আন্তর্জাতিক ডেস্ক ।। “আমাদের বিশেষ সামরিক অভিযানের রণাঙ্গনে এ যাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন সময় যাচ্ছে,”-গম্ভীর কণ্ঠে উচ্চারণ রুশ টেলিভিশন উপস্থাপকের। রাশিয়ার যে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন নিয়মিত যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ সৈন্যদের সাফল্যের নানা ফিরিস্তি তুলে ধরতো বেশ দাম্ভিকতার সাথে সেই টিভি’র সাপ্তাহিক সংবাদ-ভিত্তিক ফ্ল্যাগশিপ অনুষ্ঠানের শুরুতেই স্বীকারোক্তি-“খারকিভ ফ্রন্টে পরিস্থিতি খারাপ – শত্রু সৈন্যের (ইউক্রেনীয়) সংখ্যা ছিল আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে যেসব শহর আমাদের সৈন্যরা মুক্ত করেছিল, এমন অনেক শহর থেকে তাদের চলে যেতে হয়েছে।” ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের এই অবস্থায় অভ্যন্তরীণভাবে বেশ চাপে পড়েছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। রনাঙ্গনে বড়ই বিপদে আছে মস্কো।

জানাগেছে খারকিভ আঞ্চলে একটি গ্রাম দখল করে নিয়েছে ইউক্রেনীয় সৈন্যরা। ইউক্রেনের উত্তর-পূর্বের অনেক গ্রাম ও শহরে বেশ কয়েক মাস পর নতুন করে নীল-হলুদ পতাকা উড়তে দেখা যাচ্ছে। রুশ সৈন্যদের বদলে এখন সেসব এলাকার রাস্তায় রাস্তায় ইউক্রেনীয় সৈন্যদের আনাগোনা।

জেলেনস্কি মঙ্গলবার দাবি, উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণে তার সেনাবাহিনী রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ থেকে ৬,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা দখল করে নিয়েছে। যদি এই দাবি সত্যি হয়, তাহলে গত পাঁচ মাস ধরে রাশিয়া ইউক্রেনের যতটা জায়গা দখলে নিয়েছিল, ইউক্রেনীয় সেনারা মাত্র সাত দিনে তার চেয়ে বেশি এলাকা পুনর্দখল করেছে।

রণাঙ্গন থেকে সাংবাদিকরা জানাচ্ছেন বিশাল এলাকা থেকে রুশ সৈন্যরা দ্রুত পিছু হটেছে। বিশেষ করে খারকিভ অঞ্চলের প্রায় পুরোটাই এখন আবারও ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে। অনেক জায়গায় অস্ত্র-সরঞ্জাম ফেলেই রুশ সৈন্যরা চলে গেছে। এই পিছু হটার কথা রাশিয়া নিজেরাও অস্বীকার করে নি।

যদিও রাশিয়ার প্রতিরক্ষা বিভাগের পক্ষ থেকে বলার চেষ্টা করা হচ্ছে- এটি পলায়ন নয়, বরং যুদ্ধ কৌশলের অংশ হিসাবে সাময়িক পিছু হটা, কিন্তু পশ্চিমা সামরিক বিশ্লেষকদের অনেকেই গত এক সপ্তাহে উত্তর-পূর্বের রণাঙ্গনের ঘটনাপ্রবাহকে ইউক্রেনের অসামান্য সামরিক সাফল্য এবং রাশিয়ার চরম ব্যর্থতা হিসাবে দেখছেন।

কতগুলো প্রশ্ন নিয়ে এখন বিস্তার আলোচনা-বিতর্ক, বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে – ইউক্রেনের উত্তর-পূর্বে যেসব জায়গা যুদ্ধের একদম শুরু থেকেই রাশিয়ার কব্জায় ছিল কীভাবে এক সপ্তাহের মধ্যে তা তারা হারিয়ে ফেললো? দক্ষিণের খেরসন বা মারিউপোল বা পূর্বের ডনবাসেও কি আগামী দিনগুলোতে একই ঘটনা চোখে পড়বে? প্রেসিডেন্ট পুতিন এখন কী করবেন?

গত মাস তিনেক ধরে ইউক্রেন বিভিন্নভাবে বার্তা দিচ্ছিল যে তারা দক্ষিণে পাল্টা হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাশিয়া তাতে বিশ্বাস করেছে এবং পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব থেকে বহু সৈন্য সরিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিরোধের জন্য নিয়ে গেছে,” তার ফলেই উত্তর-পূর্বের প্রতিরক্ষা দুর্বল হয়ে গেছে এবং ইউক্রেনের সৈন্যরা বড় কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই রাশিয়া অধিকৃত অঞ্চলে দ্রুত ঢুকে পড়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুকে বিভ্রান্ত করা খুবই পুরনো কৌশল। ইউক্রেন বেশ সাফল্যের সাথে রাশিয়াকে বিভ্রান্ত করতে পেরেছে-বলছেন আন্তর্জাতিক যুদ্ধ বিশ্লেষকরা।

ইউক্রেনের সরকার এখন খোলাখুলি বলছে যে, তাদের টার্গেট এখন দক্ষিণে ক্রাইমিয়ার সীমান্তবর্তী খেরসন, মারিউপোল এবং সেই সাথে পূর্বের ডনবাস। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, শীতের আগে জাপোরোশিয়ার পারমানবিক কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়াও এখন ইউক্রেনের অন্যতম প্রধান সামরিক লক্ষ্য।

