Home মতামত বাঁকা চোখে আঁকা ছবি (পর্ব-৪)!!!

বাঁকা চোখে আঁকা ছবি (পর্ব-৪)!!!

33

সরদার মোঃ শাহীন:

এই লেখাটি যখন প্রকাশিত হবে, তখন কেমন হবে জানি না। কেমন থাকবে তাও জানি না। তবে এখন, মানে লেখাটি যখন লিখছি, তখন গরম পড়েছে প্রচন্ড রকমের। বাইরে বেরুনো দায়। গা পুড়ে যায়। তাপমাত্রা যেমন তেমন, বাতাসের আদ্রতায় কষ্টের মাত্রাটা অস্বাভাবিক রকমের বেশি। গা ঘেমে যায়। ঘামের কারণেই আমাদের দেশের গরমকে বলে ভ্যাপসা গরম। ভ্যাপসা গরম গা থেকে প্রচুর ঘাম ঝড়ায়। আদ্রতা বেশি বলেই ঘাম ঝরে।
মধ্যপ্রাচ্যে তাপমাত্রা দেশের চাইতেও অনেক বেশি। তারপরও ওখানকার আবহাওয়া সহনীয়। সহ্য করা যায়। কারণ একটাই, ওখানে ভ্যাপসা গরম নেই। ওখানে বাতাসের আদ্রতা অনেক কম। অনেকটা শীতপ্রধান দেশের মত। শীতপ্রধান দেশে বাতাসের আদ্রতা ৭০% এর নীচে থাকে। গরমের দেশেও অনেকটা সে রকমই। তাই ওরা কঠিন মাত্রার তাপমাত্রাতে থেকেও ভ্যাপসা গরম না থাকার কারণে গরমের দিনে ক্লান্ত হয় না। ক্লান্ত হই আমরা। এই বাংলাদেশের মানুষেরা।
বাংলাদেশের বাতাসে আদ্রতা বা হিউমিডিটি যেমনি বেশি, তেমনি হা-হুতাশটাও বেশি। এই হা-হুতাশ দিয়েই আমাদের দিন শুরু হয়। শেষও হয় হা-হুতাশ দিয়ে। একরাশ হা-হুতাশের সংবাদ নিয়ে আমরা নিত্যদিন ঘুমাতে যাই। আমাদের মিডিয়ায় সংবাদের ভালো দিক নিয়ে এমন কোন সংবাদ নেই যা নিয়ে মানুষের আনন্দ হয়। ভালো সংবাদের ফলোআপ নিয়ে মিডিয়ায় কোন বিশে−ষণ নেই। আছে শুধু নেগেটিভ সংবাদের ফলোআপ। মিডিয়া শুধু নেগিটিভিটি খোঁজে। মানুষকে নেতিবাচক তথ্য দেয়া, ইতিবাচককে আড়াল করা আর সত্য অথচ পজিটিভ সংবাদকে জোরালো ভাবে প্রকাশ না করাই যেন সমসাময়িক সময়ের মিডিয়ার অন্যতম দায়িত্ব হয়ে উঠেছে।
ধরা যাক গাজীপুরের নির্বাচন। গাজীপুর নির্বাচনের সুষ্ঠুতা, সুশৃঙ্খলতা এবং নিরপেক্ষতা নিয়ে নির্বাচন পরবর্তী কোন লেখা তেমন করে আজও আমার চোখে পড়েনি। পড়েছে শুধু জয়পরাজয়ের বিশ্লেষণের সংবাদ। বিজিত প্রার্থীর পরাজয় মেনে নেয়াটাও সংবাদ হতে পারতো। সেটাও হয়নি। গণতান্ত্রিক পরিবেশে এর চেয়ে সুস্থ এবং ভালো সংবাদ আর কি হয়! কিন্তু সেটাও এখানে হলো না। উল্টো পরাজয়ের কারণগুলো বিশ্লেষণ হয়েছে বেশি। চেষ্টা হয়েছে পরাজিত প্রার্থীকে পঁচানোর।
অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন খুব ভালো মাত্রায় প্রশংসা পেতে পারতো। তাদের এসব ভালো কাজগুলো হাইলাইট হতে পারতো। কিন্তু মিডিয়া সেদিকে হাঁটেনি। হেঁটেছে আমেরিকান ভিসানীতি নিয়ে। চেপে ধরেছে নির্বাচন কমিশনকে। বলার চেষ্টা করা হয়েছে, আমেরিকান ভিসানীতি নিয়ে ঠেলা খেয়ে নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠ নির্বাচন করতে বাধ্য হলো কি না। এক পত্রিকা তো লিখেই ফেললো, আমেরিকার ঠেলায় ফাইভ পাশ মহিলাও মেয়র হয়ে গেল। ঠেলা আর একটু বাড়িয়ে দিলে সামনে কি হয়, বলা যায় না।
