Home মতামত বিচারপতি নাজমুল আহাসান : একজন আদর্শবান মানুষের বিদায়

বিচারপতি নাজমুল আহাসান : একজন আদর্শবান মানুষের বিদায়

102

আহমেদ জালাল : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এফ. আর. এম নাজমুল আহসান ছিলেন একজন আদর্শবান, দায়িত্ববান ও ন্যায়পরায়ণ মানুষ। যিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে কাজ করে গেছেন। সৎ, সজ্জন, বিনয়ী, নির্ভীক-এমন অনেক বিশেষণ গুণে তিনি গুণান্বিত ছিলেন। নীতি-নৈতিকতা ছিল তাঁর অনন্য সম্পদ। সততা ও আদর্শনিষ্ঠার জন্য জীবদ্দশায়ই তিনি হয়ে ওঠেন প্রবাদপুরুষ। দেশের গরিব মানুষের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আজীবন তিনি কাজ করে গেছেন। দরিদ্র অসহায় মানুষকে ন্যায়বিচার পেতে সহায়তা করেছেন। ‘পৃথিবীতে সকলকেই একদিন না একদিন চলে যেতে হবে। কিন্তু চলে যাওয়া মানেই ভুলে যাওয়া নয়। কিছু মানুষ তাঁদের কর্মগুণে যুগের পর যুগ, সময়ের পর সময় ধরে বেঁচে থাকবেন।’ তাঁর মতো মানুষদের প্রস্থান আছে, মৃত্যু নেই।
বিচারপতি নাজমুল আহাসান এর মহাপ্রয়াণে যে শূন্যতা তৈরি হলো তা সহজে পূরণ নয়, তেমনিভাবে তাঁর জন্মস্থান বরিশালে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। পরিবার-স্বজন, নেতাকর্মী, শুভানুধ্যায়ী সবার মাঝেই এখন নিস্তব্ধতা, নীরবতা। আবেগভরা কণ্ঠে তাঁরা বলছেন-আফসোস, এরকম সৎ ও নিষ্ঠাবান মানুষ নেই, প্রিয় মিজান ভাই নেই। শুক্রবার (৪ ফেব্রুয়ারি) ভোর সোয়া ৬টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন বিচারপতি নাজমুল আহাসান। আদর্শবান এই ব্যক্তির মহাপ্রয়াণের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে তাঁর সহকর্মী, আইনজীবী ও ভক্তদের স্ট্যাটাস আর ছবিতে ছেয়ে যায় ফেসবুক।
বিচারপতি এফ. আর.এম নাজমুল আহসান(মিজান) ছাত্রজীবন থেকে প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদেরও নেতা ছিলেন। ১৯৭৭ সালে মহান স্বাধীনতার প্রতীক অপরাজেয় বাংলা রক্ষার আন্দোলনে তৎকালীন সামরিক সরকার কর্তৃক গ্রেপ্তার হয়ে ৬ মাস কারাবরণ করেন তিনি।
১৯৫৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বরিশালের হিজলা উপজেলার মেমানিয়া ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন এফ আর এম নাজমুল আহাসান। তাঁর পিতার নাম মো. আনোয়ার হোসেন ও মাতার নাম জাহানারা বেগম। তিনি সরকারি ব্রজমোহন কলেজ থেকে বিএ (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর বরিশাল ল’ কলেজ থেকে এলএলবি পাস করে ১৯৮৬ সালের ১৮ মার্চ বরিশাল জেলা আদালতের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে কাজ শুরু করেন। ১৯৯৪ সালের ২২ জানুয়ারি হাইকোর্ট বিভাগের ও ২০০৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন তিনি। ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। ২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল স্থায়ী হন। সংবিধান অনুয়ায়ী বিচারপতিদের অবসরের বয়স ৬৭ বছর। এ হিসেবে নাজমুল আহাসানের অবসর গ্রহণের তারিখ ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি।
সর্বশেষ আপিলেট ডিভিশনের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন নাজমুল আহাসান।
গত ৯ জানুয়ারি নাজমুল আহাসান সহ চার বিচারপতি আপিল বিভাগে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান এবং বিচারপতিরা শপথ নেন। বিচারপতি বোরহান উদ্দিন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ শপথের পর সেদিন থেকেই তাঁরা আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে বিচারকাজ পরিচালনা করে আসছেন। তবে বিচারপতি নাজমুল আহাসান করোনায় সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকায় সেদিন শপথ নিতে পারেননি।
শুক্রবার (০৪ ফেব্রুয়ারি) রাত ৯টার দিকে বরিশাল অশ্বিনী কুমার হলের সামনে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান এর কফিনে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অসংখ্য মানুষ অংশগ্রহণ করেন। দ্বিতীয় জানাজা শেষে বরিশাল অশ্বিনী কুমার হল চত্বরে নাগরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হয়। এ সময় বিভিন্ন পেশাজীবী, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে বিচারপতির কফিন নগরীর কাউনিয়া জানকিসিংহ রোডের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে শেষবারের মতো বিদায় জানান প্রয়াতের মা সহ স্বজনরা। এরপর বরিশাল নগরীর মুসলিম গোরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। দ্বিতীয় জানাজায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বরিশাল জেলা ও দায়রা জজ মো. রফিকুল ইসলাম, চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মহিবুল ইসলাম, চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কবির উদ্দিন প্রামাণিক, বিভাগীয় কমিশনার মো. আমিন-উল-আহসান, জেলা প্রশাসক (ডিসি) জসীম উদ্দীন হায়দার, বরিশাল জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির (জাপা) নেতৃবৃন্দ, সিপিবি নেতৃবৃন্দ, ওয়ার্কার্স পার্টি নেতৃবৃন্দ, বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির নেতৃবৃন্দ, বঙ্গবন্ধু আইনজীবী সমিতি নেতৃবৃন্দ, বরিশাল প্রেসক্লাব, বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটি, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ সহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ। অংশগ্রহন করেন মরহুম বিচারপতির ভাই সাংবাদিক তৌফিক মারুফ, মরহুম বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসানের একমাত্র ছেলে তাঈম হাসান প্রান্ত, মরহুমের আরেক ভাই সাংবাদিক সি.এইচ. মাহবুব সহ আত্মীয়-স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষী, এলাকাবাসী।
এর আগে শুক্রবার (৪ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১১টা ২০ মিনিটে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে তার সহকর্মী বিচারপতি, আইনজীবীদের অংশগ্রহণে জানাজা সম্পন্ন হয়। জানাজায় প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম, আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান, বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিগণ, অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস কাজলসহ আইনজীবীরা এবং প্রয়াত বিচারপতির ছেলে তাঈম হাসান প্রান্ত অংশ নেন।
বিচারপতি নাজমুল আহাসানের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিচারপতি নাজমুল আহাসানের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।-লেখক : নির্বাহী সম্পাদক ও বার্তা প্রধান, রণাঙ্গণের মুখপত্র “বিপ্লবী বাংলাদেশ”।