Home মতামত স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র গণআন্দোলনের নেতা শহীদ রাউফুন বসুনিয়ার ৩৮তম শাহাদাৎ বার্ষিকী আজ

স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র গণআন্দোলনের নেতা শহীদ রাউফুন বসুনিয়ার ৩৮তম শাহাদাৎ বার্ষিকী আজ

50

সৈয়দ আমিরুজ্জামান |

এরশাদ স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র গণ আন্দোলনের নেতা শহীদ রাউফুন বসুনিয়ার ৩৮তম শাহাদাৎ বার্ষিকী আজ।
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ফেব্রুয়ারি যেন রক্ত স্রোতে আঁকা ও লেখা এক মাস। রক্তের স্রোতে ফেব্রুয়ারিতে বারবার ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। কী আঁকবে আর লিখবে? প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আর না মেনে নেওয়ার ছবি আঁকা হয়েছে এই ফেব্রুয়ারিতেই। বায়ান্নতে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন সালাম, রফিক, জব্বার, সফিউর, সালাউদ্দিন এবং আরও অনেক নাম না জানা শহীদ।
১৯৮২ থেকে ১৯৯০-এর ফেব্রুয়ারি মাসগুলো ক্রমাগত চিহ্নিত হয়ে আছে স্বৈরশাসকের বুলেটবিদ্ধ শহীদের রক্তস্রোতে।
১৯৮৩-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘মজিদ খানের শিক্ষানীতি’র প্রতিবাদে প্রাণ দেন জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দীপালী সাহা, আইয়ুব, মোজাম্মেলসহ নাম না জানা আরও অনেকে।
১৯৮৪-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্র মিছিলে ট্রাক উঠিয়ে দিয়ে হত্যা করা হয় সেলিম এবং দেলোয়ারকে। তারপর ১৯৮৫ এর ১৩ ফেব্রুয়ারি স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মদদপুষ্ট ছাত্র সংগঠন ‘নতুন বাংলা ছাত্র সমাজে’র সশস্ত্র গুণ্ডাদের গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রাণ হারান রাউফুন বসুনিয়া।
শহীদ রাউফুন বসুনিয়া ছিলেন তৎকালীন বাকশাল সমর্থিত সংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক এবং সমাজবিজ্ঞান শেষ বর্ষের ছাত্র।
বসুনিয়া কুড়িগ্রাম জেলার সন্তান। জেলার রাজারহাট উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পাইকপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর পাঙ্গারাণী লক্ষ্মীপ্রিয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শেষ করেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন কারমাইকেল কলেজ থেকে। তারপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। মৃত্যুর সময় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্স এর ছাত্র ছিলেন তিনি।
হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পর ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলেন। যেমন করে ষাটের দশকে গভর্নর মোনেম খান ‘এনএসএফ’ নামক গুণ্ডাতান্ত্রিক ছাত্রসংগঠন গড়ে তুলেছিলেন আইয়ুব খানের সামরিক শাসনকে সমর্থন যোগানোর জন্য। কিংবা শিক্ষাঙ্গনে নিজের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে সরকারী ছত্রছায়ায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল’। ১৯৮৩ সালের ২৭ মার্চ এরশাদও একই পথ অনুসরণ করে ‘নতুন বাংলা ছাত্রসমাজ’ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। ২৪ মার্চ তার সামরিক শাসনের এক বছর পূর্তি হয়েছিল।
প্রথমে তিনি তার সামরিক চক্রের লোকদের দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতে পারবেন বলে ধারণা করেছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকার কৌশল হিসেবে এরশাদ ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলেন, তার পূর্বসূরি আইয়ুব খান এবং জিয়াউর রহমানের মতই। ‘নতুন বাংলা ছাত্রসমাজ’ সামরিক সরকারের এজেন্টদের মাধ্যমে অস্ত্রের সরবরাহ পায়। যেমন করে জিয়াউর রহমানের সরকারী এজেন্টদের মাধ্যমে অস্ত্রের সরবরাহ পেয়েছিল জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল।
১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা ঐক্যের প্রতীক হিসেবে দেশে ফিরে এসে আওয়ামী লীগের হাল ধরলেও তাৎক্ষণিক দলের সব সমস্যার সমাধান হয়নি। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলর মধ্যে অনেক বড় একটি ইস্যু ছিল। এক পর্যায়ে আব্দুর রাজ্জাক এবং আরও কয়েকজন নেতাকে এই কোন্দলের জন্য আওয়ামী লীগ এর পক্ষ থেকে দায়ী করা হয় এবং তাঁদের বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়। আব্দুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে ১৯৮৩ সালে আবারও বাকশাল গঠন করেন। ‘আব্দুর রাজ্জাকের বাকশাল’ এর ছাত্র সংগঠন ছিল ‘জাতীয় ছাত্রলীগ’।
