Home মতামত মন্ত্রী কথা!!!

মন্ত্রী কথা!!!

39

সরদার মোঃ শাহীন:

কথা! মুখের কথা! যার রকমফেরের উপর কোন কথাই চলে না। সব মুখের সব কথা এক রকমের হয় না। সব কথার সমান ওজনও হয় না। ধরেন, আমার কথা। আমার মত সাধারণ মানুষ তো কত কথাই লিখি। কত কথাই বলি। সে সব কাজের কথা হোক আর বেহুদা হোক, তাতে কারো কিচ্ছু যায় আসে না। কিন্তু উজির নাজির কিংবা মন্ত্রী মিনিস্টারদের স্বাভাবিক কথাবার্তায় কিছু যাওয়া আসা না করলেও তাঁদের বেহুদা কথা অথবা বেফাঁস কথাবার্তায় কিছু না কিছু যায় আসে।
তাঁদের কথাবার্তা যেমন তেমন কোন বিষয় নয়। সরকারের বিষয়, রাষ্ট্রের বিষয়। এক কথায় বড়ই সেনসেটিভ বিষয়। তাই তাঁদেরকে সব কথাই মেপে বলতে হয়। কিংবা অনেক কথাই চেপে বলতে হয়। তাঁদের কাজই হলো মাপামাপি আর চাপাচাপি করে চলা। যদিও বাংলাদেশে না মেপে এবং না চেপে তাঁদের কারো কারো মুখ থেকে ফুস করে কথা বের হয়ে যাওয়া নতুন কোন বিষয় নয়। অনেকটাই নিত্যনৈমত্তিক বিষয়।
৫১ বছরের স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই নিত্যনৈমত্তিক। এমন কোন শাসনামল নেই, যে আমলে কেবিনেটে এমন মন্ত্রী বাহাদুর দু’একজন ছিলেন না। সব আমলেই তাঁরা ছিলেন এবং যথেষ্ঠ বীরদর্পেই ছিলেন। তাঁদের নিয়ে মিডিয়া যত রঙ রসকিতাই করতো না কেন, তাঁরা থোরাই কেয়ার করতেন। দমতেন না মোটেও। বরং নিত্যদিন নতুন উদ্যোমে তাঁরা মিডিয়ায় আসতেন এবং বেহুদা কথার বর্ষণে মিডিয়া কাঁপাতেন।
মিডিয়াও বা চুপ থাকবে কেন? সব সময় তাঁদের পিছু পিছু থাকতো। তাঁদের পিছু পিছু থাকাই যেন নিত্য নতুন নিউজ আইটেম পাওয়া। বঙ্গবন্ধু এবং জিয়ার আমলেও নিশ্চয়ই এমন ছিল। কিন্তু মিডিয়ার পরিধি তত বড় ছিল না বিধায়, তাঁরা তেমন ভাবে মিডিয়ায় ফোকাস হতেন না। অথবা আমি ছোট ছিলাম বলে তাঁদের আমলের মন্ত্রী বাহাদুরদের বেহুদা কথাবার্তা বুঝতামই না। অবশ্য না বুঝলেও কেউ না কেউ যে এমন কথার জন্যে কেবিনেটে ছিলেন, তা আমি নিশ্চিত।
কেননা, বুঝ হবার পর থেকে বাংলাদেশে যত কেবিনেটই দেখেছি, কোন কেবিনেটই এমনতর মন্ত্রীদের ছাড়া দেখিনি। এরশাদ আমলের উপপ্রধানমন্ত্রী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। যুক্তি দিয়ে বড় সিরিয়াস কথা বলতেন। তবে বলতেন রঙ আর তামাসা মাখিয়ে। মাঝেমধ্যে আকথা কুকথাও বলতেন রঙতামাসার ছলে। এবং কথার টার্গেটে থাকতেন শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া। এক সময় তাঁরা দু’জনায় মিলে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন করে করে এরশাদের বিদায়ের ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছেন প্রায়। ঠিক সেই মুহূর্তে এরশাদকে পাশে বসিয়ে ঢাকার এক জনসভায় শাহ মোয়াজ্জেম বলে দিলেন, “ঘোড়ার ডিম বাজবে। কিচ্ছু বাজবে না, কিচ্ছু হবে না। দুই নারীর মিলনে কোনদিন কিছু হয় না। ঘোড়ার ডিম হয়।”
দুর্ভাগ্য এরশাদের। দুই নারীর মিলনে কিছু হয়েছিল। এরশাদের চরম পতন হয়েছিল। কিন্তু খালেদা জিয়ার কেবিনেট মেম্বার ব্যারিস্টার নাজমূল হুদা মানুষকে ভুলিয়ে দিয়েছিলেন শাহ মোয়াজ্জেমের সেই উক্তি। তার অতি কথার জ্বালায় মানুষ আর শাহ মোয়াজ্জেমকে মনে রাখতে পারেনি। প্রায়শই বেহুদা কথা আর বেহুদা পেঁচালের জ্বালায় মিডিয়া তার নামটাই বদলে দিয়েছিল। সংক্ষেপ করে ব্যারিস্টার হুদাকে “বেহুদা”বলে উল্লেখ করতো। উল্লেখিত শব্দটি তিনি যে জানতেন না, মোটেও তা নয়। তিনি জানতেন। তথ্য বা মিডিয়ার মন্ত্রী হিসেবে তিনি ভালো করেই জানতেন। নিজেকে চিনতেনও বেশ।
নিজেকে চিনতেন তখনকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীও। যদিও তিনি কেবল বেহুদা কথা নয়; ভাল কথাও বলতেন। কিন্তু কেমন করে যেন সে সব ভাল কথা জায়গা উপযোগী হতো না। বেতাল হয়ে যেত। আর এ জন্যেই পটুয়াখালীর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আলতাফ হোসেনের বক্তব্য নেয়ার জন্যে মিডিয়া হুমরি খেয়ে পড়তো। একবার মিডিয়ায় বলা তার খুব সাধারণ একটি কথা আসাধারণ ভাবে কভারেজ পেল। সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত শিশুর মাকে সমবেদনা জানাতে তার বাসায় যেয়ে বলা অসাধারণ সে উক্তি, “আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে।”
আর যায় কোথায়! বাজার ছেয়ে গেল তার কথায়। আজও মানুষ সুযোগ পেলেই কোটেশন টানে। কোটেশন টানে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফজ্জামান বাবরের কথাও। বর্তমানে কনডেম সেলে থাকা ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত এই বাবর সাহেব সারাক্ষণ চেষ্টা করতেন ইংরেজিতে কথা বলতে। খুব যে মন্দ বলতেন সেটাও নয়। কিন্তু বলতেন বাংলা মাখিয়ে। তার এই বাংলা মাখানো ইংরেজি শোনার জন্যে মিডিয়া তার পিছু ছাড়তো না। তিনি নিজেও মিডিয়া পছন্দ করতেন। মিডিয়া দেখলেই তার মুখ দিয়ে সমানে ইংরেজি বের হতো। একদিন বের হলো, “উই আর লুকিং ফর চোর!”
মজা পেয়ে পাবলিক লুফে নিল। খালেদা কেবিনেটের জাঁদরেল মিনিস্টিার সাইফুর রহমানের কথাও পাবলিক মাঝেমধ্যে লুফে নিত। তিনি অর্থমন্ত্রী। কথা তাঁকে বলতেই হয়। যেমন তেমন কথা নয়, অর্থনীতি নিয়ে কথা। একবার গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের তুলোধুনো করতে গার্মেন্টস শিল্পকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বসলেন। তাদের কাজকে দর্জির কাজের সাথে তুলনা করলেন। সিলেটি ভাষায় করা তাঁর তুলনা চাউর হলো মানুষের মুখে মুখে, “এইতা খলিফা-দর্জির কাম কইরা দেশোর কিতা অইবোরে, বাপ?”
আওয়ামী আমলের সিলেটি মিনিস্টার মহসিন আলী। খুব ভাল একজন মানুষ ছিলেন। ছিলেন এলাকার জনগণের চোখের মনি। গরীবের বন্ধু। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত জনগনের সেবায় আত্মনিয়োগ করে গেছেন। অথচ প্রচন্ড জনপ্রিয় এই মানুষটি মন্ত্রী হিসেবে প্রায় প্রতিদিনই মিডিয়ায় বিতর্কিত হতেন। বিতর্কিত হতেন প্রকাশ্য সভায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে, নয়তো সিগারেট টেনে টেনে। অথবা বেফাঁস কথা বলে বলে।
বেফাঁস কথা না হলেও অন্তত মন্ত্রী হিসেবে মিডিয়ায় বলা যায় না এমন ধরণের কথা হরহামেশাই বলতেন মন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। সকালে বলতেন, বিকেলে বলতেন। ক্যামেরা পেলেই বলতেন। মহসিন আলী কিংবা সাইফুর রহমানের মত তিনিও সিলেটি। ইংরেজিতে তিনি বেজায় বাকপটু ছিলেন। কথা বলতেন ইংরেজিতেই বেশি। বলতেন আর ট্রল হতেন। ট্রল হওয়া বহুল প্রচলিত তাঁর একটি শব্দ ছিল “রাবিশ”। কিছু একটু হলেই বলতেন “রাবিশ”।
তাঁরই আপন ছোট ভাই বর্তমান পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুল মোমেন। মন্ত্রী হিসেব যথেষ্ঠ সক্ষমতার স্বাক্ষর রাখছেন। যে কোন বিষয় বোঝেনও বেশ ভাল। কোন জটিল বিষয়ও খুব সহজভাবে মোকাবেলা করতে পারেন। এসব করে বারবার বুদ্ধিমত্তার পরিচয়ও দিচ্ছেন। কিন্তু দোষ ঐ এক জায়গায়। অসাবধানতায় মাঝেমধ্যেই “মন্ত্রী হিসেবে মুখ ফসকে বলা উচিত নয়”এমন কথাও বলে ফেলেন। একবার দুবার নয়, এমন কথা বলেছেন অনেক বার। আর বার বারই সরকারকে করেছেন বিব্রত।
ইদানীং সরকারকে বিব্রত করার কাজ স্বীয় উদ্যেগে নিজ ঘাড়ে নিয়েছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী আব্দুল মান্নান। তিনিও সিলেটি মন্ত্রী। পলিটিশিয়ান না হলে যে সমস্যা, সেই জটিল সমস্যায় আক্রান্ত তিনি। কিছুদিন আগে তিনি ফেঁসেছেন সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করা নিয়ে কথা বলে। সন্দেহ নেই, পেনশন স্কিম খুব ভালো উদ্যোগ। কিন্তু বিরোধীরা শুরু থেকেই বলে আসছিল এই কর্মসূচি টাকা মারার জন্য চালু করা হয়েছে।
তিনি হুদাই তাদের দাবীতে ঘি ঢেলে দিলেন। মিডিয়া পেয়ে বলে দিলেন, এই স্কিম থেকে সরকার তার প্রকল্পগুলোতে লোন নেবে। কথাটি সত্যি। কিন্তু মোটেও বলার দরকার ছিল না। দুনিয়াশুদ্ধ সরকারই এমন খাত থেকে প্রয়োজনে লোন নেয়। আবার ফেরত দেয়। এটা মোটেও দোষের কিছু না। যে কোন স্কীমের টাকা ব্যবহার করার অধিকার রাখে সরকার। কিন্তু বাংলাদেশের সার্বিক প্রেক্ষাপটে তাঁর এই কথাটি মিডিয়ায় খোলামেলা বলে দেয়াটা নেহায়তই শিশুসুলভ হয়েছে। মন্ত্রীসুলভ হয়নি। যেন নিজের হাতে সেঁধে বিরোধীদের হাতে সমালোচনার কুঠার তুলে দিলেন।
আরো ক’দিন আগে,“পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অনেক পরিকল্পনার সাথেই তিনি থাকেন না”বলে বোমা ফাটিয়ে সরকারকে বেজায় বিব্রত করেছেন। এবারও করলেন। যেনতেন পটকা বোমা নয়, একেবারে যেন ককটেল। জানি না, তাঁর মত ককটেল নিয়ে সরকারের ভেতরে আর কে কে বসে আছেন! নির্বাচন সামনে রেখে দেশ এবং দেশের বাইরে মিসাইল নিয়ে বসে থাকাদের কথা দেশবাসী কমবেশি জানে!! শুধু জানে না দেশের ভাগ্যে আসলে কি আছে!!!

-লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা ডট কম।