Home মতামত বরিশালে অবসান ঘটবে কি দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি?

বরিশালে অবসান ঘটবে কি দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি?

190

আহমেদ জালাল : দেশজুড়ে আলোচিত-সমালোচিত ঘটনাটির বিষয়ে এখানকার বর্তমান বরিশাল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি ও বিচক্ষণতার ঘাটতি আছে কিনা? দলের মধ্যে নেতৃত্বে শূন্যতা রয়েছে কিনা? দলের ত্যাগী-নিবেদিত প্রাণ নেতাকর্মীদের বঞ্চিত-লাঞ্ছিত-নির্যাতন সহ সর্বোপরি অবমূল্যায়নের প্রশ্নও উঠেছে। বর্তমান বরিশাল আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ে নিরবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ত্যাগী একাধিক নেতা। কমিটির নেতৃত্বে যোগ্য-অযোগ্যতার প্রশ্ন রাজনৈতিক অঙ্গনসহ নানান শ্রেনী পেশার মানুষের মাঝে। অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব আর দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি কী বরিশাল আওয়ামী লীগে বর্তমানে ত্রাহিদশা চলছে? সমাজে যে যত বড় মাপের দুর্বৃত্ত, সে তত বড় ক্ষমতাবান। তারা অস্ত্রধারী, লাঠিয়াল বাহিনী কর্তৃক সমাজে ত্রাস সৃষ্টি করে। এই দুর্বৃত্তরা সন্ত্রাস সৃষ্টি করে, শুধু বিরুদ্ধ রাজনৈতিক দল নয়, নিজ দলেরও নেতা, কর্মী ও সমর্থক আর নিরীহ জনসাধারণকে ভীত সন্ত্রস্ত রেখে দলের ও নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু অবসান ঘটবে কি দুর্বৃত্ত রাজনীতির? থানা কাউন্সিল ও ইউওনও’র বাসভবনে ভয়ঙ্কর সেই রাতে কী ঘটেছিল? প্রশ্ন উঠেছে, ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মামলাগুলো স্বাভাবিক নিয়মে শেষ হবে বা চলবে কিনা? শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষের চারটি মামলাই যদি গতিহীন হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে বিস্ময়ের কিছু কী থাকবে? তবে জনমনের প্রশ্ন থাকবে ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে ওঠা এক শ্রেণির দুর্বৃত্ত ও অপরাধী চক্র কিভাবে বেপরোয়া হয়ে দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতিতে লিপ্ত হয়ে পড়েন? শান্তিপ্রিয় মানুষ আশা করে, বরিশালে দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতিতে ঘটে যাওয়া সকল অপরাধের যৌক্তিক বিচার হবে।
বলাবাহুল্য, কয়েক বছর আগে বরিশালের কোনো এক উপজেলার ইউএনওকে নিয়ে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা পাঁচ কোটি টাকার মানহানির মামলা করেছিলেন। এ মামলাকে আমলে নিয়ে বরিশালের সিএমএম আদালত ওই ইউএনওর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। ইউএনও আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে মামলা প্রত্যাহার করা হয়। সৈয়দ ওবায়েদ উল্লাহ সাজু নামের ওই মামলাকারী দলীয় নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। ইউএনওকে অযথা হয়রানির জন্য ছয় পুলিশ সদস্য প্রত্যাহৃত এবং আইন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে বরিশালের সিএমএম মো. আলী হোসেন অন্যত্র বদলি হন। মামলায় অভিযোগ ছিল, ইউএনওর ছাপানো দাওয়াতপত্রে ‘বঙ্গবন্ধুর বিকৃত ছবি’ ব্যবহার করেছেন। মামলার বিষয়টি প্রচার হওয়ায় এর বাদী সৈয়দ ওবায়েদ উল্লাহ সাজুর বেশ বেকায়দায় পড়েছিলেন। বরগুনায় বদলি হওয়ার আগে ইউএনও সালমান দায়িত্ব পালন করেছিলেন বরিশালের আগৈরঝাড়ায়। আর সেখানের একটি ঘটনাতেই মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। মামলায় শুরুতে তাঁর জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠান বিচারক। পরে অবশ্য আদেশ পাল্টে জামিন দেয়া হয়। ওই বছরের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবসে উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ শিরোনামে সেখানে এক চিত্রাংকন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় আগৈলঝাড়ার এস এম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। এই প্রতিযোগিতার প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অর্জনকারী দুটি ছবির জন্য তাদেরকে পুরস্কৃত করা হয়। আর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদযাপনে উপজেলা প্রশাসনের আমন্ত্রণপত্রে ছবি দুটি ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে প্রথম স্থান পাওয়া জ্যোতি মন্ডলের ছবিটি আমন্ত্রণপত্রের কভারে এবং অদ্রিজা করের দ্বিতীয় ছবিটি ব্যবহার করা হয় আমন্ত্রণপত্রের পেছনের পাতায়। পেছনের পাতায় ছাপা হওয়া ছবিটির জন্যই ইউএনও গাজী তারিক সালমানের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতের অভিযোগে মামলা করেন আওয়ামী লীগ নেতা সাজু। এই ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যেও অসন্তোষ দানা বাঁধে। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এই মামলায় বিস্ময় এবং অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বলে জানিয়েছেন তাঁর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম। এই পরিস্থিতিতে তৎকালীন সময়ে ইউএনও গাজী তারিক সালমানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার করা হয়।
ওদিকে, বর্তমান বরিশাল আওয়ামী লীগে ত্যাগীদের বিপরীতে অনুপ্রবেশকারীদের মূল্যায়িত করার অভিযোগ উঠে। একসময়ের তুখোড় ছাত্রলীগ নেতা বিশিষ্ঠ সমাজসেবক আলহাজ্ব মাহমুদুল হক খান মামুন ক্ষোভ প্রকাশ করে গণমাধ্যমে বলেছেন, ত্যাগীদের পুরোপুরি অবমূল্যায়ন করে অনুপ্রবেশকারী নব্যদের দলে ঠাঁই দেয়া হয়েছে। এসব কারণে দলের ত্যাগী, অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতাদের অধিকাংশ নিষ্ক্রিয় রয়েছেন বলে মন্তব্য করেন রাজপথ কাঁপানো সাবেক ছাত্রনেতা খান মামুন। বিশেষ করে এ্যাড. শওকত হোসেন হিরণের অকাল মৃত্যুর পর বরিশাল আওয়ামী রাজনীতিতে নেতৃত্বে চরম শূন্যতা বিরাজ করে। এরকম অবস্থায় একপর্যায়ে বরিশালে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অভিষেক ঘটে জেলা আ’লীগের সভাপতি জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ(এমপি)’র জ্যেষ্ঠ পুত্র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ’র। পরে বরিশাল সিটি মেয়র পদে আসীন হন তিনি। আর দলের একটি অংশ পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী (কর্নেল অব:) জাহিদ ফারুক শামিম এর রাজনীতির সঙ্গে অংশ নেন। অনুসন্ধানী সূত্রগুলো বলছে, দীর্ঘদিন ধরে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব:) জাহিদ ফারুক শামিম (এমপি)’র সঙ্গে সিটি মেয়র সেনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ’র রাজনৈতিক-মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব চলছিল। গত ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় নগরীর সাগরদী এলাকায় বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগ সভাপতি জসিম উদ্দিনের বাড়ি বুলডেজার দিয়ে গুড়িয়ে দিয়েছিল সিটি কর্পোরেশন। এতে ক্ষোভ জন্মে আ’লীগের একাংশের মাঝে। জসিম প্রয়াত মেয়র এ্যাড. শওকত হোসেন হিরণপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। প্রয়াত মেয়র হিরণের অকাল মৃত্যুর পর পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব:) জাহিদ ফারুক শামিম (এমপি)’র সঙ্গে সময় দিচ্ছিলেন জসিম। ছাত্রলীগ নেতা জসিম উদ্দিন তখন গণমাধ্যমে বলেছিলেন, প্রয়াত মেয়র জননেতা এ্যাড. শওকত হোসেন হিরণের অকাল মৃত্যুর পর পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব:) জাহিদ ফারুক শামিম (এমপি)’র সঙ্গে থেকে রাজনীতি করার কারণে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে সিটি মেয়র অবৈধভাবে আমার বাড়ি বুলডেজার দিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছেন। পরে বুলডেজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়া বাড়ি পরিদর্শনও করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব:) জাহিদ ফারুক শামিম (এমপি)। ওই সময়ে মহানগর ছাত্রলীগ সভাপতি জসিম উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, তিনিসহ অপর দুই ভাই মনির হোসেন ও অসিম হাওলাদারের নামে মহাসড়কের পাশে সাগরদী এলাকায় ক্রয়কৃত ৮ শতাংশ জমিতে ৭ তলা ভবন নির্মাণের জন্য ২০১৭ সালে সিটি করপোরেশন থেকে প্ল্যান অনুমোদন নেন। নিয়ম মেনে ২০১৯ সালে নির্মাণ কাজ শুরু করেন। সিটি করপোরেশনের দেখিয়ে দেয়া সীমানার মধ্যেই তিনি বহুতল ভবনের একতলার ছাদ সম্পন্ন করেন। কোন কারণ ছাড়াই সিটি করপোরেশন বুলডোজার দিয়ে তাদের একতলা ভবনের একাংশ গুড়িয়ে দেয়। এ ঘটনাকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলে দাবি করেন তিনি। জসিম উদ্দিন তাঁর ওপর রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ করলেও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের দাবি করেছিল সিটি করপোরেশন। এছাড়া বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী ক্ষমতাধর নেতা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন নিরব হোসেন টুটুল। একসময়ে ৭ নং ওয়ার্ড বিএনপি’র এক নেতার ক্যাডার হিসেবে কাজ করার ঢের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তৎকালীন সময়ে টুটুল নগরীর নাজিরের পুলে একচ্ছত্র মাদক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন। পাইকারী ফেন্সিডিল বিক্রি করতেন তিনি। এই নিরব হোসেন টুটুল যিনি কিনা বরিশালের দন্ডমুন্ডের কর্তা, এরকম অভিযোগ খোদ আওয়ামী লীগের ত্যাগী, নিবেদিত একাধিক নেতার।
বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি জসিম উদ্দিনের ওপর পোর্টরোডে সন্ত্রাসী হামলা : ২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল বরিশাল নগর ছাত্রলীগের সভাপতি জসিম উদ্দিনের ওপর পোর্টরোড এলাকায় মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ অনুসারিরা সন্ত্রাসী হামলা চালানোর অভিযোগ উঠে।
ওই দিন দুপুরে নগরীর পোর্ট রোড ইলিশ মোকামে তাঁদের ওপর হামলা করে পিটিয়ে আহত করা হয়। তৎকালীন সময়ে ছাত্রলীগ সভাপতি মো. জসিমউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, কয়েকটি ইলিশ মাছ কিনতে মোটরসাইকেলে করে দুই কর্মীকে নিয়ে দুপুর ১২টার দিকে ইলিশ মোকামে যান। মাছ কিনে ফেরার সময় মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাদিক আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ সহযোগী নগর আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক নীরব হোসেন টুটুল এবং ছাত্রলীগ ক্যাডার রইস আহম্মেদ মান্নার নেতৃত্বে ২৫-৩০ জন সন্ত্রাসী লাঠিসোঁটা নিয়ে বর্বরোচিত কায়দায় সন্ত্রাসী হামলা চালায়। ওই সময়ে জসিম ও তাঁর দুই ছাত্রলীগ কর্মী হাসান ও প্রিন্সকে বেদম মারধর করেন তারা। একপর্যায়ে তারা দৌঁড়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করে মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা নীরব হোসেন টুটুল সাংবাদিকেদর বলেছিলেন, জসিমের অভিযোগ পুরোপুরি ভিত্তিহীন এবং মিথ্যা। জসিমের সঙ্গে তার (টুটুল) দেখাই হয়নি, হামলা তো দূরের কথা। ছাত্রলীগ সভাপতি জসিমের অভিযোগ ত্রাসের রাম রাজত্ব কায়েমে এরকম অসংখ্যবার তার ওপর আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী হাইব্রিডরা সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে এক ভয়ার্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এরফলে এদের সন্ত্রাসী হামলাসহ নানান কায়দায় তাকে ফাঁসিয়ে দেয়ার ঘৃন্যতম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকায় আমাকে জীবনের চরম নিরাপত্তাহীনতার মাঝে বসবাস করতে হচ্ছে।
এ্যাড. শওকত হোসেন হিরণের অকাল মৃত্যুর পর বরিশালের আওয়ামী রাজনীতির চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়ে। বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন প্রয়াত মেয়র হিরণ। নেতৃত্ব শূন্যতার একপর্যায়ে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের কর্ণধর হিসেবে আসীন হন সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। অভিযোগ উঠে, হিরণপন্থীসহ দলের ত্যাগী নেতাদের অবমূল্যায়নের পাশাপাশি সাদিক অনুসারী কর্তৃক তাদের ওপর মনস্তাতিক চাপ প্রয়োগ ও নির্যাতন করা হয়।
বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক অসীম দেওয়ানের বাসভবনে গুলিবর্ষ-হামলা-ভাঙচুরের তাণ্ডব : ২০১৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক অসীম দেওয়ানের কাউনিয়া প্রথম গলির বাসভবনে গুলি ও ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়েছিল। কারা হামলা চালিয়েছিল, কার নির্দেশে কেন হামলা চালিয়েছিল? তৎকালীন সময়ে অসীম দেওয়ান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, রাতে ২০-২৫ জনের একটি দল ধারালো অস্ত্র নিয়ে বাড়িতে হামলা চালায়। হামলাকারীরা কয়েকটি গুলি ও ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। খবর পেয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগেই তারা পালিয়ে যায়। অসীম দেওয়ান বলেছিলেন, কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা সেরনিয়াবত সাদিক আবদুল্লাহর নির্দেশে দলে যাঁদের পদ-পদবি নেই এবং মাদক ব্যবসায়ী, তাঁরা ওই হামলা চালিয়েছেন। তৎকালীন সময়ে মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, অসীম দেওয়ান মহানগর ছাত্রলীগের সঙ্গে কাজ করুক, এটা চায় না প্রভাবশালী একটি মহল। যারা ১৯৯৬ সালে বরিশালে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল, তাদের অনুসারী এবং সরাসরি নির্দেশেই ওই হামলার ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এরআগে প্রতিপক্ষের চাপের মুখে মহানগর ছাত্রলীগের সম্পাদক অসীম দেওয়ান কয়েক মাস ধরে বরিশালের বাইরে অবস্থান করছিলেন। বাবা অসুস্থ হওয়ায় তিনি বরিশাল আসেন। পরদিনই তাঁর বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটল। মহানগর ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, ছাত্রলীগ ক্যাডার রইস আহম্মেদ মান্নার নেতৃত্বে এহেন জঘন্যতম হামলা চালিয়েছে।
ওই ঘটনায় অসীমের ছোট ভাই দেওয়ান আলেসীন এলিন বাদী হয়ে দ্রুত বিচার আইনে কাউনিয়া থানায় মামলা করেছিলেন। পরবর্তীতে বরিশাল মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক অসীম দেওয়ানের বাসায় হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের ১০ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। ওই ১০ আসামি হলেন সরকারি বরিশাল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কিসমত শাহরিয়ার, মহানগর ছাত্রলীগের কর্মী রইস আহম্মেদ মান্না ও তাঁর ভাই নাদিম মাহমুদ, কর্মী মশিউল আলম, সোহাগ, আরিফুর রহমান, বক্কর মামুন, মেহেদী হাসান, যুবলীগ নেতা কাজী জিয়াউদ্দিন ও তাঁর ছোট ভাই মো. অঞ্জন।
এরকম নানা ইস্যুতে বরিশাল আওয়ামী লীগে মধ্যকার মনস্তাতিক দ্বন্ধ-সংঘাত বিরাজমান। সাম্প্রতিক সময়ে সিটি করপোরেশনের ৬ কাউন্সিলর প্রতিমন্ত্রীর দেওয়া অনুদানের চাল দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করেন। এতে ক্ষুব্ধ হন মেয়র। পরে ছয় কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকে বিসিসির কর্মচারীদের তুলে আনা হয়। সূত্রের দাবী, ওই দ্বন্দ্বের জের ধরেই ব্যানার-পোস্টার ছিঁড়তে যান সিটি করপোরেশনের লোকজন ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ওই দ্বন্দ্বের জের ধরে বুধবার রাতে বিসিসি কর্মী এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মী প্রতিমন্ত্রীর ব্যানার-ফেস্টুন অপসারণ করতে গেলে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে বলে একাধিক সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
অপরদিকে, বরিশাল বিসিকে চাঁদার দাবিতে ফরচুন গ্রুপের ওপর হামলা : ২০২০ সালের গত ২৪ অক্টোবর দুপুরে বরিশাল বিসিকে ফরচুন গ্রপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এম জে ইন্ডাস্ট্রিজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক শফিউল আজমকে বেদম মারধর করেছিলেন দুর্বৃত্তরা। তাঁরা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, দুপুরে শিল্পনগরে এম জে ইন্ডাস্ট্রিজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক শফিউল আজমকে বেদম মারধর করে দুর্বৃত্তরা। এদিন চাঁদা দাবি করে তার বাণিজ্যিক গ্রুপটির এক পরিচালকের ওপর হামলা করে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক সমর্থনপুষ্ট এক দল চাঁদাবাজ। তাদের দাবি মোতাবেক অর্থ দিতে রাজি না হওয়াতেই আক্রমণের শিকার হন ওই পরিচালক। শিল্পোদ্যোক্তাদের অভিযোগ, স্থানীয় সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। প্রতিনিয়ত চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মের কারণে তাঁরা অতিষ্ঠ। এরআগে ২০ অক্টোবর দুর্বৃত্তরা মৌমিতা বেকারি নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের মালিক হিমাদ্রী শেখর সাহাকেও মারধর করে টাকা ছিনিয়ে নেয় এবং একটি গাড়ি ভাঙচুর করে। এম জে গ্রুপের মালিক শফিউল আজম বলেছিলেন, ‘আমার ও অপর এক শিল্পমালিকের ওপর হামলার ঘটনায় বিসিকের সব শিল্পোদ্যোক্তা উদ্বিগ্ন। সুষ্ঠু পরিবেশ ও নিরাপত্তা না পেলে এখানে কারখানা চালানো অসম্ভব। কারণ, সন্ত্রাসীরা নানাভাবে উদ্যোক্তাদের হেনস্তা করে ও চাঁদা চেয়ে শিল্পাঞ্চলের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে।’ একাধিক শিল্পমালিক অভিযোগ করেন, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় ওই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বিসিক এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করছে, শিল্পমালিকদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। ২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর বরিশাল বিসিক শিল্প নগরীর ফরচুন সুজ এর এক নারী শ্রমিককে ইভটিজিং এর ঘটনায় প্রতিবাদ করায় এম জি ইন্ডাস্ট্রিজের নিরাপত্তাকর্মী জাহাঙ্গীর কে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে রিফাত, মামুন সহ অজ্ঞাতনামা ৩/৪ জন যুবক নির্যাতন করেছিলেন। রিফাত মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ অনুসারী ছাত্রলীগ ক্যাডার রইজ আহমেদ মান্নার ভাগ্নে। ফরচুন সুজ এর নারী শ্রমিক কাজ শেষে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলে এম জে ইন্ডাস্ট্রিজ এর সামনে রিফাত, মামুনসহ সন্ত্রাসীরা মেয়েটিকে জোর পূর্বক শ্লীলতাহানীর চেষ্টা করে। মেয়েটি বাধা প্রদান করলে সন্ত্রাসীরা মেয়েটিকে চড় থাপ্পড় মারে। এসময় এম জে ইন্ডাস্ট্রিজ এর নিরাপত্তাকর্মী জাহাঙ্গীর এগিয়ে আসলে সন্ত্রাসী বাহিনী দেশীয় অস্ত্রসহ তার ওপর হামলা চালায়। তৎকালীন সময়ে সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ফরচুন গ্রুপ অব কোম্পানিজ। এক বিবৃতিতে ফরচুন গ্রুপ এ ন্যক্কারজনক ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে হামলাকারী সন্ত্রাসীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। অভিযোগ উঠে, এর আগেও বিভিন্ন সময়ে সন্ত্রাসী রইচ আহম্মেদ মান্না ও অনিক বাহিনীর লোকজন বিসিক শিল্পনগরীতে ছিনতাই ও চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটিয়েছে।
মূলত: গত ১৫ আগস্টের ‘জাতীয় শোক দিবস’-এর পোস্টার ছেঁড়াকে কেন্দ্র করে বরিশালে বাকবিতণ্ডা, সংঘর্ষ, ইউএনও’র বাসভবনে হামলা পরবর্তীতে নিরাপত্তাকর্মীদের গুলিবর্ষনের ঘটনায় দেশজুড়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা রূপ নেয়। অভিযোগ উঠে, বরিশাল নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ’র ইশারা-ইঙ্গিতে রাতের আধারে ইউএনও’র বাসভবনে হামলা চালায় তাঁর অনুসারীরা। সরকারি কাজকর্মে বাধাদান একটি গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। রাতের আধারে কোনো সরকারি কর্মকর্তার বাসভবনে রাজনৈতিক পরিচয়ের ব্যানারে সংঘবদ্ধভাবে চড়াও হওয়াটা কতটা অসভ্য আচরণ, ফৌজদারি অপরাধ? হামলার ঘটনার পর ১৯ আগস্ট রাতে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত এক বৈঠক শেষে গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তাঁরা বলেছেন, ‘আইনের মাধ্যমেই দুর্বৃত্তদের মোকাবিলা করা হবে এবং আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।’ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বরিশাল বিভাগ মেয়রের অত্যাচারে অতিষ্ঠ বলে অভিযোগ করে তাঁর গ্রেপ্তার দাবিও জানানো হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ ও তাঁর দুর্বৃত্ত বাহিনী সিটি করপোরেশনের কর্মচারীদের দিয়ে নানা প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে ও বরিশাল ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে।’ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের এই বক্তব্য নিয়ে আওয়ামী লীগের একাংশের নেতাদের (সাদিক আব্দুল্লাহ অনুসারী) মধ্যে নানান আলোচনা চলছে। দলটির নেতাদের প্রশ্ন, সিভিল প্রশাসন একজন নির্বাচিত মেয়রকে এভাবে বলতে পারেন কি না?