আশির দশকে এরশাদের স্বৈরশাসন উৎখাত আন্দোলনে জাতীয় ছাত্রলীগের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
১৯৮৫-এর ১৩ ফেব্রুয়ারি এর এই দিনটি ছিল উত্তাল আন্দোলনের একটি দিন। অস্ত্রের জোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু হল দখল করে রেখেছিল নতুন বাংলা ছাত্রসমাজ। ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ ক্রমাগতই চেষ্টা করে যাচ্ছিল কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এরশাদপন্থী অস্ত্রধারীদের বিতাড়ণ করা যায়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৩ ফেব্রুয়ারি রাত প্রায় ১১টার দিকে মিছিল নিয়ে বের হন রাউফুন বসুনিয়া। মিছিলটি মহসিন হলের ভেতর রাস্তা পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল রাস্তায় আসতেই নতুন বাংলা ছাত্রসমাজের সশস্ত্র গুণ্ডাদের এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হন তিনি। নতুন বাংলা ছাত্র সমাজের দখলকৃত স্যার এ এফ রহমান হল থেকে রাউফুন বসুনিয়া’র মিছিলে এলোপাতাড়ি গুলি করা হয়।
রাউফুন বসুনিয়ার নির্মম হত্যার প্রতিক্রিয়ায় জেগে উঠা ছাত্র সমাজের প্রবল প্রতিরোধের মুখে নতুন বাংলা ছাত্রসমাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত হয়। এতে অংশগ্রহণ করে সেই সময়ে ক্রিয়াশীল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্র সংগঠন এবং সাধারণ ছাত্ররা।
‘নতুন বাংলা ছাত্রসমাজ’ এরশাদ এর স্বৈরশাসনের ছত্রছায়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে জাঁকিয়ে বসেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই সংগঠনটিকে তাড়িয়ে দেয়া ছিল এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম সফলতা। এরপর এরশাদ পিছু হটে তাঁর গড়ে তোলা এই গুণ্ডাতান্ত্রিক সংগঠনের কার্যক্রম বাতিল ঘোষণা করেন।
‘নতুন বাংলা ছাত্রসমাজ’ টিকে থাকলে এরশাদের শোচনীয় পতন হতো না, এই বলে এখনো দুঃখ বোধ করেন এরশাদের দলের অনেকেই। এ যেন মরা গরুর মাংসের স্বাদ নিয়ে শকুনের অভিযোগ। কী নির্লজ্জ এরা! নিজেদের অপকর্মের জন্য, অনেক মানুষের হত্যা এবং একটি প্রজন্ম ও একটি দেশকে পিছিয়ে দেওয়ার দায় কাঁধে নিয়ে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিৎ ছিল তাদের। তার পরিবর্তে এরা হারানো অবৈধ ক্ষমতা নিয়ে হাহাকার করে। এদেশে এদের জোর গলার শব্দ শুনে স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনের শহীদদের রক্ত চিৎকার করে উঠে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বৈরশাসন এবং সন্ত্রাসবিরোধী আন্দোলনে শহীদ অনেকের নামেই স্মারক ভাস্কর্য আছে। বিবিধ সংগঠনের পক্ষ থেকে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সেগুলোর যত্ন নেওয়া হয়। কিন্তু গত কয়েক বছর থেকেই দেখছি কী নিদারুণ অবহেলার শিকার বসুনিয়া তোরণ এবং তার পাশেই বসুনিয়া’র আবক্ষ ভাস্কর্য। কেউ যেন দেখার নেই। মহসীন হলের প্রবেশ রাস্তার মুখের এই তোরণ এবং বসুনিয়া ভাস্কর্যের প্রতি এত অবহেলা কেন? নতুন প্রজন্ম বসুনিয়া’র নাম ভুলতে বসেছে।
১৯৯১ সালে এক কাউন্সিলের মাধ্যমে আব্দুর রাজ্জাকের বাকশাল আবার আওয়ামী লীগে মিশে যায়। বিলুপ্ত হয় বসুনিয়া’র সংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগ। বসুনিয়া’র আজ আর কোন দল নেই। তাই হয়তো তার ভাস্কর্যের কোন যত্নও নেই। কিন্তু শহীদের খাতায় নাম লিখিয়েছেন যিনি তাঁকে স্মরণ করতেও কি আমরা দলীয় পরিচয় খুঁজে বেড়াব!
রাউফুন বসুনিয়া মহসিন হলের সদর গেইটে পাথর চোখে আমাদের ক্ষুদ্রতায় ডুবে যাওয়ার ক্রান্তিকাল দেখছেন। তাঁকে ভুলে গিয়ে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের রুটি রুজি অন্বেষণের ইঁদুর দৌড়ের ক্ষুদ্রতা দেখে প্রতিদিন তিনি আরও বেশি করে প্রস্তরীভূত হচ্ছেন। এক ভগ্ন আত্মার শহীদ তাঁর নিজের ভাস্কর্য ক্রমাগত নিজেই নির্মাণ করে চলেছেন। ক্ষমা করবেন রাউফুন বসুনিয়া। তবে ইতিহাসের শিক্ষা শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না।

