আন্তর্জাতিক ডেস্ক: গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হওয়া জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে মারা গেছেন। দুর্বৃত্তের গুলিতে আহত হয়ে শুক্রবার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। খবর এএফপি’র।
তার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন, আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীর শোক বার্তা দিয়েছেন।
জানাগেছে, শিনজো অ্যাবে শুক্রবার নারা অঞ্চলে নির্বাচনী প্রচারনাকালে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাকে পিছন থেকে কে বা কারা গুলি করেছে, সে সম্পর্কে ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি অথবা পুলিশ কিছুই জানাতে পারেনি। তবে ক্ষমতাসীন এলডিপি জিজি সংবাদ সংস্থাকে জানিয়েছে, অ্যাবের ঘাড় থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তার বেচে থাকার সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। দেশটির নারা অঞ্চলে নির্বাচনী এক প্রচারণা অনুষ্ঠানে বন্দুক হামলা শিকার হওয়ার পর তার এমন পরিণতি হয়। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম এ খবর দিয়েছে।
জাতীয় সম্প্রচার কেন্দ্র এনএইচকে ও বার্তা সংস্থা কিয়োদো জানায়, জাপানের সাবেক এ নেতা রোববারের উচ্চ কক্ষের নির্বাচনের প্রাক্কালে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সময় গুলির শব্দ শোনা যায়।
কে কারা অ্যাবেকে গুলি করেছে সে সম্পর্কে এলডিপি বা স্থানীয় পুলিশ কেউ তাৎক্ষণিকভাবে এ খবর নিশ্চিত করতে পারেনি।
শিনজো আবে ২১শে সেপ্টেম্বর ১৯৫৪ সালে টোকিওতে একটি বিশিষ্ট রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন যার প্রাক-যুদ্ধ, যুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধ-পরবর্তী জাপানে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রভাব ছিল। তিনি ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী। ২০০৬ সালে তিনি প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। ২০১২ সালে তিনি আবারও প্রধানমন্ত্রী হন। তারপর টানা ৯ বছর দায়িত্ব পালন শেষে অসুস্থতার কারণে ২০২০ সালের আগস্টের শেষে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করার কথা থাকলেও এক বছর আগেই দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান আবে। জাপানের ইতিহাসে তিনি সবচেয়ে বেশী সময় ধরে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
১৯৯৩ সালের নির্বাচনে প্রতিনিধি পরিষদে নির্বাচিত হন শিনজো আবে। জুনিচিরো কোইজুমির অধীনে ২০০৫ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত প্রধান মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসাবেও দায়িত্ব পালন এবং ২০১২ সালে সংক্ষিপ্তভাবে বিরোধী দলের নেতা ছিলেন তিনি।

২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করলেও জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির রাজনীতিতে বড় প্রভাব ছিল আবের। এই দলের বড় একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে।
৬৭ বছর বয়সী শিনজো আবে সেসময় জানিয়েছিলেন, তার আলসারেটিভ কোলাইটিস রয়েছে এবং নতুন ওষুধ ব্যবহার করে তার চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। তিনি বহু বছর থেকে আলসারেটিভ কোলাইটিস রোগে ভুগছিলেন। মূলত কৈশোর থেকেই এই রোগে ভুগছিলেন আবে।
শিনজো আবের বাবা ছিলেন জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এ ছাড়া তার এক দাদা জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তার মাতামহ নোবুসুকে কিশি ছিলেন অধিকৃত চীনের প্রকৃতপক্ষে ‘অর্থনৈতিক রাজা’ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নেতৃত্বে উত্তর চীনের একটি জাপানি পুতুল রাষ্ট্র মানচুকুও, এবং যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী হিদেকি তোজোর মন্ত্রিসভায় যুদ্ধাহত উপমন্ত্রী।

তার পিতামহ কান আবে একজন ইয়ামাগুচি জমির মালিক ছিলেন যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রতিনিধি পরিষদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, যখন তার বাবা শিনতারো আবে ১৯৫৮ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত প্রতিনিধি পরিষদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, প্রধান মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রী হিসাবে কাজ করেছিলেন, এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী।
শিনজো আবে আবে ১৯৭৭ সালে সেইকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এবং ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার স্কুল অফ পলিসি, প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে পাবলিক পলিসি অধ্যয়ন করেন। এপ্রিল ১৯৭৯ সালে, আবে কোবে স্টিলের জন্য কাজ শুরু করেন। তিনি ১৯৮২ সালে কোম্পানি ত্যাগ করেন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রীর নির্বাহী সহকারী, এলডিপি জেনারেল কাউন্সিলের চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত সচিব এবং এলডিপি মহাসচিবের ব্যক্তিগত সচিব সহ বেশ কয়েকটি সরকারি পদ অনুসরণ করেন।
১৯৯১ সালে তার পিতার মৃত্যুর পর ১৯৯৩ সালে ইয়ামাগুচি প্রিফেকচারের প্রথম জেলায় নির্বাচিত হন আবে, নির্বাচিত চারজন প্রতিনিধির মধ্যে সর্বাধিক ভোট পেয়ে জয়ী হন। ১৯৯৯ সালে, তিনি সামাজিক বিষয়ক বিভাগের পরিচালক হন। তিনি ২০০০ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ইয়োশিরো মোরি এবং জুনিচিরো কোইজুমি মন্ত্রিসভায় ডেপুটি চিফ ক্যাবিনেট সেক্রেটারি ছিলেন, তারপরে তিনি লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সেক্রেটারি-জেনারেল নিযুক্ত হন।
আবে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির মরি ফ্যাশানের সদস্য ছিলেন। এই দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিরো মোরি। জুন’ইচিরো কোইজুমি মরি গোষ্ঠীর একজন সদস্য ছিলেন, কিন্তু একটি উচ্চ দলীয় পদ গ্রহণ করার সময় রীতি অনুযায়ী এটি ছেড়ে দিয়েছিলেন। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত, আবের বাবা শিনতারো একই দলটির প্রধান ছিলেন।
আবের বড় ভাই হিরোনোবু আবে মিতসুবিশি শোজি প্যাকেজিং কর্পোরেশনের প্রেসিডেন্ট এবং সিইও হন, যখন তার ছোট ভাই নোবুও কিশি পররাষ্ট্র বিষয়ক সিনিয়র ভাইস-মিনিস্টার হন।
আবে ১৯৮৭ সালে একজন সোশ্যালাইট এবং প্রাক্তন রেডিও ডিস্ক জকি আকিয়ে মাতসুজাকিকে বিয়ে করেন। তিনি মরিনাগা, একজন চকোলেট প্রস্তুতকারকের প্রেসিডেন্টের কন্যা। তিনি তার স্পষ্টবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ‘দেশীয় বিরোধী দল’ হিসাবে জনপ্রিয়, যা প্রায়শই তার স্বামীর বিরোধিতা করে। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তার স্বামীর প্রথম কার্যকালের পর, তিনি টোকিওর কান্দা জেলায় একটি জৈব ইজাকায়া খোলেন, কিন্তু তার শাশুড়ির অনুরোধের কারণে ব্যবস্থাপনায় সক্রিয় নন।