আসলে দেশের মিডিয়ার খবরের ধরনই এখন এমন। আমেরিকার ভিসানীতি যখন আস্তে আস্তে একটু পুরানো হয়ে উঠবে, নিশ্চয়ই নতুন কোন প্যানিক করার মত সংবাদ তখন নিউজ আইটেমে যোগ হবে। নিত্যদিন নতুন নতুন প্যানিক আইটেম যোগ হওয়া এদেশে তো নৈমত্তিক ব্যাপার। আর এমন সংবাদের যখন আকাল শুরু হয়, শত চেষ্টা করেও যখন নেগিটিভ সংবাদ পাওয়া যায় না, তখন শিরোনাম হয় মিথিলা আর পরীমনি। খুবই দামী সংবাদ; মিথিলা-সৃজিতের সংসার জীবন ভালো যাচ্ছে না কিংবা পরীমনির ছেলের দাঁত ওঠেছে।
এটাই আমাদের ধরণ। আমরা স্বাভাবিক সুস্থতায় যেমনি অনাগ্রহী, তেমনি সুষ্ঠতায়ও। আমরা সুষ্ঠ পথে না হেঁটে সুষ্ঠুহীনতায় হাঁটতে পছন্দ করি। কোন কিছু সুন্দর করে গোছাতে পারি না। কিন্তু অতীব সুষ্ঠ ও সুন্দর করে গোছানো যে কোন কিছুকে অগোছালো করায় পটু। হয়তো বাঙালি হিসেবে এটাই আমাদের ধরণ। বাঙালি হিসেবে আমার যখন যেটা মন চায়, সেটাই করি। লক্ষ্য করছি, বেশ কিছুদিন যাবত আমরা বাংলা বর্ণমালার স্বীকৃত এবং বহুল ব্যবহৃত বিষর্গ (ঃ) অক্ষরটি ব্যবহারের দিক দিয়ে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছি।
কয়েক বছর আগের কথা। একদিন আমার অফিসে এলাকার খুবই চেনাজানা এবং নেতৃত্বগোছের একজন চিকিৎসক এলেন। তিনি যত না চিকিৎসক, তার চেয়েও বেশি পরিচিত সমাজের একজন সেবক হিসেবে। খুবই সচেতন এবং সারাক্ষণ সমাজ উন্নয়নে কাজ করা একজন মানুষ। বক্তৃতা বিবৃতিতে সমাজের অসঙ্গতি সবসময় তুলে ধরে এর প্রতিকার কামনা করেন। কামনা করেন তাঁর কর্মে এবং স্যোশ্যাল মিডিয়ায় লেখালেখিতে।
আমার কাছে আসার একমাত্র কারণ, তাঁর কোন এক লেখা ছাপাতে যেয়ে তাঁর নামের আগে ডাক্তার লিখতে যেয়ে সংক্ষেপে ড. না লিখে আমি কেন ডঃ লিখলাম। সব শুনে অতীব বিনীত ভাবে বললাম, ইংরেজি বর্ণমালার ডট (.) অক্ষরটি আমি কেন বাংলায় ব্যবহার করবো। আমার বাংলা ভাষায় বর্ণমালা হিসেবে (.) এর তো কোন অস্তিত্বই নেই। আছে বিষর্গ (ঃ)। আমি বিষর্গ অক্ষরটি ব্যবহার করেছি। জন্ম থেকেই এমনি ব্যবহার করে আসছি।
তিনি আমার যুক্তি খন্ডাতে পারেননি। কিন্তু আমার যুক্তি মেনেও নেননি। মিটমিট করে তাঁর কথা একটাই; সবাই এখন এভাবেই লিখছে, আমার লিখতে সমস্যা কোথায়? বুঝতে ছিলাম তাঁর চোখে বাংলার বিষর্গ (ঃ) অক্ষরটি খুব একটা স্মার্ট নয়। তাই তিনি ড এর পরে ইংরেজি ডট বা ডেসিমাল (বাংলায় দশমিক) বসিয়ে ভাষার বারোটা বাজাতে চাচ্ছেন। তাই মনে মনে কিছুটা বিরক্ত হলেও মুখে বিনয়ের ভঙিমাতেই তাঁকে জানিয়ে ছিলাম, সবাই হুজুগের স্রোতে গা ভাসাচ্ছে। কিন্তু আমি পারছি না। আমায় ক্ষমা করবেন।
এরপর থেকে তিনি কোনদিন আমায় আর কোন লেখা দেননি। হয়ত আমায় অতি পন্ডিত ভেবে মনে মনে ভৎসনাও করেছেন। তা তিনি করতেই পারেন। কিন্তু আমি তো জেনেশুনে আমার বাংলা ভাষার অমর্যাদা করতে পারি না। এ তো আমার রক্ত দিয়ে কেনা ভাষা! এর একটা নিজস্বতা আছে। নিয়মকানুন আছে। আমি চাইলাম আর নিত্যদিন পাল্টে দিলাম এমনটা তো নয়। বাংলায় ডটেরও স্বতন্ত্র ব্যবহার হয়। তবে শব্দের ভিতরে নয়। ব্যবহার হয় সংখ্যার ভিতরে। সংখ্যার ভেতরে অঙ্কের সঙ্গে, যাকে ইংরেজিতে ‘ডেসিমাল পয়েন্ট’ বা ‘পয়েন্ট’ এবং বাংলায় ‘দশমিক বিন্দু’ বা ‘দশমিক’ বলে। তবে বাংলা বর্ণমালায় মাত্র পাঁচটি জায়গায় ডট বা বিন্দুর ব্যবহারও আছে। সেটা স্বতন্ত্র ভাবে নয়। মাত্র পাঁচটি বর্ণের সঙ্গে গ্রথিত ভাবে আছে। ব-বিন্দু র/ড-বিন্দু ড়/ঢ-বিন্দু ঢ়/অন্তঃস্থ য়/চন্দ্রবিন্দু ঁ। বাংলায় ‘দুই দশমিক পাঁচ’ (২.৫) দিয়ে আড়াই বুঝালেও ‘ড দশমিক’ (ড.) বোঝানো যায় না। বোঝাতে গেলে জাষ্ট ফাতরামো করা হবে।
সমসাময়িক সময়ের বাংলা ভাষার প্রধান কবি শামসুর রাহমান তাঁর প্রিয় বাংলাভাষার দূরাবস্থা দেখে বড় আক্ষেপ করে বর্ণমালাকে ‘আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। এবং এ নিয়ে একটা কালজয়ী কবিতাও লিখেছিলেন। তাঁর লেখা কবিতার শেষ ক’টি লাইন ছিল এমন,
‘এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি,
এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষমাস।
তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’!!
বাংলা ভাষাকে নিয়ে বাঙালির এমন নোংরামী বা উদাসীনতা কবি শামসুর রহমান ঠিকই বুঝেছিলেন। এবং আমাদেরকে বোঝাবার জন্যে কলমও ধরেছিলেন। কিন্তু আমরা হয় বুঝতে পারিনি, নয় উদাসীনতা দেখিয়েছি। সাবধান হইনি মোটেও। তাই ভাষাকে নিয়ে বাজে এবং ফাতরামো চর্চা আজও অব্যহত আছে। এভাবেই যদি এই চর্চা অব্যহত থাকে, তাহলে বাংলা ভাষা একদিন কতটা দুর্দশায় নিমজ্জিত হবে তা বলাই বাহুল্য।
সুতরাং নিঃসংকোচেই বলছি, রুখে দেয়ার সময় হয়েছে। আর দেরী করা ঠিক হবে না। চলুন এখন থেকেই সবাই সতর্ক হই এবং রুখে দেয়ার চেষ্টা করি। চেষ্টা করলে বাঙালি কী না পারে! যে জাতি একদিন উর্দুকে পায়ে ঠেলে বুকের রক্ত ঢেলে বাংলাকে বুকে ধারণ করেছে, সে জাতি চাইলে সব পারে। ফাতরামোদের সকল ফাতরামি চিরতরে বন্ধ করে দিতে পারে!!!

-লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা।