Home শিক্ষা ও ক্যাম্পাস প্রাথমিক বৃত্তির ফলাফলে লেজেগোবরে অবস্থা, তদন্ত কমিটি গঠন

প্রাথমিক বৃত্তির ফলাফলে লেজেগোবরে অবস্থা, তদন্ত কমিটি গঠন

20

ডেস্ক রিপোর্ট: প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি পরীক্ষার ফলাফলে লেজেগোবরে অবস্থা তৈরি হয়েছে। বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ না নিয়েও বৃত্তি পাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আবার এমন ঘটনাও ঘটেছে যে, এক জন শিক্ষার্থী দুই জেলায় দুই বারই ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। এমন অবস্থা জানার কয়েক ঘণ্টা পর স্থগিত করা হয়েছে ফলাফল। আর ফলাফল স্থগিত করার ঘটনায় ওয়েবসাইটে দেওয়া ৮২ হাজার ৩৮৩ অভিভাবক শিক্ষার্থীর মধ্যেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। এমন উদ্ভট ফলের বিষয়ে গতকাল রাতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বৃত্তি পরীক্ষার ফলাফল পুনঃযাচাইয়ের প্রয়োজন অনুভূত হওয়ায় ফলাফল স্থগিত করা হলো। আজ ১ মার্চ বিকালে এই ফলাফল পুনরায় প্রকাশ করা হবে।
যদিও কর্মকর্তার বলছেন, সংশোধিত ফলাফলে সামান্য পরিবর্তন আসবে। এ দিকে এই ঘটনায় চার সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ফলাফলের এই সমস্যার জন্য কারিগরি ত্রুটির কথা বলছে অধিদপ্তর।
গতকাল বেলা সাড়ে ১২টায় এক সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন, মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদকে সঙ্গে নিয়ে বৃত্তির ফলাফল প্রকাশ করেন। এ সময় বলা হয়, ২০২২ সালের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় মোট ৮২ হাজার ৩৮৩ জন শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছে। এর মধ্যে ট্যালেন্টপুলে ৩৩ হাজার ও সাধারণ কোটায় ৪৯ হাজার ৩৮৩ জন শিক্ষার্থী বৃত্তি পেয়েছে। বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বৃত্তি পাবে। একই সময়ে এই ফল ওয়েবসাইটেও দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে ফলাফলের প্রতিটি পাতা ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।

ওয়েবসাইটে ফলাফল পেয়ে বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে। মিষ্টির দোকানগুলোতে দেখা যায় উপচে পড়া ভিড়। মিষ্টি বিতরণ চলে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বাড়ি।
কিন্তু বিকালেই সমস্যা দেখা যায়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছেই ভুলের খবর আসে। সঙ্গে সঙ্গে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের এই ফলাফল আপাতত প্রকাশ না করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
কিছু কিছু মহলের অভিযোগ, পছন্দের প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের বৃত্তির তালিকাভুক্ত করতে গিয়েই সমস্যা হয়েছে। এর দায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট শাখার প্রকৌশলীদের। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এদিকে বৃত্তির ফলাফল প্রকাশের পরপরই ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ভোলার লালমোহনে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ করেছেন পৌর শহরের দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তাদের দাবি লালমোহন মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও লালমোহন হা-মীম রেসিডেন্সিয়াল একাডেমিতে মেধাবী শিক্ষার্থী থাকলেও তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। শিক্ষকরা জানান, লালমোহন পৌর শহরের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২৮ জন বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে ২৬ জন বৃত্তি পায়। অথচ পৌরসভার স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান লালমোহন মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২৫ জন পরীক্ষা দিলেও তাদের মাত্র দুজন বৃত্তি পেয়েছে। অন্যদিকে প্রতিটি পরীক্ষায় রেকর্ড ফলাফল করা লালমোহন হা-মীম রেসিডেন্সিয়াল একাডেমিতে ১৫ জন পরীক্ষা দিলেও সেখানে কেউই বৃত্তি পায়নি। এ ক্ষেত্রে অনিয়মও দুর্নীতির অভিযোগ করেছেন তারা।
অন্যদিকে পরীক্ষা না দিয়েই বৃত্তি পাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। পটুয়াখালীতে প্রাথমিকে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ না নিয়েও এক শিক্ষার্থীর ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি লাভের খবর পাওয়া গেছে। জেলার গলাচিপা উপজেলার সুতাবাড়িয়া সারকেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর এমন ফলাফল প্রকাশ হয়েছে। এ ব্যাপারে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক মো. মাহবুব মল্লিক সাংবাদিকদের জানান, বৃত্তি পরীক্ষায় তিন জন অংশগ্রহণের কথা থাকলেও অসুস্থ হওয়ায় ঐ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। অথচ সে বৃত্তি পেয়েছে। আবার ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলায় মডেল প্রাইমারি স্কুল থেকে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করেও ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। আবার একই শিক্ষার্থী কিশোরগঞ্জ জেলার গ্রামাঞ্চলের আরেকটি স্কুল থেকে বৃত্তি দিয়েও ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে।
রাজধানীর একটি সরকারি স্কুল থেকে বৃত্তি পাওয়া এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক সেলিনা বেগম জানান, ‘উচ্ছ্বসিত ছিলাম। মিষ্টিও অনেককে দিয়েছি। উৎসবও শুরু করেছিলাম। কিন্তু ফল স্থগিতের ঘটনায় লজ্জা পাচ্ছি। সংশোধিত ফলে যদি দেখা যায়, আমার সন্তান বৃত্তি পায়নি, তাহলে এই ঘটনা কীভাবে সামলে নেবো। যারা এই ঘটনায় দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি আমি।’
জিয়াউর রহমান নামে এক জন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এই শিশু যারা বৃত্তি পেয়েছে জানল, আবার তাদের মধ্য থেকে কেউ এক জন যদি এখন আবার শোনে সে বৃত্তি পায়নি তাহলে তার মানসিক চাপ কতটা হবে, এটা কি আন্দাজ করা যাবে। অথবা যারা পাবে বলে আশা করছিল, কিন্তু পায়নি, তারা কি রকম মানসিক চাপে আছে সেটাও আন্দাজ করার মতো…! আর যদি এই সমস্যার কারণে কোনো বাচ্চার ক্ষতি হয় এর দায়ভার কি কর্তৃপক্ষ নেবে…?’

এসব বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক ড. উত্তম কুমার দাস বলেন, কিছু জেলা থেকে পাওয়া কোডিংয়ে সমস্যা হয়েছে। বিষয়টি বুঝতে পারার পরই মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে অবহিত এবং তাদের ফলাফল স্থগিত করা হয়। তিনি বলেন, হাতেগোনা কয়েকটি জেলা-উপজেলার ক্ষেত্রে এমনটি হয়েছে। সংশোধিত ফলাফলে খুব বেশি একটা পরিবর্তন আসবে না। মঙ্গলবার সকালেই নতুন করে ফলাফল প্রকাশ করা হবে। এই ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২০ ও ২০২১ সালে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা না হওয়ায় প্রাথমিক বৃত্তি প্রদান করা সম্ভব হয়নি। গত বছরের ২৮ নভেম্বর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় ২০২২ সাল হতে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। গত ৩০ ডিসেম্বর প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা সারা দেশে একযোগে অনুষ্ঠিত হয়। পঞ্চম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে মেধাক্রম অনুসারে ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী নিয়ে বৃত্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলা, প্রাথমিক গণিত, ইংরেজি ও প্রাথমিক বিজ্ঞান এ চারটি বিষয়ে বৃত্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। মোট নম্বর ছিল-১০০ এবং সময় ছিল-২ ঘণ্টা।
ইত্তেফাক