Home সাহিত্য ও বিনোদন কবি মাহ্ফুজা আহমেদ -এর তিনটি কবিতা

কবি মাহ্ফুজা আহমেদ -এর তিনটি কবিতা

69

১. আমার কবির হাতটি ধরে

জীবনের শতরূপ শতভাবে দেখার ছলে
ঘর থেকে দূরে বহুদূরে এসেছো চলে,
তোমার কবি তপন বিশ্বাসের হাতটি ধরে
বালির প্রাসাদ থেকে অঞ্জনা পাহাড়ে।
এসেছো চলে কিষ্কিন্ধ্যায় পম্প সরোবরে
শীতল জলে স্নান করে জীবন তৃষ্ণা মিটানোর তরে,
তোমার কবির হাতটি ধরে ঘুরেছো তুমি বৃন্দাবনে
দেখেছো তুমি কালিয়াদহে কৃষ্ণের খেলা সর্পের সনে।
তাজমহল দেখবে বলে আগ্রাফোর্টের মিনার হতে
কবির সনে গিয়েছো চলে যমুনার তীরে জ্যোৎস্না রাতে।
সে সব সুখের স্মৃতি যায় না ভোলা
স্বর্গ সুখের প্রেম-প্রীতিতে হৃদয় মাঝে দেয় দোলা,
তোমার যত গল্প-গাঁথা মনের মাঝে আছে তোলা
ভালোবেসে পরিয়েছো কবির গলায় প্রেমের মালা।
অন্তরের অলক্ষ্যে হোমাগ্নির সুবাস ঢেলে
তোমার প্রেমের স্বর্গ-সুধায় রেখেছো তারে তুলে,
আঁধারের বুক চিরে ভিড়ায়েছো সুখের তরী প্রেমের পরশে
তৃষিত মনের ব্যাকুল তৃষ্ণা মিটিয়েছে কবি তোমায় ভালোবেসে।
যদি না পেতে তুমি কবিরে এ ধরার বুকে
তোমার স্বপ্ন সাধের রঙিন ছবি আঁকা হতো না এ ভূলোকে,
জীবনের ছত্রে ছত্রে তোমার চেতনা বোধে ফুটিয়েছো শত ফুল আনন্দ উল্লাসে
তুমি পেয়েছো তাহারে শতরূপে শতভাবে অবশেষে।
তাইতো দৃঢ় মনোবলে প্রতিজ্ঞা করেছো,
“আমি যতবার জন্ম নিব এই ধরণী প’রে
রাখবো তোমারে অনন্য করে আমার নীরব অহংকারে।”

২. নিঃসঙ্গতার কান্না***

গহীন হতাশার শূন্যতা হৃদয়ের এফোঁড় ওফোঁড় ঘুরে বেড়ায়
মন ভাঙানি আকাশ অভিমানের বৃষ্টি ঝরায়।
উত্তরের বাতাসের মতো ফাটল ধরায়
একাকীত্বের নিঃসঙ্গতা,
কুয়াশা ভেজা রাতের গল্পে নেমে আসে বিরহ ব্যথা।
এই শহরে আপনার যে জন সব যেন অচেনা অজানা,
পূবের জানালার মস্ত চাঁদটাও খরখরে, অচেনা।
নিঝুম রাতের গল্পগুলো
তারা ঝরার মতো একে একে ঝরে যায়,
খুঁজে ফিরি তোমায়,
কোথায় রেখে গেলে এই নিরলস অবেলায়?
বসন্তের প্রেমে জোনাকীর ক্ষীণ আলো মৃত হৃদয়ে চেতনা জাগায় না,
নিঃশব্দে বুুনে যাওয়া শব্দের মিছিল আর কবিতায় ধরা দেয় না,
নিঃসঙ্গতা মুড়ে রেখেছে ডাহুক ডাকা দুপুর
কতদিন দখিণা বারান্দায় মুখোমুখি বসা হয় না দুজনার।
তুমি রেখে গেলে ফুল পাখী গান ভোরের বাতাস,
তবু খুঁজে পাই না কোথাও
তোমার শরীরের মাদকমিশ্র সুবাস।
কত কথা জমা পড়ে আছে স্মৃতির গহীনে নীরবে
হৃদয়ের অর্গল খুলে কে শোনাবে গান প্রগাঢ় অনুভবে।
প্রত্যাশার আলো আঁধারীতে আমি ক্লান্ত শ্রান্ত
কল্পলোকের স্বপ্নের জাল বুনে বুনে দেখি সবই ভ্রান্ত,
সবই আছে তবু নেই যেন কিছু
শুকতারার মাঝে চুপিচুপি তোমারে খুঁজি এক অবুঝ শিশু।
সঙ্গীহীন সময়ের ফোঁড় বিদীর্ণ করে এ বুক
নিত্য খুন হই সময়ের হাতে আমি এক পরাজিত সৈনিক।
অসমাপ্ত কবিতাটি ছিঁড়ে ফেলে নিঃশব্দে এগিয়ে যাই অনিশ্চয়তার পথে!
স্তব্ধ! নিঃসঙ্গতার কান্না মিশে থাকে একাকীত্বের আর্তনাদে।

৩. ভরাট চাঁন্দের যবনিকা

ভরাট চাঁন্দের পসরা সাজায়া বইসা আছি ডিঙি নায়।আইজ এই খলখলানি জোস্না রাইতে দুইজনে ভাইসা বেড়ামু পদ্মার বুকে।
রাইতের আন্ধার কাইরা লইয়া কি সুন্দর পসরের লাগান চাইয়া রইছে ঐ চকচইক্কা চাঁনডা।
আনন্দে বুকটা বারেবারে ফুইলা উঠতাছে।
চোখের কুনায় বিদ্যুতের ঝিলিক দিয়া যাইতাছে। আইজ তো হগ্গলে কয় ভালবাসার দিন।
রাধাচূড়া কৃষ্ণচূড়া, পলাশ, শিমুলের ডালে ডালে লাল টুকটুইক্কা আর হইলদা রঙের ফুল ফুটছে।
গাছে গাছে কোকিল গান ধরছে মিষ্টি সুরে।
সেই সুর আইয়া লাগছে মনে।
তাইলে ভালবাসা জাগবো না কেন মনে।
মনের অলিগলি ফুরফুরাইয়া ঘুইরা বেড়াইতে আছে প্রেম।
বসন্তের রঙের লগে মনের রঙও দারুণ মিশ খাইছে।
প্রকৃতির লগে মাইনসের মনের একটা টান আছে।
বর্ষার মেঘ দেইখা যেমুন মানুষ উদাস অয়া যায় হেমুন রোইদের মুক দেকলেও মনডা চনমনাইয়া উডে।
দূর ছাই কিযে সাতপাঁচ ভাইব্বা সুময়ডারে নষ্ট করতাছি।
অহনো আইতাছে না রূপা।
অপেক্ষার পহর আর ফুরাইবার চায় না।
আর কত একলা বইয়া থাকুম।
জলদি আয়রে রূপা, জলদি আয়।
এক্কেরে তর রূপের লাগানই চাঁন্দের জোস্নার রূপ উইছলা পড়ছে।
চাইয়া দেখ, গাঙের পানি কি ঝিকমিক করতাছে।
ও-ও-ও তুই তো আবার ভূতেরে ডরাস।
একলা আইবার পারবি তো।
গাঙে কোন ভূতটুত নাই। কিয়ের ডর?
আমি আছি না? পাগলী কুহান কার !
ওই তো, ওই যে রূপা আইতাছে।
পায়ে মল পিন্দন, ঝুনঝুন কইরা বাজতাছে।
গেছে হাট থেইকা মল জুড়া আইন্না দিছিলাম।
কি যে খুশি অইছিলো।
অর খুশি দেখলে আমার ও বুকটা নাইচ্চা উটে।
বুকের ভিতর কেমুন জানি একটা শিরশিরানি বইয়া যায়।
মনে অয় তামাম দুইন্না দিয়া অরে হাজাই। আমার কইলজার টুকরা !
এক ভরাট চাঁন্দে ওই আমার হাত দইরা গাঙের ঐ পাড় থেইকা পলায় আইছিল।
আইজও পর্যন্ত আর আমারে ছাইড়া বাপের বাড়ি এক রাইতও থাকে নাই।
আমার বুকের মদ্দিখানে যে অরে ঠাই দিছি।
পাগলী আমার !
অর খুব শখ আছিল শিমুল গাছ তলায় ঘর বান্দনের।
