Home সাহিত্য ও বিনোদন রবীন্দ্রনাথের ‘কৃষ্ণকলি’ কবিতার ১২২ বছর : সমস্তই বিপুল পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে ছুটে...

রবীন্দ্রনাথের ‘কৃষ্ণকলি’ কবিতার ১২২ বছর : সমস্তই বিপুল পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে অবিশ্রান্ত

44

সৈয়দ আমিরুজ্জামান |

বাংলাসাহিত্যের দিকপাল রবীন্দ্রনাথের ‘কৃষ্ণকলি’ কবিতার ১২২ বছর পূর্ণ হয়েছে এবার। সমস্তই বিপুল পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে অবিশ্রান্ত।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গত শতাব্দিতে লিখে গেছেন,
‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক/
মেঘলাদিনে দেখেছিলেম মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
ঘোমটা মাথায় ছিলনা তার মোটে,
মুক্তবেণী পিঠের ‘পরে লোটে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে
ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,
শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে
কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।
আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু
শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
পূবে বাতাস এল হঠাত্‍‌ ধেয়ে,
ধানের ক্ষেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ।
আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা,
মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ।
আমার পানে দেখলে কিনা চেয়ে,
আমি জানি আর জানে সেই মেয়ে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
এমনি করে কাজল কালো মেঘ
জ্যৈষ্ঠমাসে আসে ঈশান কোণে।
এমনি করে কালো কোমল ছায়া
আষাঢ়মাসে নামে তমাল-বনে।
এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে
হঠাত্‍‌ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,
আর যা বলে বলুক অন্য লোক।
দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।
মাথার পরে দেয়নি তুলে বাস,
লজ্জা পাবার পায়নি অবকাশ।
কালো? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।’
শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে ১২২ বছর আগে ১৩০৭ বঙ্গাব্দের ৫ আষাঢ় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কৃষ্ণকলি’ কবিতাটি রচনা করেন। এখন চলছে ১৪২৯ বঙ্গাব্দ।
বিশ্বের সেই অন্তর্নিহিত শক্তি, যার থেকে এই রূপময় পৃথিবী এবং সমগ্র বিশ্বের সৃষ্টি, সেই অন্তর্নিহিত শক্তিই হলো সমস্ত সৃষ্টির মূলসত্য। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে এই আধ্যাত্মিক চেতনার সাথে যুক্ত হয়েছিল, বিশ্বের কোনো কিছুই স্থির হয়ে নেই। সমস্তই বিপুল পরিবর্তন, পরিবর্ধনের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে অবিশ্রান্ত। এই যে অনির্বাণ ছুটে চলা, অনন্ত জীবনপ্রবাহ এটাই হলো বিশ্বসৃষ্টির মূল তত্ত্ব।
শ্যামবর্ণ মেয়েদের ফুটিয়ে তুলতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই উপমা এখনো দুই বাংলাতেই ধার হয়।
সাধারণ অর্থে বাংলাদেশে বর্ণবাদ নেই৷ গায়ের রং দিয়ে সমাজে বিভেদরেখা টানার সুযোগই নেই। বর্ণবাদ তো দূরের বিষয়। তবু ‘বর্ণবাদ’ আছে৷ আছে পরিবারে, সমাজে, বিজ্ঞাপনে৷ সেই বর্ণবাদের শিকার ‘কালো মেয়ে’৷ রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘কৃষ্ণকলি’রা।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন জীবনবোধে বিশ্বাসী। তিনি ছিলেন সাহিত্যিক তবে দার্শনিক। তারচেয়েও বড় কথা তিনি জীবনরসের কবি। অসীম-সসীমের মিলনকে কবি অনুভব করেছেন প্রেমে ভালোবাসায়, রূপে রসে, গন্ধস্পর্শে, বিষাদে বেদনায়, সুখ-দুঃখে। সেটা তিনি অনুভব করেছেন সর্বানুভূতির ভেতর দিয়ে। কিছুই তার কাছে তুচ্ছ নয় তাই। পৃথিবীর তুচ্ছতম ধূলিকণাও কবির কাছে পরম উপভোগ্য হয়েছে। সবই অভিষিক্ত হয়েছে সৌন্দর্যের নব নব উৎসরসে।
বর্তমানে তথাকথিত প্রগতিশীল মিডিয়াগুলোর মাধ্যমে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট বর্ণবাদ এবং রবীন্দ্রনাথের কৃষ্ণকলি নিয়ে আলোচনা; মূলত এই দুটো বিষয় নিবন্ধের উপজীব্য।
‘কৃষ্ণকলি’ কবিতায় বিশ্বকবি অজ পাড়াগাঁয়ের এক সামান্য কালো মেয়েকে অপরিসীম মূল্য দিয়েছেন। এখানেই আমাদের আগ্রহ। মেয়েটির তুলনায় এসেছে নতুন নতুন বিশেষণ। কবি লিখেছেন, ‘মুক্তবেণী পিঠের ’পরে লোটে’, ‘কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ – চোখ।’
