Home জাতীয় প্রতিদিন ৫ বছরের কম বয়সী ৩০ শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়

প্রতিদিন ৫ বছরের কম বয়সী ৩০ শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়

41

ডেস্ক রিপোর্ট: অন্য অনেকের মতো স্ত্রী, পুত্র-কন্যা নিয়ে রাজধানী ছেড়ে ঈদ করতে গ্রামের বাড়ি যান জাহিদুল ইসলাম। বাড়ির বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে বের হয় ৫ বছরের সামিয়া ও তার বড় ভাই ৮ বছরের সাফির। রাজধানীর ছোট্ট ফ্ল্যাট বাসার চারদেয়ালের ভেতর থেকে গ্রামের খোলা-মেলা পরিবেশ পেয়ে খুব উৎফুল্ল ছিল সামিয়া ও সাফির। বাড়ির অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলার কারণে বাবা-মাও খুব একটা খেয়াল রাখছিলেন না। কারণে গ্রামের পরিবেশে তো আর গাড়িতে চাপা পড়ার ভয় নেই। এর মধ্যে দৌড়ঝাঁপ খেলতে গিয়ে বাড়ির পাশে ডোবায় পড়ে যায় ছোট্ট সামিয়া। এ কথা দলের অন্য বাচ্চারাও জানে না। সন্ধে হলে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বাচ্চাদের দলে ছোট্ট সামিয়া নেই। পরে খোজা খুঁজির একপর্যায়ে সামিয়ার লাশ ভাসতে দেখা যায় বাড়ির পাশের ডোবায়। আর তখন শিশুটির শরীরে আর প্রাণ ছিল না। নিমেষেই ঈদে পরিবারটির সেই উপচে পড়া খুশি যেন বিষাদে ভরে যায়।
এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু কারো কাম্য নয়। তবে ঈদের এই সময়ে গ্রামে গিয়ে অনেক শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। সেই তথ্য খুব একটা নথিভুক্ত হয় না বা গণমাধ্যমের দৃষ্টিগোচর হয় না। সাঁতার না জানা, নদীতে নেমে গোসল করতে গিয়ে কিংবা পরিবারের অগোচরে এমন দুর্ঘটনা ঘটে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। এ ধরনের মৃত্যু প্রতিরোধে তাঁরা বিভিন্ন পরামর্শ জানিয়েছেন।
এ বিষয় নিয়ে কাজ করা ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স ফর ড্রাউনিং প্রিভেনশন (এনএডিপি) অধ্যাপক ডা. আব্দুল জলিল চৌধুরী বলেন, প্রতিরোধযোগ্য এই মৃত্যু আমরা রোধ করতে পারছি না। তিনি বলেন, দেশে প্রতিদিন গড়ে ৫ বছরের কম বয়সী ৩০ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। আর ১৮ বছরের কম বয়সীদের হিসেবে প্রায় ৪০ জন শিশুর মৃত্যু হয় বলে জানা যায় বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও ইনজ্যুরি সমীক্ষা-২০১৬ তথ্যে। ফলে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধে ব্যাপক জনসচেতনতার কোন বিকল্প নেই। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর এই ঘটনাগুলো ঘটে থাকে বাড়ির নিকটতম জলাধার, ডোবা কিংবা পুকুরে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (ডব্লিউএইচও) ডুবে যাওয়া রোধে বিভিন্ন কৌশল ও পদক্ষেপ সুপারিশ করে এবং একটি মাল্টিসেক্টরাল উদ্যোগের প্রচার করে যাচ্ছে। মাল্টিসেক্টরাল সহযোগিতা বৃদ্ধি, ডুবে যাওয়া প্রতিরোধে শক্তিশালী নেতৃত্ব এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বাস্তবায়নের মাধ্যমে, এই ট্র্যাজেডি রোধ করতে এবং সবার জন্য একটি নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যৎ অর্জন করা সম্ভব বলে মনে করছে ডব্লিউএইচও।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক ডা. জলির আরো বলেন, দেশে প্রতিবছর গড়ে ১৭ হাজার শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। মৃত্যুর এ সংখ্যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। গবেষণায় দেখা গেছে, এক থেকে পাঁচ বছর বয়সিদের জন্য ‘শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র’ পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু রোধ করতে পারে ৮২ শতাংশ। অন্যদিকে ৬-১০ বছর বয়সি শিশুদের সাঁতার শিখিয়ে তা প্রতিরোধ করা যায় ৯৬ শতাংশ। পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে এ দুই উদ্যোগকে স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ পানিতে ডুবা। বিশ্বব্যাপী দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)। সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশে শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণগুলোর একটি পানিতে ডুবে যাওয়া।

নারী অধিকার ও জেন্ডার নিয়ে কাজ করা সেলিনা আহমেদ এনা পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুকে বড় একটি উদ্বেগের জায়গা জানিয়ে বলেন, বর্তমানে আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষ দুটি বা একটি সন্তান নিয়ে থাকেন। একটি পরিবারে যদি একটা দুটো বাচ্ছা থাকে। সেই একটা দুটো বাচ্চা যদি পানিতে ডুবে মারা যায়, তাহলে পরিবারের জন্য এটি বিশাল ক্ষতি। পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর নানা কারণ গবেষকেরা খুঁজে বের করেছেন। মা ও অভিভাবকদের গাফিলতি আর সাঁতার না জানাকেই মূল কারণ হিসেবে শনাক্ত করে ব্যবস্থাপত্র জারি হয়েছে। পানিতে ডুবে মৃত্যু ঠেকাতে গ্রামে গ্রামে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র চালু করা, ছয় বছর বা তার চেয়ে বড় শিশুদের জন্য সাঁতার শিক্ষার ব্যবস্থার কথাও বলা হচ্ছে।

তিনি বলেন, অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর প্রায় ৬০ শতাংশ ঘটে থাকে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে, সে সময় পরিবারের সদস্যরা বিশেষ করে মায়েরা প্রাত্যহিক কাজে ব্যস্ত থাকেন। অর্থাৎ এই সময়টাতে শিশুদের বিশেষ করে অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সী শিশুদের দেখভাল করার সার্বক্ষণিক কেউ থাকে না। এছাড়া, আমাদের দেশে সামগ্রিক ভাবে বিশেষ করে গ্রামীণ জনপদে শিশুদের প্রাতিষ্ঠানিক পরিচর্যার কোন ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি।
ইত্তেফাক