহায়তায় পরিচালনা করেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রাম। রাসবিহারী বসুর আমন্ত্রণে তিনি একটানা তিন মাস ধরে মহাসাগরতলদেশ ভ্রমণ করে— ১৯৪৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জার্মানি থেকে সাবমেরিন যাত্রা শুরু করে ৬ মে সাবান বন্দর হয়ে— ১৬ মে প্লেনে টোকিও পৌঁছান। এরপর তিনি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা আজাদ হিন্দ ফৌজের মাধ্যমে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা করেন।

তাজউদ্দীন আহমদ (২৩ জুলাই ১৯২৫ — ৩ নভেম্বর ১৯৭৫) এর বিষয়টি বেশ অম্লমধুর। তিনি কোন বিচারেই রাসবিহারী বসু বা সুভাষ চন্দ্র বসুর সমকক্ষ নন— তবুও তাঁর বিচক্ষণতা ভারতের ইন্দিরা গান্ধী সরকারকে শীতল যুদ্ধকালীন বৈশ্বিক ভূরাজনীতিক আবহকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে পরিণতিতে পৌঁছে দিতে সক্ষম করেছিল। একাত্তরের ২৫ মার্চের পর তাজউদ্দীন আহমদ ভারত পৌঁছানোর আগেই সেসময়কার যশোর আওয়ামী লীগের স্বাধীনতাপন্থি নেতা ও পরবর্তীকালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এডভোকেট মোশাররফ হোসেন (৭ মার্চ ১৯২৫ — ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪) ২৭ মার্চ ভারতের বনগাঁ পৌঁছান এবং এখান থেকে পশ্চিম বাংলার মন্ত্রী ও পরবর্তীকালের মূখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের সহযোগিতায় ৩১ মার্চ বা ১ এপ্রিল ইন্দিরা গান্ধির সাথে দেখা করে শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত খুলে দেয়া, শরণার্থী ক্যাম্প চালু করা ও মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা দানের ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীকালে এডভোকেট মোশাররফ হোসেনের সাথে ইন্দিরা গান্ধির বন্ধুত্ব পারিবারিক পর্যায়ে উপনীত হয়।

তাজউদ্দীন আহমদ ৩১ মার্চ ভারত পৌঁছান, ২ এপ্রিল দিল্লি পৌঁছান ও ৪ মার্চ ইন্দিরা গান্ধির সাথে দেখা করেন। তিনি— (১) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া সুস্পষ্ট নির্দেশ উপেক্ষা করে, (২) ভারতের রাজনীতি ও প্রশাসনে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ইমপ্লান্টেড চিত্তরঞ্জন সুতারের সাথে কলকাতায় দেখা না করে, (৩) মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বঙ্গবন্ধু কর্তৃক মনোনীত চার যুবনেতাকে উপেক্ষা করে, (৪) বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও বাংলাদেশ সরকার বিষয়ে ভুল তথ্য প্রদান করে— ইন্দিরা গান্ধিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন। সর্বশেষ কারণে ইন্দিরা গান্ধি পরবর্তীতে মুজিবনগরের বাংলাদেশ সরকারের পুরো মন্ত্রিসভাকে বকাঝকাও করেন। সে যাক।

ভূরাজনীতিগত দিক থেকে পাকিস্তানের পক্ষে ছিল আমেরিকা ও চিন। ভারতের পক্ষে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। ভারতীয় কর্মকর্তা ডিপি ধর-এর চাপে তাজউদ্দীন আহমদ বাধ্য হন মাস্কোভাইট ও পিকিঙাইটদের নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের কনসালটেটিভ কমিটি বা উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করতে। সেটা ছিল ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। তবে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা এর আগে সুকৌশলে এ কমিটিকে একটি পাপেট কমিটি হিসেবে গঠনতান্ত্রিক রূপ দেন। কনসালটেটিভ কমিটি গঠনের এ কৌশল সোভিয়েত ইউনিয়নকে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য ভূমিকা রাখতে সাহায্য করে।

মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে আমেরিকা তার নাগরিকদের উদ্ধারের নাম করে বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশ অভিমুখে তার ৭ম নৌবহর প্রেরণ করে। অনেকে যা জানেন না বা বলেন না, তা হলো— ব্রিটিশরাও তাদের নৌবহর প্রেরণ করে পাকিস্তানের পক্ষে। বিপরীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের নৌবহর প্রেরণ করে আমেরিকান ও ব্রিটিশ নৌবহরকে ঘিরে ফেললে আমেরিকান ও ব্রিটিশ নৌবহর ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে যায়— বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ বা আক্রমণ করা থেকে তারা পিছিয়ে যায়।

এ তিন বাঙালির ভূমিকা ছাড়াও স্বাধীনতা অর্জনের রণনীতির পক্ষে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বাঙালির তিন পর্যায়ের অগ্নিযুগের সশস্ত্র সংগ্রামের রণকৌশল এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথাগত ও জনযুদ্ধের সমন্বিত রণকৌশলের সাফল্য তো আছেই! সেসব বিষয় ছোট এ নিবন্ধের আলোচ্য নয়।

১৯ জুন ২০২১; মোহাম্মদপুর, ঢাকা।

তথ্যসূত্র:
আমীর-উল ইসলাম (ফেব্রুয়ারি ১৯৯১): মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। কাগজ প্রকাশনা, ঢাকা।

জিয়াউল হক মুক্তা (ফেব্রুয়ারি ২০২১): বাঙালির মহান জাতীয় বীর শহীদ এডভোকেট মোশাররফ হোসেন অমর হোন। ফেইসবুক পোস্ট।

ফয়েজ আহমদ (ফেব্রুয়ারি ২০০৫): এবং তারপর। সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা।

মঈদুল হাসান (ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬): মূলধারাঃ ‘৭১। ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা।

শামসুদ্দিন পেয়ারা (ফেব্রুয়ারি ২০১৯): আমি সিরাজুল আলম খান – একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য। মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা।

শৈলেশ দে (ফেব্রুয়ারি ২০১৪): আমি সুভাষ বলছি। রাবেয়া বুকস, ঢাকা।

  • লেখক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক।
  • *মতামত বিভাগে প্রকাশিত সকল লেখাই লেখকের নিজস্ব ব্যক্তিগত বক্তব্য বা মতামত।