রক্তের অক্ষরে যাঁরা আমাদের গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন, তাঁদের জন্য অবহেলা ছাড়া আমরা কিছুই দিতে পারিনি।”
এরশাদের পতন ঘটিয়ে সংসদীয় ব্যবস্থার প্রচলন ছিল শাসক শ্রেণীর রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি সংস্কার মাত্র। এতে শাসক শ্রেণীর ক্ষমতার পোশাক বদল হয়েছে মাত্র।
আজ কোটি কোটি বঞ্চিত জনগণের স্বপ্ন পুরণের একটিই পথ-বিপ্লব। এদেশ, জাতি ও জনগণ মুক্তি পায়নি; কিন্তু তার মুক্তির আকাঙ্খা কখনো দমেনি। তার লড়াই কখনো থামে নি। জাফর, জয়নাল, দিপালী, কাঞ্চন, রাউফুন বসুনিয়াসহ লাখো শহীদের রক্তের ঋণ শোধ করতে হলে এ লড়াইকে সংগঠিত করার দায়িত্ব নিতে হবে আজকের তরুণ প্রজন্মকেই।
আসুন, অাবারও আওয়াজ তুলি, শিক্ষার উপনিবেশিকীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ অার নয়! ‘ভ্যালেন্টাইন’ সংস্কৃতিসহ অশ্লীলতা, যৌনতা ও নারীর উপর যৌন নিপীড়নও অার নয়! সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদ-জংগীবাদ রুখো। ব্যাংক লুটপাটকারীদের বিচার কর, বিজ্ঞান সম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু কর, বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র রুখো।
সমতা ন্যায্যতার অসাম্প্রদায়িক জনগণতান্ত্রিক অাধুনিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বিদ্যুৎ, গ্যাস সহ সকল প্রকার জ্বালানী তেলের দাম কমানো ও জনজীবনের সংকট মোচনসহ বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি কর্তৃক উত্থাপিত সামগ্রিক মুক্তির সনদ ২১ দফা দাবিসহ ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দৃঢ়ভাবে বাস্তবায়নের সংগ্রাম গড়ে তুলি!

-লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।