ডেস্ক রিপোর্ট: যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী গত কয়েকদিনে উত্তর আমেরিকার আকাশ থেকে উড়ন্ত যে তিনটি বস্তুকে গুলি করে নামিয়েছে সেগুলোর ব্যাপারে রহস্য এখনও কাটেনি। মার্কিন সামরিক বাহিনী বলছে এগুলো আসলে কী এবং এই বস্তুগুলো কীভাবে তাদের আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছিল তা তারা এখনও জানে না।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত রোববার এরকম আরও একটি বস্তু গুলি করে মাটিতে নামানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশ থেকে মাত্র আটদিনে মোট চারটি বস্তুকে ভূপাতিত করা হলো।
যুক্তরাষ্ট্র বলছে, সবশেষ যে বস্তুটি ভূপাতিত করা হয়েছে, সেটি ২০ হাজার ফুট উপর দিয়ে উড়ছিল, এবং যেকোনো বাণিজ্যিক বিমানের সাথে এর সংঘর্ষ হওয়ার আশঙ্কা ছিল।
এদিকে সোমবার চীনের পক্ষ থেকেও অভিযোগ করা হয়েছে যে গত এক বছরে যুক্তরাষ্ট্র বেইজিং-এর কাছ থেকে কোনো ধরনের অনুমতি না নিয়ে চীনের আকাশে ১০ বারেরও বেশি বেলুন উড়িয়েছে।
রহস্যজনক বস্তু
সবশেষ যে বস্তুটি নামানো হয়েছে তার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর একজন কমান্ডার বলেছেন, এটি “গ্যাস-ভর্তি কোনো বেলুন” অথবা “জেট ইঞ্জিন-চালিত কিছু হতে পারে।” তিনি আরো বলেন, এগুলো যে ভিনগ্রহ থেকে আসা কোনো বস্তু নয় এই সম্ভাবনাও তিনি উড়িয়ে দিচ্ছেন না।

এই বস্তুটিকে কানাডার সীমান্তের কাছে মিশিগানের লেক হিউরনে গুলি করে নামানো হয়েছে। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি একটি “অষ্টভুজ কাঠামো” যার সাথে কিছু দড়ি বাঁধা ছিল।

এফ-১৬ যুদ্ধবিমান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে এটিকে আকাশ থেকে নামানো হয়। এই ঘটনার পর উত্তর আমেরিকার আকাশে রহস্যময় উড়ন্ত বস্তুর চলাফেরা বেড়ে যাওয়া নিয়ে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে।

এই বস্তুগুলো কী এবং কোত্থেকে ও কেন পাঠানো হয়েছে- এসব নিয়েও জল্পনা কল্পনা তীব্র হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নর্দার্ন কমান্ড কমান্ডার জেনারেল গ্লেক ভানহার্ক বলেছেন, এসব বস্তু থেকে এখনও পর্যন্ত কোনো ধরনের হুমকির ইঙ্গিত পাওয়া যায় নি।

“আমি এগুলোকে বেলুনের মতো জিনিস বলবো না। সঙ্গত কারণে আমরা এগুলোকে বলছি বস্তু,” বলেন তিনি, “আমরা খুব ছোট ছোট কিছু বস্তু দেখতে পাচ্ছি যেগুলো খুব অল্প পরিমাণে র‍্যাডার-সিগন্যাল তৈরি করে।”

এগুলো অন্য কোনো গ্রহ থেকে আসা এলিয়েন বা এক্সট্রা-টেরেস্ট্রিয়াল কি না – এই প্রশ্নের উত্তরে জেনারেল ভ্যানহার্ক বলেছেন, “এগুলো আসলে কী সেটা আমি গোয়েন্দাদের খুঁজে বের করতে বলবো। এই মুহূর্তে এসবের কিছুই আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না।”

চীনা বেলুন
এর আগে চীনের সন্দেহজনক একটি গোয়েন্দা বেলুন ৪ ফেব্রুয়ারি সাউথ ক্যারোলাইনার সমুদ্র উপকূলে ভূপাতিত করা হয়েছিল। বেলুনটি যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে কয়েকদিন ধরে ভেসে বেড়াচ্ছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলছেন, চীন থেকে বেলুনটি ওড়ানো হয়েছে এবং স্পর্শকাতর এলাকার ওপর নজর রাখার কাজে এটি ব্যবহার করা হচ্ছিল।

গুপ্তচরবৃত্তির কাজে বেলুনটি ব্যবহার করার অভিযোগ অস্বীকার করে চীন বলছে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের জন্য বেলুনটি আকাশে ছাড়া হয়েছিল যা উড়তে উড়তে পথ ভুল করে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে চলে গেছে। এজন্য চীনের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করা হলেও এই ঘটনার পর ওয়াশিংটন ও বেইজিং-এর মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে প্রথম বেলুনটি ধরা পড়ার পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যান্টনি ব্লিনকেন তার বেইজিং সফর বাতিল করেন। তিনি বলেন, চীনের “এধরনের গুপ্তচরবৃত্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”

