Home মতামত যশোরের নদীগুলো রক্ষায় সোচ্চার হতে হবে

যশোরের নদীগুলো রক্ষায় সোচ্চার হতে হবে

36

।। আশীষ কুমার দে ।।

দেশের নদ-নদীগুলো রক্ষায় উচ্চ আদালতের রায়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট নির্দেশনা, সরকারি বিধিমালা এবং পরিবেশবাদীসহ বিভিন্ন পেশার সচেতন নাগরিকদের জোরালো দাবি রয়েছে। কিন্তু এসব কিছুর প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভৈরব ও চিত্রাসহ যশোরের ছোট-বড় সাতটি নদ-নদীর ওপর পরিবেশবিনাশী ১২টি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। সূত্র: বণিক বার্তা, তারিখ: জুলাই ১২, ২০২৩।

জাতীয় স্বার্থপরিপন্থী অত্যন্ত গর্হিত এ কাজ করছে রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি প্রতিষ্ঠান ‘স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)’ এবং ‘সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)’। এর মধ্যে এলজিইডির ১১টি এবং সওজ’র একটি সেতু রয়েছে।

নির্মাণাধীন সেতুগুলো কম উচ্চতার হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে এর নিচ দিয়ে নৌযান চলাচল করতে পারবে না। বিধি অনুযায়ী, পানির ওপরিভাগ থেকে এসব সেতুর গার্ডারের নিচ পর্যন্ত উচ্চতা হওয়ার কথা নদীভেদে ১৬ ফুট থেকে ২৫ ফুট পর্যন্ত। কিন্তু নির্মাণাধীন সেতুগুলোর উচ্চতা সর্বনিম্ন ৪ দশমিক ৫৯ ফুট ও সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৫০ ফুট। সূত্র: প্রথম আলো, তারিখ: সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৩।

এছাড়া নদীর মধ্যে সেতুর দুই পাশে মাটি ফেলে ভরাট করায় নদীর প্রশস্ততা কমে গেছে। ফলে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে এবং নৌযান চলাচল করতে না পারায় নদীগুলো ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে পরিত্যক্ত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।

২০১৮ সালে জারি করা প্রজ্ঞাপনে সরকারি বিধিমালায় নদ-নদীর ওপর সেতু নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ছাড়পত্র নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এলজিইডি এবং সওজ তা নেয়নি। এমনকি সেতু নির্মাণে আপত্তি জানিয়ে দু’দফা চিঠি দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। তাও আমলে নেয়নি এলজিইডি ও সওজ।

এছাড়া উচ্চ আদালত জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে সকল নদ-নদীর আইনগত অভিভাবক হিসেবে ঘোষণা করলেও সেতু নির্মাণ প্রকল্প চূড়ান্ত করার আগে সংস্থাটির পরামর্শও নেয়া হয়নি। বরং এমন অপরিকল্পিত সেতু নির্মাণ না করার জন্য নদী রক্ষা কমিশনের পক্ষ থেকে চিঠি দেয়া হলেও সেতু নিমাণকারী সংস্থা দুটি তা আমলে নেয়নি।

নির্মাণাধীন সেতুগুলো হচ্ছে- যশোরের মনিরামপুর উপজেলায় টেকা নদীর ওপর একটি, মুক্তেশ্বরী নদীর ওপর দেড় কিলোমিটারের ব্যবধানে দুটি, শ্রী নদীর ওপর একটি, হরিহর নদের ওপর তিনটি, সদর উপজেলার ভৈরব নদের ওপর একটি, বাঘারপাড়ার ভৈরব ও চিত্রা নদীর ওপর দুটি এবং শার্শা উপজেলায় বেতনা নদীর এক কিলোমিটারের দূরত্বের মধ্যে দুটি।

এছাড়া সদর উপজেলার রূপদিয়ায় ভৈরব নদের ওপর কম উচ্চতার একটি সেতুর নির্মাণ কাজ কয়েক মাস আগে শেষ হয়েছে। এর ফলে ভৈরবের ওই অংশে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হতে শুরু করেছে এবং নৌ চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।

সাতটি নদীর ওপর এই ১২টি সেতুর মধ্যে বাঘারপাড়া উপজেলার সীমাখালীতে চিত্রা নদীর ওপর কম উচ্চতার সেতুটি নির্মাণ করছে সওজ। বাকিগুলো এলজিইডি নির্মাণ করছে।

আমাদের পরিবেশবান্ধব প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা একজন নদীপ্রেমীও বটে। তিনি ব্যক্তিগতভাবে দেশের সকল নদ-নদী রক্ষায় আন্তরিক। তাঁর বহুমুখি উন্নয়ন পরিকল্পনায় বিলুপ্ত নদী ও নৌপথ পুনরুদ্ধার এবং অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ গুরুত্ব পেয়েছে।

উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তায়নের লক্ষ্যে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার পর্যাপ্ত খনন ও পলি অপসারণের মাধ্যমে বিলুপ্ত নদী ও নৌপথ পুনরুদ্ধার এবং অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগের পরিধি বাড়াতে ধারাবাহিকভাবে প্রয়োজনীয় অর্থবরাদ্দ দিয়ে চলেছে। প্রত্যাশিত সাফল্য না এলেও ইতোমধ্যে তিন হাজারেরও বেশি নৌপথ পুনরুদ্ধার করেছে বিআইডব্লিউটিএ। এছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বিআইডব্লিউটিএ আলাদাভাবে বেশ কয়েকটি বড় নদী খনন করছে।

এ পরিস্থিতিতে যশোরের মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকা, যেখানে ভৈরব ও চিত্রার মতো ইতিহাসখ্যাত নদ-নদী রয়েছে এবং এক সময়ে নৌ যোগাযোগ ও নৌ বাণিজ্যের অন্যতম স্থান ছিল, সেখানকার নদীগুলোর ওপর অপরিকল্পিত সেতু নির্মাণ মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা দুটোর কর্মকর্তারা নিশ্চয়ই জানেন যে, কম উচ্চতার সেতু নির্মাণের ফলে নদীগুলোতে নৌযান চলাচলে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটবে এবং অদূরভবিষ্যতে এসব নদী শুকিয়ে যাবে।

তা সত্ত্বেও এবং জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ও বিআ্ডব্লিউটিএর মতামতকে পদদলিত করে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এলজিইডি ও সওজ যা করছে, তা রীতিমতো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পরিবেশবিনাশী এবং জাতীয় স্বার্থবিরোধী এই গর্হিত কাজের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পেশার সচেতন নাগরিকবৃন্দসহ সাধারণ জনগণের তীব্র আন্দোলনের কোনো বিকল্প দৃশ্যমান হচ্ছে না। যশোরের নদীগুলো বাঁচাতে হলে আমাদের অতিদ্রুত সে পথেই অগ্রসর হতে হবে।

-লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং নদী ও পরিবহনবিষয়ক গবেষক। সাধারণ সম্পাদক: নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি।
ফোন: ০১৬১৭-৩০৩১৩২