Home মতামত মহান স্বাধীনতা দিবস ও মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু।

মহান স্বাধীনতা দিবস ও মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু।

18

আশীষ কুমার মুন্সী:
২৬ শে মার্চ। বাঙালির জাতির স্বাধীনতা মন্ত্রে উজ্জীবিত হওয়ার দিন, দীক্ষা নেওয়ার দিন। স্বাধীনতার সুখ সবাই পেতে চায়। পরাধীনতার শৃংখল কেউই পড়তে চায় না। কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন —

“স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,
কে বাঁচিতে চায়?
দাসত্ব – শৃংখল বল কে পরিবে পায় হে,
কে পরিবে পায়। “

এ স্বাধীনতার জন্য বিশ্বের বহু জাতি প্রাচীনকাল থেকে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। স্বাধীনতার কাছে জীবনের মূল্য তুচ্ছ মনে করেছেন। জেল, জুলুম, অত্যাচার বা কোনো বাধা মানুষকে পরাস্ত করতে পারিনি। বিশ্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই বিভিন্ন নেতা নিজেদের জীবনের সুখ বিসর্জন দিয়ে বছরের পর বছর কারাভোগ করেছেন। একটু পিছনের দিকের কথা বলি যখন অবিভক্ত ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন চলছিল তখন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর স্বাধীনতার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। সাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আরেকজন সংগ্রামী নেতা ঋষি অরবিন্দ। যারা সবসময় দেশের মানুষের কথা, দেশের মানুষের কল্যাণের কথা ভেবেছেন, দেশের মানুষকে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামী মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছেন। এসব মহামানব চিরকাল শ্রদ্ধার পাত্র, স্মরণীয় ও বরণীয়। এসব মহামানব জাতির দুর্দিনে শক্ত হাতে হাল না ধরতেন তাহলে আজও বাঙালি জাতিকে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হতে হতো। আজ আমরা পৃথিবীতে স্বাধীন ভূখণ্ডে বাস করছি তা মহামানবদের বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সংগ্রামের ফসল। বাঙালি জাতির আরো একজন সংগ্রামী নেতা মাস্টারদা সূর্য সেন। ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যার অবদান অনস্বীকার্য। বাঙালিদের উপর থেকে ব্রিটিশ শাসকদের শাসন, শোষণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাদের উপর সম্মুখ সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বৃটিশ শাসকদের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনা সর্বজনবিদিত। মাস্টারদা সূর্য সেন অসীম সাহসিকতা নিয়ে মিশন সফল করেন। ব্রিটিশ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। বাঙালি জাতি সাহসী জাতি, বীরের জাতি তা বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তার কাছ থেকে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার ও সাহসিকতার মধ্যে দীক্ষিত হয়েছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা লাভ করেছে।

ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর অধুনা বাংলাদেশ পুরোপুরি স্বাধীনতা লাভ করতে পারিনি। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে এই উপমহাদেশে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হলো। একটি হলো ভারত এবং অন্যটি পাকিস্তান। বাংলাদেশের এই অংশটি পূর্ব পাকিস্তান নামে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হল । শুরু হলো শাসনের পরিবর্তে শোষণের আরেকটি অধ্যায়। পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জাতিতে নির্যাতন, নিপীড়ণ করতে থাকে। বাঙালিরাও তাদের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে অসংখ্য মানুষ মৃত্যুবরণ করে। বিভিন্ন মামলা -মোকদ্দমা দিয়ে জেলখানায় আটকিয়ে রাখে। বাঙালি জাতির দুর্দিনে আবির্ভূত হয় বাঙালি জাতির জনক ও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে এদেশের আপামর জনগণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন । শেখ মুজিবর রহমান বজ্রকন্ঠে বলেছিলেন– “তোমাদের যার যা কিছু আছে, তা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ো। রক্ত যখন দিয়েছি তখন রক্ত আরো দেবো, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো –ইনশাল্লাহ্” তাঁর এই জ্বালাময়ী বক্তৃতার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন। স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করে বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। তখন বঙ্গবন্ধুর মত বিচক্ষণ, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতা না থাকলে বাঙালি জাতিকে আজও পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ থাকতে হতো। জাতিকে তিনি মুক্তির স্বাদ দেখিয়েছেন। প্রত্যেক ব্যক্তি বা জাতির জীবনে স্বাধীনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতা বিহীন জীবন অর্থহীন, বিভীষিকাময়। তাই স্বাধীনতা মানুষের অমূল্য সম্পদ। স্বাধীনতার জন্য মানুষের জীবন বিসর্জন দিতেও কুন্ঠাবোধ করে না। মহামানবের কাছে জীবনের মূল্য অতি তুচ্ছ বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন। আর মানুষ কেন? বনের জীবজন্তুরাও পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ হতে চায় না। পাঠকগণ একটু ভাবুন তো–বনের একটি পাখিকে খাঁচায় আবদ্ধ করে তাকে যতই আপনি ভালো ভালো খাবার দেন না কেন পাখি তা আবদ্ধ খাঁচায় বসে খেতে চায় না। সুযোগ পেলেই খাঁচা ছেড়ে পালিয়ে যাবে। তারাও স্বাধীনতা চায়, মুক্ত আকাশে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে চায়। ভালো ভালো খাবার ওই পাখির কাছে মূল্যহীন। তাইতো স্বাধীনতার জন্য যুগে যুগে মানুষ রক্ত দিয়েছেন, নিজেদের সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এজন্য বহুবছর জেলখানায় জীবন কাটাতে হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাকে দামাতে পারেনি। সত্যের পথে, ন্যায়ের পথে ছিলেন নির্ভীক। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ ।দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ও ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা লাভ করেছি স্বাধীন রাষ্ট্র। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশের নামে একটি নতুন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। শত শত বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল হতে মুক্ত হয় এবং বাঙালি জাতি চিরদিনের জন্য স্বাধীন জাতিতে পরিণত হয়। আমাদের বহু কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতা যে কোনো মূল্যে রক্ষা করার চেষ্টা করব। ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্রতামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে এগিয়ে যেতে হবে। তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে পারলে বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে। বহির্বিশ্বের সাথে সমানতালে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। আমরা যদি ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে পারি তাহলে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ গড়ার জন্য যারা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন তাদের পবিত্র আত্মা শান্তি পাবে। যতদিন বাংলাদেশে থাকবে, বাঙালি জাতি থাকবে ততদিন বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে নিহত ৩০ লক্ষ শহীদদের শ্রদ্ধাভরে চিরদিন স্মরণ করবে। তাদের অবদান ও আত্মত্যাগের কথা আমরা কোনোদিন ভুলবো না।

-লেখক; আশীষ কুমার মুন্সী, শিক্ষক, কলামিস্ট, ঝালকাঠি।