কিন্তু সেটি কি করতে পারবে তারা? এ ব্যাপারে অবশ্য অনেকেই সন্দিহান। এমনকি ইউক্রেনের এই সামরিক সাফল্যকে কতটা গুরুত্ব দেয়া উচিৎ, তা নিয়েও বিশ্লেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।

কারণ, খেরসন-সহ দক্ষিণের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিশাল এলাকা এখনও রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে। পূর্বের ডনবাস অঞ্চলের ৯০ শতাংশই তাদের দখলে। এমনকি পুনর্দখল করা উত্তর-পূর্বের খারকিভ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ স্থায়ীভাবে ধরে রাখাটাও ইউক্রেনের জন্য কতটা সহজ হবে, তা নিয়েও সন্দেহ প্রবল। কারণ এলাকাটি রাশিয়ার সীমান্তে, এবং ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভে রাশিয়া তাদের সীমান্তের ভেতর থেকেই দূরপাল্লার কামান দিয়ে সহজেই আঘাত করার ক্ষমতা রাখে। রোববার খারকিভ শহরে দেশের বৃহত্তম থারমাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি রুশ ক্ষেপনাস্ত্র হামলায় বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে ইউক্রেনের এই নিয়ন্ত্রণ কতটা ভঙ্গুর।,KREMLN.RU

রাশিয়ার প্রতিরক্ষা দপ্তর এবং ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে তাদের সৈন্যদের পিছু হটার ঘটনাকে যুদ্ধের কৌশল হিসাবে দেখানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু রণক্ষেত্রের এই চিত্র পুতিন বিরোধীদের শক্তি বাড়িয়েছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। মিডিয়াতে, সোশাল মিডিয়াতে তারা ইউক্রেনে যুদ্ধ কৌশলে নিয়ে খোলাখুলি প্রশ্ন তুলছেন। এমনকি যুদ্ধের সমর্থকরাও হতাশা, ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।

পুতিনের ঘোরতর সমর্থক হিসাবে পরিচিত চেচেন নেতা রমজান কাদিরভ খোলাখুলি বলেছেন ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে সরকারের কৌশল নিয়ে তিনি সরাসরি পুতিনের সাথে কথা বলতে চান, কারণ সরকারের ভেতর অন্যদের ওপর তিনি ভরসা করতে পারছেন না।বির উৎস,MIKHAIL SVETLOV

রুশ পার্লামেন্টে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা গেন্নাদি জুগানভ ইউক্রেনে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে জনগণকে এই লড়াইতে সম্পৃক্ত করার দাবি জানিয়েছেন। সন্দেহ নেই, দেশের ভেতর চাপে পড়েছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। ইউক্রেনে রাশিয়ার পরিণতি কী দাঁড়াতে পারে, তা নিয়ে জনমনে সন্দেহ দানা বাঁধছে।

তবে পুতিন তার দেশের মানুষকে আশ্বস্ত করছেন যে ইউক্রেনের সামরিক অভিযানে তার কিছু “সীমিত লক্ষ্য” রয়েছে এবং সেগুলো তিনি অর্জন করেই ছাড়বেন।

পুতিন ইউক্রেনে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করতে চাইছেন না। তার দ্বিধার অন্যতম কারণ হয়তো যে তাকে তখন সেনাবাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামুলক করতে হতে পারে, এবং তাতে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে জনমত বিগড়ে যেতে পারে।

তাহলে প্রশ্ন হলো পুতিন এখন কী করবেন? কেউ-ই তা জানে না। তবে, বিবিসি প্রতিনিধি বলছেন, “একটি বিষয় সবাই জানেন যে মি পুতিন কখনো ভুল স্বীকার করার লোক নন, আর তিনি পিছু ফেরেন না।”

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া এখন খেরসন এবং ডনবানের প্রতিরক্ষা সংহত করতে জোর পদক্ষেপ নেবে। তবে বেশি বিপদ দেখলে হয়তো যুদ্ধকে “বিপজ্জনক মাত্রায়” সম্প্রসারিত করবে রাশিয়া।বিরৎস,REUTERS

তারা বলছেন, এখনো রাশিয়া তাদের সমরশক্তির “সীমিত একটি অংশ” ইউক্রেনে ব্যবহার করেছে। বিমান বাহিনীর খুব ছোটো একটি অংশ ব্যবহার করেছে, কিছু বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারই করে নি। যদি পরিস্থিতি সত্যিই একবারেই নাগালের বাইরে চলে যায়, রাশিয়া হয়তো তাদের সেই অব্যবহৃত বিমান এবং ক্ষেপণাস্ত্র শক্তি প্রয়োগ করতে পারে। গত এক সপ্তাহ ধরে ইউক্রেন দেখাচ্ছে যে তারা বিস্ময় তৈরির ক্ষমতা রাখে – রাশিয়ার সমর শক্তি নিয়ে যে মিথ বা পুরাকথা চালু ছিল তা হয়তো অনেকটাই তারা ভেঙ্গে দিতে পেরেছে। তবে যুদ্ধ শেষ হতে হয়তো এখনো আরো অনেক দেরি হতে পারে। সূত্র: বিবিসি