Home মতামত হায়রে আমার মন মাতানো দেশ!!!

হায়রে আমার মন মাতানো দেশ!!!

34

সরদার মোঃ শাহীন:

পত্রিকা আর সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে আজকাল শুধু লেখা আর লেখা। লেখার মানুষের কোন অভাব নেই। যেমনি লেখার মানুষের অভাব নেই। তেমনি নেই বিষয়বস্তুরও অভাব। ঘরে বাইরের সব বিষয়বস্তু নিয়ে অজস্র লেখায় অনলাইন ভরে থাকে। লিখতে গিয়ে কেউ কখনো সংকোচ বোধে ভোগে না। যার যখন যা লিখতে মন চায় টপ্পাশ করে তাই লিখে ফেলে। পাঠক চাহিদার ধার ধারে না।

ধারে না পাঠকের রুচিবোধ বিবেচনারও। কাউকে ধার ধারার কিংবা পরোয়া করার দিন বোধ হয় সারা বাংলায় আর অবশিষ্ট নেই। নেই গুণগত মানসম্পন্ন ভাল লেখার আধিক্যও। তবে সবাই খারাপ লেখে কথাটি যেমনি কোনভাবেই সত্যি নয়, তেমনি সবাই ভাল লেখে সেটাও সত্যি নয়। ঠিক এই রকম ভাল খারাপের ভীড়ে যে ক’জন লেখকের লেখা আমি খুবই আগ্রহ নিয়ে পড়ি, কিংবা পারতপক্ষে মিস করিনা, তারমধ্যে প্রভাষ আমিন একজন।

লেখায় তার প্রচন্ড ধার। তাবেদারী লেখা কখনোই লেখেন না। বিবেক যা বলে ঝটাপট তাই লিখে যান অবিরত। লেখাগুলো কার পক্ষে কিংবা বিপক্ষে যায় সেটা তার লেখনীতে কখনোই পাই না। ইদানীং কালে তিনি এবং তার মত আরো কয়েকজনার (বিশেষ করে আশরাফুল আলম, আমিনুল ইসলাম) লেখার বিষয়বস্তুতে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমার আজকের এই লেখা। বলতে পারেন, তাদের বলা কথাগুলোই আমার নিজের কথায় লিখতে যাচ্ছি মাত্র।

গেল মাসে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে লিখেছেন আশরাফুল আলম। লিখেছেন সফরের ফলাফল কেন্দ্রিক কিছু মানুষের হইহুল্লোর নিয়ে। এদের মাঝে বাঘাবাঘা কলামিস্ট আছেন, আছেন টকশো ব্যক্তিত্বও। তাদের অনেকেই যেমন নিরপেক্ষতার লেবাস নিয়ে বলেন, তেমনি রাজনৈতিক পরিচয়েও বলেন। তাদের সকলের একটাই কমন জিজ্ঞাসা; ভারতকে কী দিলেন আর কী নিয়ে এলেন প্রধানমন্ত্রী। এটা নিয়ে চারিদিকে সে কী আওয়াজ। সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রীয় সফরে হরহামেশাই যান। লন্ডন যান, আমেরিকা যান। কিন্তু কখনোই কাউকে বলতে শোনা যায় না, তিনি কী নিয়ে যান আর কী নিয়ে আসেন।

কেবল ভারত গেলেই আওয়াজ ওঠে। একই গ্রুপের আওয়াজ। পুরো সফরটাকে বিতর্কিত করার চেষ্টায় এই গ্রুপটা ওঁত পেতে থাকে। চেষ্টা করে ফাঁক খোঁজার। অর্থাৎ কোন না কোন ভাবে ইস্যু খোঁজার চেষ্টা করা হয়। বলা যায়, একটা ভাবে থাকে। আশরাফুল আলমের ভাষায়, “সবার ভাবখানা এমন তাদের বাপ- দাদারা ভারতের কাছে ওয়ারেশী পায়, অথবা ছেলে বিয়ে করাইছে, তাই যৌতুক চায়। অথচ পাকিস্তান বিষয়ে তাদের টু শব্দ নেই। হইহুল্লোর নেই। কিন্তু হিসেবের খাতা তো তা বলে না। ১৯৭১ সালের হিসাবেই পাকিস্তানের কাছে আমাদের ন্যায্য পাওনা ৩২ হাজার কোটি টাকা।” পাওনার পরিমাণ ডলারের বর্তমান দরে তিন লাখ ২০ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এই নিয়ে তখনই উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক, কমিটি সবই হয়েছিল। অথচ বঙ্গবন্ধু হত্যাপরবর্তী সময়ে কেবল হয়নি পাওনা আদায়ের সামান্যতম চেষ্টা। পাওনার কথা ইচ্ছে করেই নিজেরা ভুলে গেছে, জাতিকেও মনে রাখতে দেয়নি।

এরাই আমাদের পাকিস্তানপন্থী চতুর দেশীয় রাজনীতিবিদ। তবে পন্থী আরো আছে। ভারতপন্থী আছে। আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, এবং আরবপন্থীরও অভাব নেই। কেবল অভাব বাংলাদেশপন্থীর। বাংলাদেশপন্থী সামান্য কিছু থাকলেও বিদেশপন্থীদের ভীড়ে এরা বড়ই সংখ্যালুঘ। সব সময় মুখে কলুপ এঁটে থাকে। তবে এরা মোটেই বিপদজনক নয়। বিপদজনক হলো সুযোগপন্থীরা। সুযোগপন্থীরা সময়ে সময়ে সুযোগ বুঝে তরিকা বদলায়, রিস্তা বদলায়। বদলায় একটি মাত্র মন্ত্রে; “রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই।” শুধু এই একটি মন্ত্রে এরা কত কিছু যে জায়েজ করে তার কোন ইয়ত্ত্বা নেই।

প্রভাষ আমিন ঠিক এই জায়গাটিতেই লিখেছেন, “যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ধ্বংসের রাজনীতির সূচনা করেছিল জাসদ। থানা লুট, পাটের গুদামে আগুন, ঈদের জামাতে এমপি খুন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় হামলা, ভারতীয় হাইকমিশনারকে অপহরণ চেষ্টার মতো অপরাজনীতি করেছিল জাসদ। এমনকি ৭৫’র ১৫ আগস্টের পর জাসদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে। আসলে জাসদের জন্মই হয়েছিল আওয়ামী বিরোধিতার জন্য।”

তিনি আরো লিখেছেন, “৭২-৭৫ সময়ে জাসদের রাজনীতি যারা দেখেছেন, তারা কি কখনও ভাবতে পেরেছিলেন, জাসদ একদিন আওয়ামী লীগের ক্ষমতার সঙ্গী হবেন। জাসদের আ স ম আব্দুর রব বা হাসানুল হক ইনু শেখ হাসিনার সরকারের মন্ত্রী হবেন। আ স ম আব্দুর রব একসময় ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন, তারপর জাসদের নেতা হয়েছেন। এখনও তিনি জাসদের একটি অংশের নেতা। কিন্তু একজন নেতা তার জীবনে কতবার রূপ বদলাতে পারেন?

আব্দুর রব একসময় বঙ্গবন্ধুর শিষ্য ছিলেন। তারপর বঙ্গবন্ধুর কট্টর সমালোচক ছিলেন। জিয়ার অনুগ্রহে জার্মানিতে উন্নত চিকিৎসা পেয়েছেন। এরশাদের গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা ছিলেন। ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে আসা আওয়ামী লীগের ঐক্যমতের সরকারে মন্ত্রী হয়েছেন। এখন আবার তিনি শেখ হাসিনার কট্টর সমালোচক। মাহমুদুর রহমান মান্না জাসদ করেছেন, বাসদ করেছেন, আওয়ামী লীগ করেছেন। এখন পারলে শেখ হাসিনাকে টেনে নামান।”

এরাই আমাদের নেতা। তথাকথিত আদর্শবাদী নেতা! এরাই আমাদের চালক। আমাদের ভবিষ্যত এদের হাতে। এরাই টেনে টেনে আমাদেরকে উনবিংশ শতাব্দী থেকে একবিংশ শতাব্দীতে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু আজো সঠিক পথের দিশারী হতে পারেননি। পারেননি শিক্ষা ব্যবস্থার একটা গুণগত পরিবর্তন আনতে। পরিবর্তন আনবেন কি, প্রচলিত ব্যবস্থায় শিক্ষার যতটুকু মান আছে সেটারও অবমূল্যায়ন করছে রাষ্ট্র ব্যবস্থা।

রাষ্ট্র ব্যবস্থার দুর্দশা নিয়ে আমিনুল ইসলাম চমৎকার বলেছেন। বলেছেন, “দিন চারেক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী আমাকে লিখেছে, ‘স্যার, অনার্সে ফার্স্ট হয়েও এমফিলে ভর্তি হতে পারছি না শুধু এসএসসির রেজাল্ট ভালো না হওয়ার কারণে।’ আমার সত্যিই জানা নেই- এটা কেমন নিয়ম। কেউ এসএসসির রেজাল্ট খারাপ করেছে তার মানে তো এই না- সে ভবিষ্যতের পরীক্ষায় ভালো করতে পারবে না। ভবিষ্যতের পরীক্ষায় যদি ভালো করে, তাহলে কেন সেগুলো বিবেচনা না করে এসএসসির রেজাল্টই বিবেচনায় আনতে হবে। এর মানে কি দাঁড়ায় জানেন? এর মানে প্রতিষ্ঠান গুলো আমাদের বলে দিচ্ছে- তোমার এসএসসি কিংবা এইচএসসির রেজাল্ট খারাপ মানে তোমার জীবন শেষ।”

তিনি আরো লিখেছেন, “এক ব্যাংকে সার্কুলার দিয়েছে চাকরির। একদম ছোট লেভেলের চাকরি। সেখানেও দেখি লেখা- চারটা ফার্স্ট ক্লাস থাকতে হবে। অর্থাৎ এসএসসি, এইচএসসি, অনার্স, মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস থাকতে হবে। তাহলে যেই ছেলেটা কিংবা যেই মেয়েটা কোনো কারণে এই পরীক্ষাগুলোর একটাতে খারাপ করে ফেলেছে, কিন্তু পরের লেভেলে চেষ্টা করে ভালো রেজাল্ট করেছে তারা কই যাবে? কিংবা তারা পড়াশোনা করার উৎসাহই বা কেন পাবে? তাছাড়া ব্যাংকে চাকরি করার জন্য চারটা ফার্স্ট ক্লাস কেন লাগবে? আজব কান্ড।”

দেশটাই আজব, তাই কান্ডকারখানা তো আজব হবেই। এখানে গুজবের মূল্য আছে, গুণের মূল্য নেই। নেতিবাচকতার মূল্য আছে, ইতিবাচকতার নেই। কূটচালের মূল্য আছে, সরলতার নেই। এখানে সততা সব সময় পরাজিত হয় মিথ্যে আর অসততার কাছে। তাই যতই ভাবি না কেন, আর গাই না কেন গান; হায়রে আমার মন মাতানো দেশ! কোন কাজ হবে না। অভাগা এই দেশটি কোনকালেও মন মাতানো দেশ হবে না।

দেশটা যাদের হাতে, যারাই ঘুরে ফিরে গেল পঞ্চাশটি বছর চালাচ্ছেন, তারা যতদিন প্রকৃত বাংলাদেশপন্থী না হবেন, দেশটা কোনদিনও মন মাতানো দেশ হবে না! হবে না সাধারণের বাস উপযোগী একটি সহজ সুন্দর দেশ!! বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ!!!

-লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা।