Home সাহিত্য ও বিনোদন প্রহরী

প্রহরী

98

জাকারিয়া আজাদ বিপ্লব:

সকাল বেলা ঘুমটা ভাঙলো কেচর মেচর শব্দে ঘুম ভাঙ্গল, উপশহরে বাস করা গরীব নাইটগার্ড। পোলাডার ইস্কুলের সরোয়ারের বেতন দাও, মাইয়াডার ফোরাক কিনে দাও, বউ অসুস্থ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও, যাওয়ার টাহা নাই। হাউ মাউ কাউ শব্দে ঘুমানোর সাধ্য নেই। গত রাতে বাড়ি ফিরতে পথে পথে মনের ভিতর সবকথা আওরা দিয়ে মনে পরছিল। ছাওয়াল পোনাগুলো শান্ত¡না দিয়ে বউ সে কথাগুলো আমার কাছে পারছিল। সাথে সাথে আজ দিনটার শুধু চাল যা আছে তাতে, জানিয়ে দিল। নাইটগার্ড সরোয়ারের এসবকথা বারবার মাথার মধ্যে ভনভন করে। আমরা রাত প্রহরী মানুষের হাজার কোটি টাকা পাহারা দেই। মনকে মন সোনার গহনা পাহারা দেই,সুন্দরী রূপসী গৃহস্থ বউ অরকি কপোহারা দেই? ফুটফুটে সোনার মত মুখ কোলের আদরের সন্তানের নিরাপত্তা দেই,তাইত আমার নাম সরোয়ার প্রহরী (সিকিউরিটি গার্ড), অথচ আমার জীবনের বেচে থাকার নিরাপত্তা নেই, ছাওয়ালটার খাদ্যের নিরাপত্তা নেই,বউয়ের গতরের নিরাপত্তা নেই। পোলাডা দু’কলম শিখবে তার নিরাপত্তা নেই। সরোয়ারের বউ আম্বিয়া সাতাশের বয়সী এখন শরীরটা বেড়ে ওঠা শবরী কলার মত দেহটা,এখন জ¦লজ¦ল করছে,ভোরের আলোর বেহান বেলা মেজাজ বিগড়ে গেল,হাত দু’টো উপড়ে তুলে অলস্যটা ছাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে,লাফ দিয়ে উঠে পরলাম।

আম্বিয়া আমারে চারটা ভাত দাও তো, আইড্ডা ক্যালা দিয়া আনু (আনোয়ার) সরোয়ারের ছেলে ৮ বছর বয়স শ্যামলা উজ্জল গায়ের রং মাথায় গুনো ঘাসের মতো চুল খোসা ছড়ানো লিচু মতো বেড়িয়ে আছে চোখ দুটো। আনু তুই আজগ্যার আমার লগে বাগানে যাবি, ইস্কুলে যাইতে অইব না চল, আম্বিয়া তোমার কাতা আশ দিয়ে উজ্জ্বল চোহারা নারিকেলের আঁশ দিয়ে বাশবো রশি গাছ নিয়ে গুছাইয়া রাইবো বেহালে আডে নিয়া যামু। মুই পোলাডারে লইয়া যাই কতগুলা কইয়ালতা আর বেত আনমুনে আডে বেচার ফাইন্যে-(জন্য) সাজু (সাজেদা) তোর ফান্যে মোডা কুুমমাইরা লতা আনুম। দোলনা বানাইয়া দিমু। তোর মায়রে আলডা বানাইয়া কাচি ও হাসি নিয়া সরোয়ার ও আনু চলতে থাকে,সরোয়ার জক্সমলের দিকে, এখন হেমন্তকাল চারদিকে ঠান্ডা ও গরম, বিকাল হলে গরমটা বেড়ে যায় আবার শেষ রাতে শীত লাগে পাতলা খাথা গায়ে জড়াতে হয়, গাছপালা কেমন গারো সবুজ হয়ে উঠছে, নানা রঙের ঘাস, ফুল ফুটে আছে, পাখি গাছ গুলো যেন নতুন প্রাণ পেল। বিলের জমির পানি শুকাতে কমতে শুরু করছে, কলমির দলগুলো ফুলে ফুলে ভরে গেছে, শালুকের মাঝে ডিমের কুসুমের মত ফুলে আছে। বুনো কচুর লতি থেকে বাকিয়ে উঠছে চারা, ছোট ছোট পোনা মাছ মাঝে মাঝে কুয়োর মাঝে জমে আছে। খই ভাজার মতো লাফায় দারি না ও খলসে মাছ, অল্প জমে থাকা পানির মধ্যে হলুদ লালচে মোচ বাড়িয়ে থাকে বাগদা চিংড়ি মাছ, হাত দিলে মুঠো ভরে যায়। কই আর শিং, মাছ গাছের ডালের মতো মোট শোল মাছ লেজ দিয়ে বাড়ি মারি সরাৎ করে দৌড় দেয়। টাকি আর বাইন মাছ ঘুপটি মারে কাদা আর পঁচা শেওলার মাঝে।
মাঠের পরে মাঠ, সোনা রাঙা পাকা ধান, গ্রামে গ্রামে ঝি বৌয়েরা উঠান, আর খোলা ভিটে গুলো ঘাস চেঁচে মুগুর দিয়ে সমান করে নেয়। ভেজা গোবর দিয়ে উঠান প্রলেপ দেয়। শুদ্র পাড়ায় বাঁশ আর বেত দিয়ে তৈরী ঢালা, কুলো চালন, হাজি জাহা পুড়া, কুলার তৈরী, ধুম, মেলা আর হাটে তোলার নানা আয়োজন,কামার পারায় চলে, রাত দিন টুনটান খুটখাট কাস্তে, দা, খোদাল খোনতা বানানোর হিড়িক, সবকিছু নবান্নের আয়োজন চারদিক, জঙ্গলে লতা আর বেত, কাঠতে সরোয়ারের মনে পড়ে যায়। নবান্নের আয়োজনের কথা, মনে পড়ে যায়। আনু তোমার মা আজকি পুরানো দিনের নানা স্মৃতি রানবে, বাজান মা আইজকের বুইচা মাছ, কচুর বই কলাপাতায় মুচমুচে ভাজি করব, আর মুই ফান পাইতা দুইভা ডাউক দরছালাম হেইয়া মান কচুর মুতা দিয়া তোল রানবো। বেশভালো বলে কোমরে গোজা ট্যাং থেইক্যা একটা পাতার বিড়ি জালায় খুক খুক কাশ দেয় আর জোরেটান দিয়ে ভিতরে নিয়ে, গোল গোল ছাড়ে, বিড়ির ধোয়া,
বিড়ি টানতে ছোয়াল টাকে বলে মোবানজান সামজ পৃথিবী” ধন সম্মদ সকল কিছু দুইপ্রকার, সে কেমন বানজান? একটা ধনী আর অন্যটা গরীব, অন্য গুলো যা কয় হেইডা মিছা কথা সমাজ বানাইছে ধনীর জন্য আমরা অইলাম ধনীর জীবন সুন্দর করার উপদান হেইডা কেমন কথা হেই হেইডা ডঅইল তোর মায় মুরা পালে, খোপে রাখে। সমাজ ও অনান্য বা কিছু এগুলো রুগীর নিরাপত্তার জন্য খোপ বানাই বেড়াদীছে শিয়াল তাড়াই বার লাগি, খেকড়েরা ছিড়ে খাবে তেমণী ধনী দের রক্ষায় তা ওদের ধন রক্ষার জন্য অন্যন্য আমার মত প্রহরী মাত্র আর আরখেলে হল উপুরো বিষয়টা কিছুই বুঝেয়ে বাপর্শন কি যাক তুই বড় হইলে এখন এ গুলো বুঝবী না শোন একতা গুলা মনে রাখবি এই এইই পৃথিবী একই আলো বাতাস জীবন মরণ সবই আছে, একই মটিতে হাটি একই জমিনের ফসল আছে, একই আকাশের নিচে সূর্যে আলো পাই, একই বাতাসের অজিক্সেন দেখ জীবন চলার সবকিছু উপর তলার বড় বাবুদের জন্য আর আমাদের জন্য শুধু সারাক্ষণ বাইচ্যা তাহার যুদ্ধ করতে হয়। আর আমাদের খাইডডাই করা পরিশ্রমের এডাই জীবন।অট্টারিকায় ওরা থাকে, ওদের সুন্দর ঘুমের মধ্যে আমরা পাহারাদেই। গরীব শ্রমিক আর কৃষাণের জীবন। কিছু জিগাইলে কয়। আদার ব্যাপারী হইয়া, জাহাজের খবরে লাভ কি? আর কয় তোমাগো নসিবে ভাল নাই। অথচ আমরা গরীবরা সব কিছু বানাইছি। শোন মুই জীবনে পারি নাই। তুই বড় অইলে ধনী আর গরীবের ব্যবধান বুঝাইয়া দিবি। চল অনেক কতা হইছে। আটে যাইতে অনব লতা গুলো আর গুছাইয়া উঠার সরোয়ার সাথে জঙ্গলে হনো আলো বড় দুইডা গাছের মুতালয়।
আম্বিয়া আডে ও ইদ্দা কি আনতে অনব মনে হইরা দা বড় গামছা ডা আর বাপ জানের বানানো ব্যাতের ঝুড়িডা দাও।মিয়ার বট তলার হাটের গেটে যাইয়া দেহা হয় খসরুমিয়া মাষ্টারের লগের মাষ্টার অনেক ভাল ভাল কথা শুনায়। আমাগোর ভাল মন্দ খোজ খবর জিগায় সাথে পাঁচটা আটটা টাহা গোজায় দেই ট্যাংগে। এবং বলে দেই এই টাকা দিয়া পোলাডার বই, জামা কিনা নিও।
যাক দশ কেজি চাউলের দাম দিল মাষ্টার মনে মনে ভাবে সরোয়ার। গত কয়েকদিন ধরে কাশিটা বেড়েই চলছে। সাথে পুরাতন আমাশয়। প্রতি রাতে ঘেউ ঘেউ করা কুকুরের শব্দের সাথে একাকার হয়ে যায় কাঁশির শব্দ। রাতে কুয়াশার চাদরে ঢাকা শিশিরে বউয়ের ঘামে ভেজা ব্লাউজের মতো প্রেমময় হয়ে গেছে। শেষ রাতে আশা লঞ্চের হুইসেলের মতো কুকুর গুলো হুউ, হুউ, হুউ করে কেঁদে ওঠে বিকট শব্দে। শুনে আতকে উঠে মন। সারা দেই কারো প্রিয়জন হারানোর সময় একই রকম শব্দ শুনতে পাই। অবলা এই পাহারাতদদার প্রানীটির মনে কি? এত দুঃখ, কষ্ট? কেউ কখনো জানতেও পারেনি। ও শুধু নিজের কষ্ট গুলো গভীর রাতে একা একা উচ্চস্বরে কেঁদে কেঁদে মনে ভাবটাকে প্রকাশ করে। যাতে ওর কষ্ট গুলোয় কোনো মানুষ ভাগ না বসায়। ডিউটির সময় বাঁশি ফুকতে ফুকতে মনে মনে এসব কথা ভাবেছে সরোয়ার। মাঝে মাঝে ডাক ছাড়ে এই কে কেরে, কে ওখানে?
এই তো সেদিন তিনজন লোহার ভীম চুরি করে পালাইতেছিল ও ধরে ছিল তিন জন চোরকে। ধরাটাই যেন ওর অপরাদ। কত না হেনস্ত করলো মাতব্বর ওকে। সে অপমান দুচার গা মার খাওয়া এখনো মনে পড়ে যায়।

স্বপন দা ক্যান আছ? ভালা কী? দুইটা পাতার বিড়ি দাও। একসাথে কয়েকটি প্রশ্ন করল স্বপনকে সরোয়ার কি বলব ভাই ভাল আছি। তুমি ভাল আছ? এই নাও তোমার বিড়ি,বিড়ি খাইও না না তোমার তো দেখছি অনেক কাঁশ হইছে।
যাক বুড়িটা খুটিতে জরানো পাটের রশির আগুন জ্বলাইয়ানের,জোরে করা টানে নক্ষত্রের কেন্দ্রে মত জ¦লে ওঠে বিড়ি মৃন্ডিটা, বিড়ি উড়ে যাওয়া কুয়াশা রঙের ধোয়ার মত নিজের ক্ষোভগুলো উড়িয়ে দিতে চায়, বার বার ক্ষোভগুলো ফিরে অগ্নি ফুলিঙের মত গভীর রাতে কোপের পাশে জ¦লে ওঠা ফরিঙ্গা শয়তানের মত কিছুক্ষণ পরে মিলিয়ে যায়। মনের বেগ এইত সেদিন শহীদ মাষ্টার কত বললেন,যে সম্মানটা বৈশাখী শেয়ারের মত অনেক এগিয়ে গেছে,শুধু তুমি আর তোমার বস্তির মানুষগুলো পরে থাকলে পুরনো সিবেল পরা ঢেকির পিছন ঘাটের হিদালের মত মাঝে মাঝে সামান্য ঘষে ঘষে পরিষ্কার করার মত একত্র হও,চিৎকার কর কিছুদিন পরে যেই সেই ভাঙা নরখাগরার চাটাইয়ের বেড়া চারা খড়গুলো খড় থেকে যায়। পুরানো কাঁশির মত অষুধ খালে সামান্য দু’একদিন ভালো থাকে।তারপর বারমাসে চলে রক্ত বমি,হাত ও পায়ে পাথরের মত শক্ত হয়ে ওঠা চামরা কড়া কড়াই থেকে বৃষ্টির শেষে সবুজ ঘাসের রঙিন ফুলে ভরে ওঠা সবুজ প্রান্তর,শাপলার ঢেপর ও শালুকের মামা কলার মত হয়েও ওঠে না জীবনের প্রান্তর। গৃহস্থ বউ যেমন অনেক যতœ করে বাড়ির————–কাইনাডিতে গড়ে তোলে শাকসবজি শোভিত বাগান। তেমনি মাঝে মাঝে জোয়ারে ক্ষণিক পলি ও পানি ছোয়া পায় মাত্র বাকি, ————-সময় গরীবের জীবন শুধু চৈত্রের কাঠ ফাঠা মাঠের মত খাঁ খাঁ করে।
আম্বিয়ার মনটা আজ অনেক আশা আর প্রেম ভরা টইটুম্বুর করছে,মনটা বারবার শুধু জালালী কবুতরের মত মনটা স্বামীকে কাছে পাওয়ার আকাংখা মূখটা যেন এটেল মাটির মত উজল হয়ে উঠেছে বৈশাখের পাকা আমের মত ঢাউস দেহটা আম্বয়ার মাঝে মনে হয় ওর চেয়ে চড়–ই পাখি গুলা বেশি মূখী স্বামী বউ দু’জন সারাক্ষণ একসাথে থাকে একজন অন্য আর জনকে খাওয়াইয়া দেয়। জৈবিক চাহিদা মিটার যখন মন চায় আক সোম করে বলে মনে মনে বলে যদি চড়–ই পাখি হইতাম অনেক সুখী হইতাম। সারারাত কাঁদায় ডোবা বানাই মাছের মতমোড়ায় স্বামী সরোয়ার পুরো রাত ভোর হয় ফিরে না শেষ রাতে যখন মজিদে ফজরের আজানের সময় ঘড়ে ফিরে মন্ত দেহটা এসেহ কাটা গাছের মত শুয়ে পড়ে বিছানায় শুয়ার সময় শুরু থুক থুক করে কটা পুরাতন কাশিটা শব্দটা শুনতে পায়
পোলাডা আর মাইডা মজিদে ছেনাড়া পড়তে যাওয়ার জন্য উঠে পরে চুলা থেকে কাচের কয়লা তুলে দাত মাজতে থাকে। স্বামী দেহটা করডা ধাক্কা দেওয়ার পরে ও কোন সারা পায়না মূখটা হাত দিয়ে জোড়ে জোড়ে শ্বাস-প্রশাসের কোন আভাস নেই। পরক্ষনে হাউমাউ করে রাত জাগা শিয়ালের মত পুরো ঘরটা।