তবে রোববার মার্কিন এক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেছেন প্রথম বেলুনটির বিষয়ে চীনের সাথে যোগাযোগ করেছে। তবে দুটো দেশের মধ্যে এনিয়ে কী আলোচনা হয়েছে সেটা এখনও পরিষ্কার নয়।

“চীনের আকাশে মার্কিন বেলুন”
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে যুক্তরাষ্ট্র গত বছর তাদের আকাশসীমায় ১০ বারের বেশি বেলুন উড়িয়েছে। তারা বলছে, এর আগে যুক্তরাষ্ট্র বহুবার তাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে।

“অবৈধভাবে অন্য একটি দেশের আকাশসীমায় ঢুকে পড়া যুক্তরাষ্ট্রের জন্যেও অস্বাভাবিক কিছু নয়। চীনা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো ধরনের অনুমতি না নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র গত বছর দশবারেরও বেশি ঢুকে পড়েছে,” সোমবার সাংবাদিকদের বলেন চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন।

তিনি বলেন, চীনের বিরুদ্ধে এধরনের অভিযোগ আনার আগে তাদের উচিত নিজেদের দিকে ফিরে তাকানো।

যুক্তরাষ্ট্রের অনুপ্রবেশের ঘটনায় চীনের পক্ষ থেকে যৌক্তিক ও পেশাদারি জবাব দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। চীনের এই অভিযোগের ব্যাপারে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে এখনও কোনো মন্তব্য করা হয়নি।

কী ধরনের বস্তু
৪ ফেব্রুয়ারির পর যুক্তরাষ্ট্র আরো তিনটি বস্তু গুলি করে আকাশ থেকে ফেলে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন শুক্রবার উত্তর আলাস্কার আকাশ থেকে একটি বস্তু নামানোর আদেশ দিয়েছেন। একই ধরনের আরো একটি বস্তু উত্তর-পশ্চিম কানাডার সীমান্তের কাছে ইওকোনোর আকাশ থেকে ভূপাতিত করা হয় শনিবার।

এসব বস্তুর ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা এখনও কাজ করছে।

“এই বস্তুগুলির মধ্যে যে খুব বেশি মিল আছে তা নয়। ৪ঠা ফেব্রুয়ারির বেলুনের চেয়ে এগুলো বেশ ছোট। ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার না করা পর্যন্ত এগুলোর বিষয়ে আমরা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছি না,” বলেন হোয়াইট হাউজে জাতীয় প্রতিরক্ষা বিষয়ক একজন মুখপাত্র।

যুক্তরাষ্ট্রের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবিসি নিউজকে বলেছে, সর্বশেষ যে তিনটি বস্তুকে নামানো হয়েছে সেগুলো আবহাওয়া সংক্রান্ত জিনিস, নজরদারি করার বেলুন নয়।

তবে কংগ্রেসে শীর্ষস্থানীয় একজন ডেমোক্র্যাট ভিন্ন কথা বলেছেন। এর আগে তিনি বলেছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা এগুলোকেই নজরদারি বেলুন বলেই মনে করেন।

সেনেটর চাক শুমার বলেন, “তাদের বিশ্বাস এগুলো বেলুন, তবে প্রথমটির চেয়ে আকারে অনেক ছোট।”

প্রথম বেলুনটিকে বাইডেন প্রশাসন যেভাবে সামাল দিয়েছে তার সমালোচনা করছে রিপাবলিকানরা। তারা বলছে, বিলম্ব না করেই বেলুনটিকে নামিয়ে ফেলা উচিত ছিল।

রহস্যময় উড়ন্ত বস্তুর টাইমলাইন
৪ ফেব্রুয়ারি: যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী সাউথ ক্যারোলাইনার উপকূলে সন্দেহজনক একটি গোয়েন্দা বেলুন ভূপাতিত করে। কয়েকদিন ধরে এটি যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে ভাসছিল। কর্মকর্তারা বলছেন, এটি চীন থেকে এসেছে যা স্পর্শকাতর এলাকার ওপর নজর রাখছিল।

১০ ফেব্রুয়ারি: উত্তর আলাস্কাতে আরো একটি বস্তু ভূপাতিত করে যুক্তরাষ্ট্র। কর্মকর্তারা বলছেন, এর মধ্যে ওড়ার জন্য কোনো ইঞ্জিন ছিল না। নিয়ন্ত্রণ করার জন্যেও কোনো যন্ত্র ছিল না।

১১ ফেব্রুয়ারি: আমেরিকান যুদ্ধবিমান যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত থেকে ১০০ মাইল দূরে কানাডার ইওকোন টেরিটরিতে অনেক উপরে ভাসমান একটি বস্তুকে ভূপাতিত করে। বলা হচ্ছে এর আকৃতি সিলিন্ডারের মতো এবং প্রথম বেলুনটির চেয়ে ছোট।

১২ ফেব্রুয়ারি: যুক্তরাষ্ট্রের জেট বিমান আকাশের অনেক উপরে ভাসমান একটি বস্তুকে লেক হিউরেনের কাছে “সতকর্তা অবলম্বনের জন্য” ভূপাতিত করে।
ইত্তেফাক