Home জাতীয় পাহাড়ে রক্তপাত বন্ধ হচ্ছে না

পাহাড়ে রক্তপাত বন্ধ হচ্ছে না

51

ডেস্ক রিপোর্ট: তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এলাকায় বছরে প্রায় ৪শ’ কোটি টাকার চাঁদাবাজি হচ্ছে। জেএসএস (মূল), জেএসএস (সংস্কার), ইউপিডিএফ (মূল) ও ইউপিডিএফ (সংস্কার) এই চারটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ অনেকটা প্রকাশ্যে এই চাঁদাবাজি করে আসছে। ভুক্তভোগী বাঙালি ও উপজাতিরা অভিযোগ করেন, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, গাছের ফল, ক্ষেতের ফসল, ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কৃষক-শ্রমিক-মত্সজীবী, সড়কে চলাচলকারী সকল প্রকার যানবাহন, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, স্হানীয় উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবার, দেশিয় ও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, জমি কেনা-বেচা, এমনকি ডিম-কলা বিক্রি করতে গেলেও চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে করা হচ্ছে অপহরণ, নির্যাতন, নিপীড়ন ও হত্যা।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানায়, চাঁদাবাজি, ক্ষমতা দখল, আধিপত্য বিস্তার ও ভাগবাটোয়া নিয়ে সশস্ত্র চার সন্ত্রাসী গ্রুপের হাতে গত এক বছরে শতাধিক মানুষ খুন-গুম হয়েছেন। আর পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর এ পর্যন্ত ২৪ বছরে পাহাড়ে সশস্ত্র চার গ্রুপের হাতে ৯ শতাধিক মানুষ খুন হয় এবং ১৫শ’ গুম হয়েছে। চারটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে জেএসএস (মূল) ও ইউপিডিএফ (মূল) বেশি চাঁদাবাজি ও খুন-খারাবিতে জড়িত। তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড়ি ৫১ ভাগ মানুষ, বাঙালি ৪৯ ভাগ মানুষ। পাহাড়ি-বাঙালিরা শান্তির পক্ষে। ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, আমরা পাহাড়ে শান্তি চাই। প্রাণহানি, সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজি চাই না। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের এই অঞ্চলে কতিপয় কয়েক জন মানুষের কারণে।

পাহাড়ে এতো লাশ পড়ছে, রক্ত ঝরছে। পার্বত্যাঞ্চলে আমরা পাহাড়ি-বাঙালিরা ভাই ভাই হিসেবে থাকতে চাই। পাহাড়ে কয়েকটি পরিবার শোষণ করে এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ড চালায়। আর তাদের সাপোর্ট করে কিছু সুশীল সমাজের মানুষ। তিন পার্বত্য জেলায় শান্তি বিনষ্টকারীদের কঠোর হাতে দমন করতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন পাহাড়ি-বাঙালিরা।

পাহাড়ে প্রায় দু’যুগের বেশি সময় ধরে সশস্ত্র আন্দোলন চলার পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার ও জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি। চুক্তির পর খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে শান্তিবাহিনীর শীর্ষ গেরিলা নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) তার বিপুলসংখ্যক সহযোগী নিয়ে অস্ত্র সমর্পণের মধ্য দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। চুক্তি অনুযায়ী সরকারের পক্ষ থেকে একটাই দাবি ছিল যে, তারা পাহাড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাতে পারবে না। কিন্তু দীর্ঘ ২৪ বছরেও তারা সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। অথচ সরকার অধিকাংশ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেছে। শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়েছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তির ৭২ ধারার মধ্যে ইতিমধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে এবং ৯টি ধারার বাস্তবায়ন চলমান আছে। কিন্তু শুধুমাত্র একটি শান্তি চুক্তি না মেনে জেএসএম মূল সহ পাহাড়ে চার সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ পার্বত্যাঞ্চলকে জুম্মুল্যান্ড করার পায়রাতা করছে। চালিয়ে যাচ্ছে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি ও খুন-খারাবি। স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশের এই অংশকে দখল করার। এ কারণে দেশি-বিদেশী লবিস্টও তারা অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ করেছে। সশস্ত্র গ্রুপের শীর্ষ নেতারা চাঁদার টাকায় বিলাস বহুল জীবনযাপন করেন। বিদেশেও বাড়ি আছে অনেকে। তাদের স্ত্রী ও সন্তানরা এদেশে থাকেন না, বিদেশে পড়াশুনা করেন। আর এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের উস্কানি দেয় কতিপয় শিক্ষিত গ্রুপ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে তারা। বিনিময়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের চাঁদার টাকার ভাগ পান তারা। এদিকে চাঁদাবাজির পাশাপাশি পাহাড়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো নারী নির্যাতনও করে। এ ব্যাপারে কেউ মুখ খুললে হত্যা করা হয়। পার্বত্য অঞ্চলের সীমান্তে মিয়ানমার ও মিজোরাম অবস্হিত। সীমান্তে প্রায় ১০১ কিলোমিটার এলাকা অরক্ষিত। হাঁটা ছাড়া সেখানে যাওয়ার কোন রাস্তা নেই। পার্বত্য সীমান্তের ওপারে রয়েছে শান্তি চুক্তিবিরোধী উপজাতীয় সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের ৭টি আস্তানা। সেখান থেকে অবাধে আসছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ। আর এসব মাদক ও অত্যাধুনিক অস্ত্র তারা ব্যবহার করছে এবং সেখান থেকে সারাদেশে উগ্রপন্থী ও সন্ত্রাসীদের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি আঞ্চলিক সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের কাছে এলএমজি, এসএমজি/একে৪৭, ৭.৬২ মি.মি. রাইফেল, এম-১৬ রাইফেল, জি-৩ রাইফেল, ০.২২ রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, পিস্তল, মর্টার, দেশীয় পিস্তল, দেশীয় বন্দুক, হ্যান্ড গ্রেনেডসহ রকেট লাউঞ্চারও রয়েছে। একই সঙ্গে ইয়াবা, আইসসহ ভয়ঙ্কর সব মাদকও দেশে আসছে। ৩ পার্বত্য জেলায় হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধ করেও উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা ওই সাত আস্তানায় গিয়ে নিরাপদে আশ্রয়ে থাকেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঝে মধ্যে অবৈধ অস্ত্র, গুলি ও অন্যান্য সরঞ্জাম উদ্ধার করা হলেও এদের নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। যেহেতু ওই এলাকায় হেঁটে যেতে হয়, তাই যখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সেখানে পৌঁছায়, ততোক্ষণে সন্ত্রাসীরা তাদের আস্তানায় চলে যেতে সক্ষম হয়। উঁচু-নিচু পাহাড় দিয়ে ওই এলাকায় হেঁটে যেতে দুই থেকে তিন দিন লেগে যায়। এই এলাকায় সড়ক স্থাপন করা অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে।

এদিকে পার্বত্যাঞ্চলে গত ২৪ বছরে গুম হওয়াদের মধ্যে ৬০ ভাগ মুক্তিপণের টাকা দিয়ে জীবন বাঁচিয়েছে। বাকিদের বিভিন্ন জঙ্গলে লাশ ফেলে দেয়া হয়। পরে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে। তবে সাক্ষী-প্রমাণের অভাবে পাহাড়ের কোন অপরাধীর শাস্তি হয়নি। যে সাক্ষী দিতে যাবে, তাকে হত্যা করবে। এই কারণে কেউ সাক্ষী দিতে চান না। অনেকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়েছে, কিন্তু সাক্ষীর অভাবে তাদের সাজা হয়নি। এ কারণে পাহাড়ে বার বার ঝরছে রক্ত। একটি খুনের রেশ না কাটতেই হচ্ছে আরেক খুন। সর্বশেষ গত বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে বান্দরবানের রুমার দুর্গম পাহাড়ে সেনাবাহিনীর একটি টহল দলের সঙ্গে জেএসএস মূল দলের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সঙ্গে গোলাগুলির ঘটনায় সেনাবাহিনীর একজন সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসারসহ চার জন নিহত হয়েছে। ঘটনাস্হল থেকে সেনাবাহিনী বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ সহ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে।-ইত্তেফাক