Home জাতীয় ঢাকায় কম ওজনের শিশু জন্মের কারণ বায়ুদূষণ

ঢাকায় কম ওজনের শিশু জন্মের কারণ বায়ুদূষণ

24

ডেস্ক রিপোর্ট: ঢাকায় সন্তানসম্ভবা মায়েদের ওপর বায়ুদূষণের বিরূপ প্রভাব পড়ছে। রাজধানীতে জন্ম নেওয়া ৩ হাজার ২০৬টি নবজাতককে নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভাবস্থায় বেশি বায়ুদূষণের শিকার মায়েদের মধ্যে কম ওজনের শিশু জন্ম দেওয়ার হার বেশি। অকালে সন্তান জন্মদানের ঝুঁকিও তাঁদের মধ্যে বেশি।

গবেষণাটি করেছেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) গবেষকেরা। মঙ্গলবার আইসিডিডিআরবিতে এক অনুষ্ঠানে এই গবেষণার বিস্তারিত আলোচনা হয়।

অবশ্য গত নভেম্বরে গবেষণাটির ওপর ভিত্তি করে ‘ঢাকায় বায়ুদূষণ ও গর্ভাবস্থার ফলাফল’ শিরোনামে আট পৃষ্ঠার একটি নিবন্ধ সুপরিচিত সাময়িকী দ্য জার্নাল অব ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড হেলথ-এ প্রকাশিত হয়েছে।
আইসিডিডিআরবির জলবায়ু পরিবর্তন ও স্বাস্থ্যবিষয়ক শাখার (ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড হেলথ ইনেশিয়েটিভ) গবেষক ও এই গবেষণা দলের প্রধান মাহীন আল নাহিয়ান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা রাজধানীর বায়ুদূষণের তথ্য-উপাত্ত নিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের উৎস থেকে।

আর মা ও নবজাতকের তথ্য-উপাত্ত নেওয়া হয়েছে রাজধানীর আজিমপুরের মা ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট থেকে। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি, তুলনামূলকভাবে বেশি দূষণের শিকার মায়েরা বেশিসংখ্যক কম ওজনের শিশু জন্ম (লো বার্থ ওয়েট) দিচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে সময়ের আগে সন্তান জন্ম (প্রিটার্ম বার্থ) দেওয়ার হারও বেশি।’
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির কারণে বর্তমানে বায়ুদূষণের তথ্য পাওয়া সহজতর হয়েছে। বিশ্বের বড় বড় শহরের বায়ুদূষণের তুলনামূলক তথ্য পাওয়াও এখন কঠিন কিছু নয়। সাম্প্রতিককালে ঢাকার বায়ুদষণ বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ারের তথ্যমতে, ঢাকা বিশ্বের দূষিত নগরগুলোর একটি। প্রায়ই এটি তালিকার শীর্ষে থাকে। গতকাল মঙ্গলবার বায়ুদূষণে বিশ্বে ঢাকার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়।
সব মিলিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসের ২৮ দিনের মধ্যে এক দিনও ঢাকাবাসী নির্মল বায়ু পাননি। এ মাসে ঢাকার বাতাস অস্বাস্থ্যকর ছিল ১০ দিন, খুবই অস্বাস্থ্যকর ছিল ১৫ দিন এবং দুর্যোগপূর্ণ ছিল ৩ দিন। এর আগে ঢাকায় গত জানুয়ারি মাসে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক দিন দুর্যোগপূর্ণ বায়ুর মধ্যে কাটিয়েছে নগরবাসী। ওই মাসে মোট ৯ দিন রাজধানীর বায়ুর মান দুর্যোগপূর্ণ ছিল, যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের বায়ুমান গবেষণাকেন্দ্রের হিসাবে, ধুলা ও ধোঁয়া ঢাকার বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ ভূমিকা রাখে। এ ধুলার বড় উৎস অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে নির্মাণকাজ, পুরোনো যানবাহনের দূষিত বায়ু; আর ৪০ শতাংশ দূষণের উৎস খড়, কাঠ ও তুষের মতো জৈববস্তুর ধোঁয়া ও সূক্ষ্ম বস্তুকণা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ না থাকায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

ঢাকার পাশাপাশি কুমিল্লায়ও বায়ুদূষণ বাড়ছে। ফেব্রুয়ারি মাসে অন্তত তিনবার সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকার শীর্ষে উঠেছিল কুমিল্লার নাম। পরিবেশবিদদের মতে, কুমিল্লায় অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, ট্রাক্টরে করে মাটি ও ইট সরবরাহ, যানবাহনের ধোঁয়া, ইটভাটা ও ঘনবসতি বেশি হওয়া বায়ুদূষণের তালিকার শীর্ষে নাম থাকার বড় কারণ।

গবেষণাপদ্ধতি ও ফলাফল
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অধীন মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে জন্ম নেওয়া শিশু ও তাদের মায়েদের গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য লিখে রাখা হয়। এর মধ্যে আছে মায়ের গর্ভধারণের ইতিহাস, গর্ভধারণের সময়কাল, স্বাভাবিক প্রসব নাকি অস্ত্রোপচারে প্রসব, জন্মের সময় নবজাতকের ওজন, ঠিক সময়ে জন্ম নাকি অকালিক জন্ম ইত্যাদি।

গবেষকেরা এই প্রতিষ্ঠানে ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেওয়া এবং পরিপূর্ণ তথ্য থাকা ৩ হাজার ২০৬টি শিশু ও তাদের মায়েদের গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অন্যদিকে সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর দৈনিক ভিত্তিতে বায়ুদূষণের যে তথ্য দেয়, তা ব্যবহার করেছেন গবেষকেরা।

গবেষকেরা বলেন, একজন নারী তাঁর গর্ভধারণকালে (৯ মাসে) কত দিন বায়ুদূষণের শিকার হয়েছেন তা সরাসরি পরিমাপ করা যায়নি। ৯ মাসের প্রতিদিন এবং ৩ হাজারের বেশি নারীর প্রত্যেকের ক্ষেত্রে কাজটি করা সময়সাপেক্ষ ও জটিল। তবে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় নির্দিষ্ট দিনে একজন মানুষ কতটা দূষণের শিকার হতে পারেন, তা পরিমাপ করা সম্ভব। এভাবে গর্ভধারণের পুরো ৯ মাসে মোট দূষণের পরিমাণ বের করেছেন গবেষকেরা। এভাবেই সবচেয়ে কম ও সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার সন্তানসম্ভবা নারীদের শ্রেণি তৈরি করেছিলেন তাঁরা। গবেষকেরা এর সঙ্গে মায়েদের জন্ম দেওয়া সন্তানদের তথ্য মিলিয়েছেন এবং শেষে তুলনা করেছেন। তাতে বায়ুদূষণের ভূমিকাটি ধরা পড়েছে।
জন্মের সময় নবজাতকের ওজন যদি ২ হাজার ৫০০ গ্রামের কম হয়, তাহলে তাকে ‘লো বার্থ ওয়েট’ বা কম জন্ম–ওজন বলা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, সবচেয়ে কম দূষণের শিকার মায়েদের মধ্যে কম ওজনের শিশু জন্ম দেওয়ার হার ২০ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার মায়েদের মধ্যে এই হার ৩৬ শতাংশ। অর্থাৎ বেশি দূষণের শিকার মায়েদের মধ্যে কম ওজনের শিশু জন্ম দেওয়ার হার ১৬ শতাংশীয় বিন্দু বেশি।

কোনো শিশুর জন্ম মায়ের গর্ভধারণের ২৫৯ দিনের আগে হলে তা অকালিক শিশু হিসেবে বিবেচিত হয়। গবেষকেরা দেখেছেন, সবচেয়ে কম দূষণের শিকার মায়েরা ৯ শতাংশ অকালিক শিশুর জন্ম দিয়েছেন। বেশি দূষণের শিকার মায়েদের মধ্যে এই হার ১৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৬ শতাংশীয় বিন্দু বেশি। এ ক্ষেত্রেও পার্থক্যটি চোখে পড়ার মতো।

উদাহরণ আরও আছে
স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা হচ্ছে। আইসিডিডিআরবির গবেষকেরা তাঁদের প্রবন্ধের সূচনা অংশে বিরূপ প্রভাবের কিছু উদাহরণও উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণ ভ্রূণের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে। বাতাসে থাকা অতি সুক্ষ্ম বস্তুকণার (পিএম ২.৫) কারণে ২০১৯ সালে সারা বিশ্বে আনুমানিক ২৮ লাখ কম জন্ম–ওজনের ও ৫৯ লাখ অকালিক শিশুর জন্ম হয়েছিল।

সময়ের আগে জন্ম নেওয়া এবং কম জন্ম–ওজন অর্থাৎ অপরিণত জন্ম বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। বাংলাদেশে প্রতি ৪০টি নবজাতকের একটি জন্মের ২৮ দিনের মধ্যে মারা যায় অপরিণত অবস্থায় জন্মের কারণে। বায়ুদূষণের সঙ্গে কম জন্ম–ওজন ও অকালিক শিশুর কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা নিয়ে এই গবেষণার আগে কেউ স্পষ্ট করে দেখেননি বলে জানান গবেষকেরা।

মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য নিয়ে তিন দশকের বেশি সময় কাজ করেছেন জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল। গবেষণাটিকে তিনি তাৎপর্যপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, বায়ুদূষণ থকে স্বাস্থ্যকে রক্ষার জন্য যাঁরা আন্দোলন বা দেনদরবার করছেন, এই গবেষণার তথ্য তাঁদের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। চাইলেও বায়ুদূষণ পুরোপুরি দূর করা যাবে না। তবে বেশি দূষণের এলাকায় মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব। এটাও মনে রাখা দরকার যে মাস্ক বায়ুদূষণ থেকে সুরক্ষা দেয়।
প্রথমআলো