প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী একবার বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ পূর্ববাংলা (বাংলাদেশ তখন পূর্ববাংলা হিসেবে পরিচিত) না এলে তিনি নাগরিক কবিই রয়ে যেতেন। এই মন্তব্য হয়ত খানিক অতিরঞ্জিত, তবে এতে একেবারেই যে সত্যি নেই, তাও নয়। আমরা জানি উনিশ শতকের শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথ পারিবারিক জমিদারি দেখভালের জন্য তৎকালীন পূর্ববাংলায় এসেছিলেন। এসে শুধু জমিদারি নয় পূর্ববাংলার নদী-মাটি-প্রকৃতি, প্রাকৃতজন ও এর লোকজ দর্শনের সঙ্গে নিজের প্রাণের ছন্দটি খুঁজে পেলেন। পূর্ব বাংলার বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি তাকে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করেছিল।
সৌন্দর্যের ভেতর দিয়ে সত্যের ও প্রেমের সাধনাই রবীন্দ্রনাথের সমগ্র কাব্যসাহিত্যের ইতিহাস। কিন্তু এখন এই সময়টা একুশ শতক, কৃষ্ণকলির ১২২ বছর পরের সময়। রবীন্দ্রনাথের সেই কালো মেয়েরা আজ আর শুধু উপমাতে নেই। সমাজের বিভিন্ন রীতি-নীতি, আচার-বিচারের সম্মুখীন। এসবের প্রভাবে বলতে গেলে তারা এখন ধীরে ধীরে খারাপ থাকার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। আর এক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে মুনাফালোভী অর্থনীতি এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসন।
ওপেন মার্কেটের বদৌলতে এবং মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর অবাধ ব্যবসা এবং বিপণন কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সুযোগের কারণে অহরহ এই বিষয়টি দৃষ্টিতে পড়ছে আমাদের। ফেয়ারনেস ক্রিম, রান্নার বিজ্ঞাপন কিংবা নারীর কর্মক্ষেত্র সংক্রান্ত কোনো প্রচারনায় কালো এবং ফর্সা মেয়ের একটি সস্তা বিষয়বস্তু তুলে ধরা হয়।
আবার এখনকার বাস্তবতা হলো, এই একুশ শতকেও গায়ের রং কালো হলে ‘মেয়ের বিয়ে কী করে হবে’ –এই ভাবনায় নাভিশ্বাস উঠে বাবা-মায়ের৷ জন্মের পর থেকেই চলে মেয়েকে ফর্সা করার প্রাণান্ত চেষ্টা৷ সমাজ যেন প্রতিমুহূর্তে বলছে, ‘কালো মেয়ে ভালো নয়, ফর্সা মেয়ে ভালো৷’ বিয়েতে ফর্সা মেয়ের ব্যাপক চাহিদা৷ কালো মেয়ের উলটো হাল৷ যৌতুক বা অন্য কোনো প্রণোদনা ছাড়া তাদের পাত্র পাওয়া ভারি কঠিন৷ ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে৷ তবে তা কতটা বেশি, তা আমরা মোটামুটি সবাই ধারণা করতে পারি।
সর্বত্রই ফর্সা মেয়ের চাহিদা৷ নাটকে, সিনেমায়, অনুষ্ঠান উপস্থাপনায়, সংবাদ পাঠে- সব জায়গায়৷ রং ‘ফর্সা’ নয়, অথচ খুব যোগ্য – এমন কেউ কেউ কালেভদ্রে সুযোগ পেয়েছেন বৈকি৷ তবে কালো রং আড়াল করে, অর্থাৎ চড়া প্রসাধনে ত্বক ঢেকে তবেই তারা পেয়েছেন যোগ্যতা প্রকাশের সুযোগ৷ রবীন্দ্রনাথের ভাবনার এ যেন পুরোই বিপরীত।
তবে বর্তমানে নারীরা শত বাঁধা পেছনে ফেলে অনেকটা এগিয়ে এসেছে৷ নারী ধীরে ধীরে অধিকার প্রতিষ্ঠা করছে, নিজের গুরুত্ব বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে কমছে ‘পাত্র চাই’, ‘পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপনের গুরুত্ব৷ চলমান এই ধারা সব মেয়ের জন্যই আশার কথা৷
বেসরকারি একটি গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ জানিয়েছে তারা ভিন্ন জাতি-বর্ণের মানুষকে প্রতিবেশী হিসেবে দেখতে চায় না। অর্থাৎ আমাদের দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ সরাসরি বর্ণবাদী মানুষ! সংখ্যাটি হয়তো আরো বেশি l কেননা আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে অন্যদের সাথে বর্ণবাদী আচরণ করে থাকি।
কালো মেয়েদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য কিছু করণীয় এখনকার সময়ে আলোচিত হয়। তবে প্রধান কারণের চেয়ে তা নিতান্তই গৌণ। যদিও আমরা বলতে পারি, বর্ণ এখনো সমাজে খুব বড় ধরনের কোনো বিষয় নয়। তবুও এখন যা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকারে বা গৌণভাবে সমাজে দেখা যাচ্ছে, এক সময় তা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। তাই আগে থেকেই এসব বিষয় মোকাবেলা করার সক্ষমতা আমাদের গ্রহণ করে রাখা উচিত। সামাজিকভাবেও আমাদের উচিত আরো সতর্ক হওয়া।
এক্ষেত্রে নারীদের উচিত, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেকে যোগ্য করে তোলা৷ সৌন্দর্যের তথাকথিত সংজ্ঞাকে তুচ্ছ করার মতো যোগ্য করে নিজেকে তৈরি করা৷ নারী যোগত্যায় যত অগ্রগামী হবে, অধিকারবঞ্চিত করা ততই হবে দুঃসাধ্য৷

-লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।