পাঁচদিন তুরি দুইজনে মিলা সুন্দর কইরা ঘর ছাইছি বাঁশের খুডা আর গাঙ পাড়ের শন দিয়া।
অর মনডায় যে কি খুশি।
বিয়ান বেলা উডানডারে সুন্দর কইরা ঝাট দিয়া শিমুল ফুলগুনি টুকায়া মালা গাঁইত্তা গলায় আর খুপায় পড়নের লাইগা তড় সইতে আছিল না।
শিমুল ফুল তর খুব পছন্দের তাইনা!
আমার মন ভুলাইবার তর কত ফন্দি- ফিকির! তুই পারছও!
তুই কইতি, গাছ ভইরা যহন শিমুল ফুডে,
কোকিল আয়া যহন কুহু-কুহু ডাকে,
মনের মইদ্দে তহন কেমুন জানি ভালবাসার লাইগা হাহাকার কইরা উডে।
আমার বুকডার মইদ্দে কান পাইতা দেখ কেমুন গাঙের হাওয়ার লাগান হু হু কইরা তর লাইগা ভালবাসা বইতাছে।
তুই কি শুনবার পাইতাছছ।
আয় ভালবাসার আফিমে ডুইবা শীতল অই, পরাণডারে জুড়াই।
দুইজনে ভাইসা বেড়াই এই জুস্না রাইতের গাঙের হাওয়া গতরে লাগাইয়া।
দেখ দেখ কেমুন জুনি পুকগুনি মিটমিট কইরা হাসতাছে তর আমার ভালবাসার আদেইকলাপনা দেইখা।
আকাশের ঐ তারাগুনিও শরম পাইতাছে।
শরম নাই খালি আমার।
শরম পামু কে?
তর আমার ভালবাসা তো স্বর্গ থাইকা নাইমা আইছে।
তুই যে আমার পরাণের পরাণ।
আমি কি তরে ছাড়া একদন্ড থাকপার পাড়ি?
তরে ছাড়া কি আমি বাঁচবার পারুম?
আয় না পাগলী, আয়।
চাইয়া দেখ ভরাট চাঁন্দের কেমুন ফটফইটা জুস্না।
আহছ না কেন? এত দেরী কেন?
তয় কি তুই আমার খোয়াব?
হগ্গলে কয় মুর্দার লগে কিয়ের কতা?
তুইও কি তাই কস।
আইজ যুদি তুই না আহছ আর দেখুম না ভরাট চাঁন্দের জুস্না।
সত্য-সত্য-সত্য, এই তিন সত্য কইলাম।
আন্ধার রাইতে খুঁইজা লমু তরে।
খুঁইজা লমু আমার মরন ছায়া।
ঐ পারে যাইয়া বান্ধুম আবার তর লগে ভালবাসার ঘর।
আমি আইতাছি রে, আইতাছি।
তুই থাকিছ আমার পন্থ চাইয়া।
ভরাট চাঁন্দের জুস্না রাইতেরে ফাঁকি দিয়া সুজনের নিথর দেহডা ডিঙি নায়ে ভাসতে ভাসতে এই ঘাট সেইঘাট হইয়া ঠেকে কোন এক ঘাটে।
কেও জানবারও পারলো না তার বুকের ভালবাসার ক্ষতে মিশা গেছে বিষ নামক ভালবাসার অমৃত সুধা।