গত ১৮ আগস্ট বুধবার রাতে বাসভবনে হামলার পর ইউএনও মুনিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণের ভেতরে বিভিন্ন স্থানে শোক দিবস উপলক্ষে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব:) জাহিদ ফারুক শামিম (এমপি)’র ব্যানার-পোস্টার লাগানো ছিল। রাতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এসব ছিঁড়তে আসে। রাতে লোকজন ঘুমাচ্ছে জানিয়ে তিনি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বৃহস্পতিবার সকালে এগুলো ছিঁড়তে বলেন। এরপর তারা তাকে গালিগালাজ করতে থাকে। একপর্যায়ে তারা ইউএনওর বাসায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। রাতে দুই দফায় তারা হামলা চালিয়েছে বলেছিলেন ইউএনও মুনিবুর রহমান।
কী ঘটেছিল সেই রাতে? ভয়ঙ্কর সেই রাতে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী (কর্নেল অব:) জাহিদ ফারুক শামিম এর শোক দিবসের ব্যানার অপসারণকে কেন্দ্র করে বিসিসি’র কর্মী এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ’র অনুসারীদের সঙ্গে ইউএনও’র নিরাপত্তা কর্মীদের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় ঘটে। ইউএনও বিসিসির পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের বলেছিলেন, রাত হয়ে গেছে, মানুষ জন ঘুমাচ্ছেন। পরের দিন আপনারা ব্যানার অপসারণের কাজটি করেন। অভিযোগ উঠে, এতে অগ্মিমূর্তিরূপ ধারণ করে বিসিসির কর্মী, আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের একাংশের নেতাকর্মীরা একপর্যায়ে আনসার সদস্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। ক্ষিপ্ত হয়ে ইউএনও’র বাসভবনে মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ অনুসারীরা হামলা চালায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণসহ আত্নরক্ষার্থে আনসার সদস্যরা গুলি চালাতে বাধ্য হন। আর বরিশাল জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের দাবি, ব্যানার অপসারণ করতে গিয়ে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ইউএনও’র বাধার মুখে পড়েন। ইউএনও সবার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতে থাকেন। পরিস্থিতি শান্ত করতে সেখানে যান মেয়র। তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন ইউএনও। সাদিক অনুসারীরা বলছেন, নিয়মিত রুটিন ওয়ার্কের কাজ হিসেবে সেদিন উপজেলা পরিষদ চত্বরে গিয়েছিল বিসিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ঘটনার পরে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেন সাদিক আনুসারীরা। ঘটনার পরবর্তীতে আহুত এক সংবাদ সম্মেলনে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস বলেছিলেন, ‘একটি শান্ত শহরকে অশান্ত করতে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ইউএনওর বাসায় কেউ হামলা করেনি। এটি একটি পরিকল্পিত ঘটনা। আমরা মনে করি, শোকের মাসে এটি একটি মানবতাবিরোধী কাজ। আমরা এর বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করছি।’
ঘটনার বিবরনে বুধবার দিনগত রাত ৩টার দিকে নগরীর কালিবাড়ি রোডস্থ সেরনিয়াবাত ভবনে বরিশাল নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, যে কাজ করতে গিয়ে আজকের এ ঘটনা, ওই কাজটি আমাদের রেগুলার কাজ। এরআগে সংবাদ সম্মেলনে আমি ব্যানার নিয়ে স্টেটমেন্ট দিয়েছি, পুরোনো ব্যানার বা ভূইফোর সংগঠনের ব্যানারগুলো সরিয়ে ফেলতে। এতে শহর পরিষ্কার হবে। আর আপনারা জানেন মনে হয়, আমার নিজের করা ব্যানারটিও আমি খুলে ফেলেছি। আর সেই ধারাবাহিকতায় পরিষ্কার করতে করতে তারা থানা কাউন্সিলে গিয়েছে। আপনার দেখেছেন থানা কাউন্সিলের ভেতরে বিভিন্ন লোকজন, বিভিন্ন ব্যানার দেয়। আর যেখানে সিটি করপোরেশনের লোকজন কাজ করছিলো সেটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এর বাসা না। ওখানে পুকুর আছে, যেখানে সাধারণ মানুষ গোসল করে, ওখানে মসজিদ আছে, ওখানে আরো অনেক অফিস আছে, ওখান থেকে পেছনে বসবাসকারী মানুষদের যাতায়াতের রাস্তাও রয়েছে। সিটি করপোরেশনের কর্মীরা আমাকে যেটা জানিয়েছেন, ওখানে কাজ প্রায় শেষের পথে ছিলো, পরিষ্কার করে চলে আসবে তখন ইউএনও সাহেব বের হয়ে সিটি করপোরেশনের কর্মীদের বলেছে কার কাছে জিজ্ঞাসা করে সেখানে তারা গিয়েছে। কর্মীরা বলেছে, তাদের গালাগালি করা হয়েছে। আর এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ওনার বাসায় হামলার অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু ওনার বাসার গেটের ভেতরে কি তারা ঢুকেছে। ওখানে আমাদের ১ নম্বর যুগ্ম সম্পাদক ছিলো, তারপর প্রচার সম্পাদকের সঙ্গে সিনিয়রদের পাঠালাম সেখানে কি হয়েছে দেখার জন্য। তিনি বলেন, যখন তারা আমাকে বললো যে গুলি হচ্ছে, তখন আমার বাসায় আমি, আমাদের সিটি করপোরেশনের সিও, মহানগর আওয়ামী লীগের অনেক নেতারা উপস্থিত ছিলো। আমি তাৎক্ষণিক একাই ঘটনাস্থলে চলে গেলাম। সিও সাহেবও পেছনে পেছনে রওনা দিলেন। আমি যখন ঘটনাস্থলে গিয়ে হেলমেট খুলে কর্মীদের বললাম তোমরা গেটের বাইরেই দাঁড়াও কেউ ভেতরে যেও না। এরপর একা থানা কাউন্সিলের গেট দিয়ে যখন ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম এবং বললাম আমি বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র। তারা সে কথা শুনে অনবরত গুলি করা শুরু করলো। এরমধ্যে পেছনে যে নেতা-কর্মীরা ছিলো তারা সকলে এসে মানবপ্রাচীর বানিয়ে আমাকে বাহিরে নিয়ে আসলো। তারপর ওখানে থেকে আমার খুবই খারাপ লাগছে, খুবই লজ্জা লাগছে। তাই আমি ওখান থেকে চলে আসছি। চলে আসার পরে শুনলাম আবারো গুলি হয়েছে। আমাদের প্যানেল মেয়র গাজী নঈমুল হোসেন লিটুকে রেখে আসছিলাম যাতে ওখানে অপ্রতিকর কিছু না ঘটে। তিনি বলেন, আমি গুলিবিদ্ধ হয়নি, তবে আমাকে গুলি করা হয়েছে, আর সেগুলো আমার জ্যাকেটের কারণে শরীরের ভেতরে লাগেনি কিন্তু গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছি। আর গুলির সময় নেতা-কর্মীরা সামনে চলে আসায় তাদের গায়েই গুলিগুলো লেগেছে। কতজনের গায়ে লেগেছে তা আমি হিসেব করে বলতে পারবো না। কতজন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন সে বিষয়েও এখন কিছু বলতে পারবো না। ব্যানারকে কেন্দ্র করে এমন ঘটনা ঘটতে পারে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কি বলবো বলেন, গুলি করা হয়েছে ওখানে। মেয়রের গায়েও পর্যন্ত গুলি করা হয়েছে। মেয়র বলেন, আমি ওখানে যাওয়ার পরে পুলিশ কমিশনার সাহেব, র‌্যাবের সিও, আনসাররা গুলি করায় আনসারদের প্রধানকেও ফোন করেছি। কিন্তু আমি চলে আসার পরে পুলিশ বের হয়ে আসার পরও আবারো নাকি গুলি হয়েছে। মহানগর আওয়ামী লীগের এক নম্বর যুগ্ম সম্পাদককে যেহেতু আটকে রাখা হয়েছে, তাই হয়তো প্যানেল মেয়র গাজী নঈমুল হোসেন লিটু আলোচনার জন্য ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাকে গুলি করা হয়েছে, ৩৫-৩৭টি শটগানের গুলির পিলেট তার গায়েও লেগেছে। আমাদের সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাস ব্যানার উচ্ছেদের সময় থেকেই ওখানে ছিলো। তার গায়েও গুলি লাগছে। তিনি বলেন, ঘটনার অবশ্যই জোড়ালো তদন্ত চাইব এবং অবশ্যই আমরা আইনের আশ্রয় নেবো। মেয়র হিসেবে এভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব না। আমি মেয়র হিসেবে তাহলে ব্যর্থ। প্রধানমন্ত্রী আমাকে শপথ পরিয়েছেন, আমার বাবা আছেন তারা সিদ্ধান্ত নেবেন। যদি আমার অপরাধ হয়ে থাকে, আমি আমার রেজিগনেশন লেটার দিয়ে দেবো। মেয়র বলেন, আপনার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়ে থাকলে আমাকে বলতে পারতেন। বরিশালে এতো বছরে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি, যে এইভাবে আমাদের গুলি করা লাগবে। আবার শুনলাম যারা আহত হয়েছে তাদের গ্রেফতার করার জন্য মেডিক্যালে গেছে। তাহলে ঠিক আছে, অপরাধ হয়ে থাকলে তাদের হয়নি, আমি মেয়র মাথা পেতে নিলাম আমি রেজিগনেশন লেটার প্রধানমন্ত্রীর কাছে দিয়ে দেবো।
প্রসঙ্গত, গত ১৮ আগস্ট বুধবার রাতে নগরের সিঅ্যান্ডবি সড়কে উপজেলা পরিষদ কম্পাউন্ডে প্রতিমন্ত্রীর ব্যানার অপসারণকে কেন্দ্র করে ইউএনও’র নিরপত্তায় থাকা আনসার, সিটি করপোরেশনের স্টাফ, পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে রাতভর হামলা, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগের অভিযোগ ওইসময়ে ইউএনও’র নিরাপত্তায় আনসারদের শটগানের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হওয়াসহ পুলিশের হামলায় সিটি করপোরেশনের স্টাফ ও আওয়ামী লীগের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। অপরদিকে, ইউএনও’র সরকারি বাসভবনে আওয়ামী-ছাত্রলীগ বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনায় ইউএনও ও পুলিশের পক্ষ থেকে মেয়রসহ আওয়ামী লীগের ছয় শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়। তাদের মধ্যে ২২ জন কারাগারে আছেন। পরবর্তী সময়ে মেয়রের পক্ষ থেকে ইউএনও এবং ওসিসহ শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করে আদালতে অভিযোগ দায়ের করা হলে বিচারক পিআইবিকে তদন্তের নির্দেশ দেন। এ ঘটনায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মুনিবুর রহমান, পুলিশের পক্ষে উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহজালাল মল্লিক, সিটি করপোরেশনে পক্ষে রাজস্ব কর্মকর্তা বাবুল হালদার, প্যানেল মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য রফিকুল ইসলাম খোকন পাল্টাপাল্টি চারটি মামলা দায়ের করেন। এরমধ্যে ইউএনও ও পুলিশ কর্তৃক দায়েরকৃত উভয় মামলার প্রধান আসামী বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ও সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ অনুসারী ও সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক বরিশাল আদালতে দুটি মামলা করা হয়। মামলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মুনিবুর রহমান, কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নুরুল ইসলাম আসামি হয়েছেন।
সেই ভয়ঙ্কর রাতে কী ঘটেছিল? তদন্তে বহুল আলোচিত ঘটনা উন্মোচন করা হোক। আক্রমনকারী সকলকে আইনের আওতায় এনে যথোপযুক্ত বিচার করা হােক। ঘটনার পরে ময়লা-আবর্জনা অপসারণের পরিবর্তে বরিশাল শহর যে ময়লার ভাগারে পরিণত করা হয়েছিল, সেই বিষয়েও দায়ী ব্যক্তিদের বিচার করা হোক। অপসারিত হোক দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তের দুই জগদ্দল পাথর।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক ও বার্তা প্রধান, রণাঙ্গণের মুখপত্র ‘দৈনিক বিপ্লবী বাংলাদেশ’।
মেইল : ahmedjalalbsl@gmail.com

*মতামত বিভাগে প্রকাশিত সকল লেখাই লেখকের নিজস্ব ব্যক্তিগত বক্তব্য বা মতামত।