Home রাজনীতি পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জনসংহতি সমিতি

পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জনসংহতি সমিতি

31

চট্টগ্রাম অফিস: পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর ২০২৩ সালের (জানুয়ারি-জুন) অর্ধ-বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জনসংহতি সমিতি। গণমাধ্যমে পাঠানো প্রতিবেদনে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক ও ভঙ্গুর অবস্থায় উপনীত হয়েছে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি দীর্ঘ ২৫ বছরেও যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়া এবং চুক্তি স্বাক্ষরকারী আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকার একনাগাড়ে সাড়ে ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেও সরকার কর্তৃক ২০১৪ সাল থেকে চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা, উপরন্তু একের পর এক চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম বাস্তবায়নের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে অত্যন্ত শ্বাসরুদ্ধকর ও বিস্ফোরন্মুখ। বলতে গেলে, চুক্তির পূর্ববর্তী সময়ের মতই বর্তমানেও জুম্মদের উপর একপ্রকার অবাধে চলছে আগ্রাসন, ভূমি বেদখল, স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ, সামরিক দমন-পীড়ন-অভিযান, হত্যা, গুম, মিথ্যা মামলা ও জেল-জুলুম, সরকারি পৃষ্টপোষকতায় সেটেলারদের গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণ, অনুপ্রবেশ, জুম্মদের সংখ্যালঘুকরণ, সাম্প্রদায়িক হামলা, নারীর উপর সহিংসতা ইত্যাদি মানবতাবিরোধী ও জুম্মদের জাতিগতভাবে বিলুপ্তকরণের প্রক্রিয়া।

পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করে জুম্মসহ স্থায়ী অধিবাসীদের ভূমি অধিকার নিশ্চিতকরণ, সকল অস্থায়ী সামরিক ক্যাম্প প্রত্যাহারসহ ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামক সেনাশাসনের অবসান, ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের স্ব স্ব ভূমিতে পুনর্বাসন, স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠান, বিশেষ শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে পার্বত্য এলাকার সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা ও সকল উন্নয়ন সমন্বয়, তত্ত্বাবধান ও পরিচালনা করার কথা থাকলেও সেখানে এর কোনো কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি।

সম্প্রতি ১৭-২৮ এপ্রিল ২০২৩, নিউইয়র্কস্থ জাতিসংঘের সদরদপ্তরে জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক পার্মানেন্ট ফোরামের ২২তম অধিবেশনে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব মোসাম্মৎ হামিদা বেগম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা “চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৬৫টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে” বলে জাতিসংঘের মতো বিশ্ব ফোরামে অসত্য তথ্য তুলে ধরেছিলেন। অথচ চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে, যা বিভিন্ন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ গবেষক ও প্রতিষ্ঠানের গবেষণা ফলাফলেও উঠে এসেছে। ফলে চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহসহ এখনো চুক্তির দুই-তৃতীয়াংশ ধারা হয় আংশিক বাস্তবায়িত নয়তো সম্পূর্ণ অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার ও জনসংহতি সমিতি এই ব্যবধান পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির মাধ্যমে নিরসন করা যেতে পারে বলে বিবেচনা করা যায়। উল্লেখ্য যে, জাতিসংঘের আদিবাসী বিষয়ক পার্মানেন্ট ফোরামের উক্ত অধিবেশনের গৃহীত রিপোর্টে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য অধিকতর প্রচেষ্টা চালানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য যে, পার্মানেন্ট ফোরামের উক্ত আহ্বানে চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার এখনো কোনো সাড়া প্রদান করেনি। অথচ জাতিসংঘের এধরনের আহ্বানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা সরকারের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

গত ৯ মার্চ ২০২৩ কুয়াকাটায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির ৭ম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু পূর্ববর্তী সভাগুলির মতো ৭ম সভায় দেখা গেছে, চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির গৃহীত সিদ্ধান্তবলী বাস্তবায়নের কোন অগ্রগতি নেই। ফলে সরকারের অসহযোগিতা ও গড়িমসির কারণে বর্তমানে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটিও অথর্ব সংস্থায় পরিণত হতে বসেছে।

সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনী পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনকে নস্যাৎ করার লক্ষ্যে জনসংহতি সমিতির সকল স্তরের নেতাকর্মীসহ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলনরত জুম্ম জনগণকে ‘সন্ত্রাসী’, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, ‘অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত’, ‘চাঁদাবাজ’ ইত্যাদি তকমা দিয়ে অপরাধীকরণ করছে। তারই অংশ হিসেবে জনসংহতি সমিতিসহ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে আন্দোলনরত অধিকারকর্মী ও জনগণকে সুপরিকল্পিতভাবে অবৈধ গ্রেফতার, বিচার-বহির্ভুত হত্যা, অস্ত্র গুঁজে দিয়ে আটক, মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে প্রেরণ, ওয়ারেন্ট ছাড়া ঘরবাড়ি তল্লাসী ও ঘরবাড়ির জিনিষপত্র তছনছ, মারধর, হয়রানি ইত্যাদি ফ্যাসীবাদী ও মানবাধিকার বিরোধী কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।

অপরদিকে সরকার, বিশেষ করে সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআইসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক জুম্মদের মধ্য থেকে সুবিধাবাদী, তাঁবেদার ও উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তিদের দিয়ে একের পর এক সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সৃষ্টি করে তাদেরকে চুক্তির পক্ষের জনগণ ও চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে। সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনী একদিকে এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে লালন-পালন করে ও মদদ দিয়ে এলাকায় ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে চলেছে, অপরদিকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সন্ত্রাসী দমনের নামে জনসংহতি সমিতিসহ জুম্ম জনগণের উপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে ও সন্ত্রাসী তৎপরতার দায়ভার জনসংহতি সমিতির উপর চাপিয়ে দিচ্ছে।

শুধু তাই নয়, সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী নিজেরাই উন্নয়ন ও নিরাপত্তার নামে সীমান্ত সড়ক ও সংযোগ সড়ক নির্মাণ, বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন, নতুন নতুন সেনা, বিজিবি ও এপিবিএন ক্যাম্প স্থাপন ও ক্যাম্প সম্প্রসারণ, রিজার্ভ ফরেষ্ট ঘোষণা, অস্থানীয়দের নিকট জুম্মদের প্রথাগত জুম ভূমি ও মৌজা ভূমি ইজারা প্রদান ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে জুম্মদের প্রথাগত ভূমি বেদখল করে তাদের চিরায়ত জায়গা-জমি থেকে উচ্ছেদ করছে ও অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিচ্ছে এবং এলাকার জীব-বৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ব্যাপক ধ্বংসসাধন করছে। চুক্তি অনুযায়ী যেখানে জুম্মদের চিরায়ত ভূমি ও ভূখন্ডের অধিকার নিশ্চিত হওয়ার কথা সেখানে তারা প্রতিনিয়ত চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী এসব উন্নয়ন আগ্রাসনের শিকারে পরিণত হচ্ছে।

এমতাবস্থায় জুম্ম জনগণের মানবাধিকারসহ রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভূমি অধিকার আজ ক্রমাগত পদদলিত করা হচ্ছে এবং তাদের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব চরম হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। জুম্মদের স্বাভাবিক জীবনধারা আজ প্রায় স্তব্ধ হয়ে পড়েছে।

২০২৩ সালের জানুয়ারি হতে জুন মাস পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সেনা-মদদপুষ্ট সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী, মুসলিম বাঙালি সেটেলার ও ভূমিদস্যুদের দ্বারা ১১৩টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে এবং এসব ঘটনায় ১,৩৯২ জন জুম্ম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়, ৮০টি বাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের শিকার হয় এবং এলজিইডি কর্তৃক ৩০ পরিবারের ফসলি জমি নষ্ট করা হয়।

(ক) প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতন

২০২৩ সালের জানুয়ারি হতে জুন মাস পর্যন্ত ১১৩টি ঘটনার মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ৬০টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এতে ৩১১ জন মানবাধিকার শিকার হয়েছে। তার মধ্যে ১৮ জনকে গ্রেফতার, ১৫ জনকে সাময়িক আটক, ১২২ জনকে মারধর ও আহত, মিথ্যা মামলার শিকার ৪০ জন, ২৭টি গ্রামে সামরিক অভিযান পরিচালনা, ১০০ জনের অধিক নিরস্ত্র ও নিরীহ জুম্ম গ্রামবাসীকে কেএনএফের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের সময় মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার, ১৭ পরিবারকে উচ্ছেদ ও ৯ পরিবারকে উচ্ছেদের হুমকি, ২টি নতুন ক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ ইত্যাদি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। নি¤েœ এর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা দেয়া গেল-

এসব ঘটনাবলীর অন্যতম হচ্ছে ২১ ডিসেম্বর ২০২২ থেকে ৬ জানুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত ১৬ দিনব্যাপী বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিলাইছড়ির পার্শ্ববর্তী জুরাছড়ি উপজেলার ১৩টি গ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় এক হয়রানিমূলক সামরিক অভিযান পরিচালনা করার ঘটনা। এই অভিযানে সেনা সদস্যরা স্থানীয় জুম্মদের ব্যাপক হয়রানি, বাড়িতে তল্লাশিসহ, অভিযানকালে খাওয়ার জন্য বিনামূল্যে ইচ্ছেমত জুম্মদের গৃহপালিত গরু, ছাগল, মোরগ-মুরগী ও চাল ইত্যাদি ছিনিয়ে নিয়েছে।

অন্যদিকে রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলাধীন চন্দ্রঘোনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কর্তৃক গত ৪ ও ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ক্রোকের আদেশ দেখিয়ে মিথ্যা মামলার শিকার জনসংহতি সমিতির স্থানীয় চারজন কর্মী পরিবার থেকে টাকা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। উক্ত ওসি চার পরিবারের কাছ থেকে মোট ৬১ হাজার টাকা আদায় করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

গত ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সেনাবাহিনীর রাঙ্গামাটি জেলাধীন ফারুয়া ইউনিয়নস্থ গাছবান সেনা ক্যাম্পের ২৬ বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কোর-এর ক্যাপ্টেন মারুফ ও সুবেদার মোঃ আহম্মেদ ফারুয়া ইউনিয়নের গাছবান পাড়া এলাকার কার্বারিসহ (গ্রাম প্রধান) ৯ জুম্ম পরিবারকে ১৫ দিনের মধ্যে নিজেদের বাড়িঘর ও গ্রাম ছেড়ে স্ব স্ব জিনিসপত্র নিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। গত ৩০ জানুয়ারি ২০২৩ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বিলাইছড়ি-বরকল এলাকার সীমান্ত সড়ক নির্মাণ প্রকল্প পরিদর্শনে গেলে তিনিই উক্ত গ্রামের ৯ জুম্ম পরিবারকে তাদের আবাসস্থল থেকে উঠিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে যান বলে জানান ক্যাপ্টেন মারুফ। উক্ত জায়গায় পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী উক্ত গ্রামবাসীদের উচ্ছেদের উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে। সীমান্ত সড়ক ও সংযোগ সড়ক নির্মাণকালে সেনাবাহিনী পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের উদ্দেশ্যে সড়ক সংলগ্ন আর্কষণীয় জায়গাগুলো সাইনবোর্ড টানিয়ে দখলে নিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বান্দরবানের জেল থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) দুই নেতা গত ১৫ মার্চ ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:৩০ টার দিকে জেল থেকে বের হওয়ার পরপরই সেনাবহিনী কর্তৃক জেলগেট থেকে আবার গ্রেপ্তারের শিকার হওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। ভুক্তভোগী দুই ছাত্রনেতা হলেন পিসিপি’র কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি থুইমং প্রু মারমা ও কেন্দ্রীয় সদস্য থুইনুমং মারমা।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক জোরপূর্বক বাঘাইছড়ি উপজেলার সার্বোয়াতলী ইউনিয়নে শিজকমুখ সার্বজনীন বৌদ্ধ বিহার প্রাঙ্গণে নির্মিত সেনা ক্যাম্পের সেনা সদস্যদের অবশেষে গত ২৫ মার্চ ২০২৩ প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়। তবে, সেনাবাহিনী সেনা ক্যাম্পের জায়গাটি বৌদ্ধ বিহার পরিচালনা কমিটিকে বুঝিয়ে না দিয়ে ৩৭ বিজিবি রাজনগর জোনের অধীনে শিজক মুখ বিজিবি ক্যাম্পের নিকট হস্তান্তর করেছে বলে জানা যায়।

গত ২ এপ্রিল ২০২৩ কক্সবাজার ব্যাটেলিয়ন (৩৪ বিজিবি) কর্তৃক গরু পাচারের মিথ্যা অভিযোগ এনে তিনজন তঞ্চঙ্গ্যা নারীকে সাময়িক আটকসহ কমপক্ষে ৪০ গ্রামবাসীদেরকে পাইকারীভাবে মারধর করা হয়। মারধরের শিকার গ্রামবাসীদের মধ্যে তিনজন গুরুতর আহত হয়। গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে কোনোরূপ মামলা করা হবে না মর্মে বিজিবির পক্ষ প্রতিশ্রুতি দেয়ার উদ্ভূত সমস্যার সমাধান হলেও বিজিবির জেসিও ৯৭৪৯ বিএম রেজাউল করিম কর্তৃক ৯ জন তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামবাসীসহ অজ্ঞাতানামা ৩০-৪০ জন গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে নাইক্ষ্যংছড়ি থানায় এক মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয় এবং এই মামলার জড়িত করে ৪ জন গ্রামবাসীকে আটক করে পুলিশের নিকট সোপর্দ করা হয়।

গত ১৬ মে ২০২৩ কেএনএফের এ্যাম্বুশে পড়ে সেনাবাহিনীর দুইজন জওয়ান নিহত ও তিনজন আহত হওয়ার পর রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়ি উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে সেনাবাহিনী গণহারে সাধারণ জুম্ম গ্রামবাসীকে পোর্টার হিসেবে নিয়ে যাচ্ছে এবং সশস্ত্র সংঘর্ষে তাদেরকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ পর্যন্ত প্রায় ১০০ জনের অধিক জুম্মকে সেনাবাহিনী পোর্টার হিসেবে নিয়ে গেছে বলে জানা গেছে।

(খ) সেনা-মদদপুষ্ট সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তৎপরতা

২০২৩ সালের জানুয়ারি হতে জুন মাস পর্যন্ত ১১৩টি ঘটনার মধ্যে সেনা-মদদপুষ্ট সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ কর্তৃক ২৯টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এতে ১,০৩০ জন ও ২৩টি গ্রামের অধিবাসীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে। তার মধ্যে ১৫ জনকে হত্যা, ৬ জনকে মারধর, ১১ জনকে অপহরণ, ২২ জনকে আটক, ২ জনকে আটক করার পর পুলিশের কাছে সোপর্দ, ১৯৫ বম ও মারমা পরিবারের প্রায় এক হাজার গ্রামবাসীদের গ্রাম থেকে উচ্ছেদ এবং ১৭টি গ্রামের অধিবাসীদের নানা ধরনের হয়রানি ও উচ্ছেদের হুমকি প্রদান ইত্যাদি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা নি¤েœ দেয়া গেল-

গত ১১ জানুয়ারি ২০২৩ খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ১নং খাগড়াছড়ি ইউনিয়নের থলিপাড়া থেকে সেনাবাহিনী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসীরা মিলে এক নিরীহ জুম্মকে আটক করে অস্ত্র গুঁজে দিয়ে পুলিশের নিকট হস্তান্তরের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

২৮ জানুয়ারি ২০২৩ বমপার্টি খ্যাত কেএনএফের ভয়ে পাইন্দু ইউনিয়নের মুয়ালপি পাড়া থেকে কমপক্ষে ৪৫ পরিবারের ১৭০ জন মারমা গ্রামবাসী উচ্ছেদ হয়ে রুমা সদরে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া প্রাংসা পাড়া, ইলি চান্দা পাড়া, ক্যকটাই পাড়া, ক্রোংক্ষ্যং পাড়াসহ রুমার প্রায় ১২টি পাড়ার লোকজন ৩দিন ধরে আতঙ্কে নিজেদের গ্রাম ছেড়ে পাশ্ববর্তী জঙ্গলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।

গত ৩ মে ২০২৩ গঙ্গারাম এলাকার উক্ত ১০ গ্রামের মুরুব্বিদের নিয়ে পার্বত্য চুক্তি-বিরোধী ইউপিডিএফের সন্ত্রাসী কর্তৃক বাঘাইহাট এলাকার করল্যাছড়ি নামক স্থানে এক সভা ডেকে বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের গঙ্গারাম এলাকার ১০টি গ্রামের জুম্ম অধিবাসীদের গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সেনা মদদপুষ্ট সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের সবচেয়ে লোমহর্ষক ঘটনা হচ্ছে গত ৬ এপ্রিল ২০২৩ রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী রোয়াংছড়ি সদর ইউনিয়নের খামতাং পাড়ায় সেনাবাহিনীর নির্দেশে সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) কর্তৃক ৮ জন বম গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করার ঘটনা। এরপর ৮ মে ২০২৩ রোয়াংছড়ি উপজেলার রোয়াংছড়ি সদর ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের পাইক্ষ্যং পাড়ার রিজার্ভ এলাকায় সেনামদদপুষ্ট ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসীরা ব্রাশ ফায়ার করলে ঘটনাস্থলেই বম সম্প্রদায়ের তিন ব্যক্তি নিহত এবং অপর একজন আহত হয়।

(গ) সেটেলার কর্তৃক হামলা ও ভূমি বেদখল

২০২৩ সালের জানুয়ারি হতে জুন মাস পর্যন্ত ১১৩টি ঘটনার মধ্যে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী, মুসলিম বাঙালি সেটেলার ও ভূমিদস্যু কর্তৃক ১২টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এতে ১৮টি পরিবার ও ১৩০ জন জুম্ম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে। তার মধ্যে ২ জনকে হত্যা, একজনকে মারধর, ২ জন জুম্ম গ্রামবাসীর ভূমি জবরদখল এবং ১৮টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। নিম্নে এর কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা গেল-

লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের দায়িত্বরত দেলোয়ার, নুরু ও মহসিনের নেতৃত্বে রাবার বাগানের শ্রমিক ও ৪ ট্রাক বহিরাগত ভাড়াটে লোকসহ প্রায় ১৫০ জনের অধিক বহিরাগত লোক সংঘবদ্ধ হয়ে গত ২ জানুয়ারি রাত ১:০০ ঘটিকায় লামা উপেজেলার সরই ইউনিয়নের রেংয়েন কার্বারী পাড়ায় ম্রো গ্রামবাসীদের ৯টি ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট চালায়। এতে কমপক্ষে ৩৫ জন ম্রো গ্রামবাসী হামলার শিকার হয়।

উল্লেখ্য যে, গত ২৬ এপ্রিল ২০২২ লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃক বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের লাংকম ম্রো কার্বারি পাড়া, জয়চন্দ্র ত্রিপুরা কার্বারি পাড়া এবং রেংয়েন ম্রো কার্বারি পাড়ার অধিবাসীদের ৩৫০ একর জুম ভূমি, ফলজবাগান ও গ্রামীন বনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ২৬ এপ্রিল ২০২২ হামলার পর এ যাবৎ কমপক্ষে এক ডজনের অধিক বার হামলা এবং ৪টি ষড়যন্ত্রমূলক সাজানো মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় উল্টো হামলা ও ভূমি জবরদখলের শিকার লাংকম ম্রো ও মথি ত্রিপুরাকে জেলে যেতে হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের তদন্ত টিমসহ দেশের নাগরিক সমাজ সরইয়ের তিন জুম্ম গ্রামবাসীর নিরাপত্তা প্রদান ও তাদের ভূমি রক্ষার জন্য সুপারিশ করলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। পক্ষান্তরে প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে ভূমি বেদখলকারী লামা রাবার ইন্ডাষ্ট্রিজের পক্ষে ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে।

২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বরকল উপজেলার ভূষণছড়া ইউনিয়নে মুসলিম বাঙালি সেটেলার কর্তৃক জোরপূর্বক এক জুম্ম গ্রামবাসীর ফলজ বাগানসহ ভূমি বেদখল করা হয়েছে। বেদখলকৃত উক্ত জায়াগায় বাঙালি সেটেলাররা ইতোমধ্যে একাধিক বাড়িও নির্মাণ করেছে। ভূমি বেদখলের শিকার জুম্ম গ্রামবাসীর নাম প্রাণময় চাকমা (৪২), পীং-অমর কান্তি চাকমা, গ্রাম-পন্ডিত পাড়া, ভূষণছড়া ইউনিয়ন। প্রায় ৭/৮ বছর পূর্বে ফলজ বাগান সৃজন করার পরিকল্পনা নিয়ে প্রাণময় চাকমা উক্ত জায়গাটি তার চাচা যতিন চন্দ্র চাকমার কাছ থেকে ক্রয় করেন। ক্রয় করার পরপরই তিনি জায়গাটিতে ফলজ বাগান সৃজন করে এবং বাড়ি নির্মাণ করে পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করেন।

কিন্তু ভূষণছড়া সেটেলার এলাকার বাসিন্দা মোঃ জাহাঙ্গীর, পীং-সারোয়ার তার দলবল নিয়ে জায়গাটি তার দাবি করে জোরপূর্বক বেদখল করে। জায়গার মূল মালিক প্রাণময় চাকমাসহ জুম্ম প্রতিবেশীরা প্রতিবাদ করলে বেদখলকারী মোঃ জাহাঙ্গীরও নিজেকে জায়গার মালিক দাবি করে বিভিন্ন ভূয়া দলিল দেখায়। এরপর প্রাণময় চাকমা ভূষণছড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের নিকট ভূমি নিয়ে এই বিরোধ নিষ্পত্তির আবেদন জানান। ইউপি চেয়ারম্যান এ নিয়ে উভয়পক্ষকে নিয়ে একটি সালিশ এর আয়োজন করেন। এসময় চেয়ারম্যান যে যেখানে আছে সেখানে থাকার নির্দেশ দেন।

(ঘ) যৌন হয়রানি, সহিংসতা, ধর্ষণ ও হত্যা

২০২৩ সালের জানুয়ারি হতে জুন মাস পর্যন্ত ১১৩টি ঘটনার মধ্যে রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় পক্ষ কর্তৃক জুম্ম নারী ও শিশুর উপর ১২টি সহিংস ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং এতে ১১ জন নারী মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে। তার মধ্যে একজনকে হত্যা, ৬ জন নারী ও শিশুকে ধর্ষণ, ৩ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা এবং ২ জন নারী ও শিশুকে অপহরণ ও পাচারের চেষ্টার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।

বিগত ছয় মাসে ১১ জন আদিবাসী জুম্ম নারী ও শিশু হত্যা, অপহরণ ও যৌন সহিংসতার শিকার হলেও ১২টি ঘটনার মধ্যে মাত্র ২টি ঘটনার অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বাকি ১০টি ঘটনার কমপক্ষে ২৪ জন অভিযুক্ত ব্যক্তি পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। উল্লেখ্য, এ যাবত জুম্ম নারী ও শিশুর ওপর যত সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তার কোনটিরই সুষ্ঠু বিচার হয়নি। এই বিচারহীনতার কারণে অপরাধীরা পার পেয়ে বার বার এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। ফলে জুম্ম নারী রা আজ চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে চলাফেরা করতে বাধ্য হচ্ছে।