পলাশ কলি হোসেন শোভা: আমি যেতে পারবোই না, আমারে তুই আর একবারও বলবি না যাবার কথা
দোস্ত তোরে ছাড়া আমি যাবো না। আরে কাজের ফাকে ইকটু গল্প করবো তোর সাথে চল তুই না করিস না।
তুই জানিস কি বলছিস তুই। ঘরে মিতু আছে যদি জানতে পারে আমারে জবাই করে ফেলবে
আরে না মিতু টেরই পাবে না মাএ তে দুদিন যাবো। জানিস তো প্যারিস থেকে আসছি শুধু কয়টা ছবি আঁকতে দুমাস পর আমার একজিবিশন না করিস না চল্ চল্ দোশত্।
রায়হানের পীড়াপীড়ি তে রাজী হয়ে যায় ইফতি।
রায়হান দেশবরেণ্য চিএশিল্পী। কয়েক বছর ধরে প্যারিসেই থাকছে হঠাৎ দেশে আসা। এবারের সাবজেক্ট মেয়েদের নিয়ে কাজ করা। মফস্বল শহরেই বড় হয়েছে আর এখানেই এসেছে সাবজেক্ট অনুযায়ী ছবি আঁকবে। পেয়েও গেছে অসাধারণ রুপসী নাকি মেয়েটা। রেল স্টেশনের কাছেই থাকে। কয়েক ঘর বাস করে ওখানে মেয়েটা নানীর সাথে থাকে। আর কেউ নেই। নানীর খবরদারীতেই থাকতে হয় চব্বিশ ঘন্টা।
বিকেল শেষ হবার পথে দরজার কড়া নাড়তেই। এক বয়স্ক মহিলা খুলে দিলো, আইছেন? লগে এইটা কে? দুজনে কি করবেন?
না মানে আমার বন্ধু ও থাকবে। সমস্যা হবে না
ওওহ্ টেকা আনছেন? পাঁচ হাজার, দশটা বাজলে আর থাকন যাইবো না। পরদিন আয়া বাকি কাম সারবেন। আচ্ছা মাথা নেড়ে সায় দেয় রায়হান।
ভিতরে ঢুকেন।
রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে ঘরটা দেখতে থাকে ইফতি। পুরানে রুম দেয়ালে সিনেমার নায়ক নায়িকাদের পোস্টার। একটা দেয়াল ঘড়ি আর অপূর্ব একটি মেয়ের ছবি। মনে হচ্ছে স্বর্গের অপ্সরা এ ঘরে বাসা বেঁধেছে।
একটা খাট পাশে টেবিল। সস্তা কেরোসীন কাঠের আলমারী কিন্তু চেয়ার একটাই। কোথায় বসবে ভেবে পাচ্ছে না দুজনই
বসছেন না কেন সাহেব। সরি আসতে দেরী হলো। দুজনেই ফিরে তাকালো, মানে কি? এটা কি মানুষ না সাক্ষাৎ পরী? হা হয়ে তাকিয়ে থাকে ইফতি এত সুন্দর মেয়ে মানুষ হয়?
একজনকে বিছানায় বসতে হবে।
আমি রায়হান, ও ইফতি। তুমি করে বলবো কিন্তু নইলে সহজ কেউই হতে পারবো না আর তা না হলে কাজটাও ভালো হবে না।
কি নাম তোমার? কি ভাবে তোমরা চলো? সবাই কি ছবি আকতে আসে নাকি?
সাহেব আমার নাম নূপুর। এখানে গান গাই রাত দশটার পর আসর বসে লোকজন গান শুনে যা দেয় তা দিয়েই চলি
ইফতি বেশ উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করে গান গাইলে হারমোনিয়াম তবলা কোথায়?
নূপুর মুখ টিপে হেসে বলে,আপনি বিশ্বাস করেননি এইতো? ঐ যে মেঝের কোনায় ওসব ঢাকা আছে। তাকিয়ে দেখে তাইতো মনে হচ্ছে।
ওই তুই থামতো ইফতি, কাজ করতে দে।
রায়হান নূপুর কে ঠিকমত বিছানার একপাশে বসিয়ে দেয়, নড়বে না কিন্তু
স্কেচ করা শুরু করে রায়হান আর মনের ভেতরে উথাল-পাথাল শুরু হয় ইফতির। এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে নূপুরের দিকে কয়েবার চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নেয়।
দশটা বাজতে চললো, নানীর গলা খাখারি ওপাশ হতে। আজ চইলা যান। কাজ আছে আমাগো।
দুজনেই রাস্তায় এসে সিগারেট জ্বালায়।
রাহি তুই কই আনলি? তোরে এর খবর কে দিসে ক তো?
আরে বদু দিসে ও তো এদিকেই থাকে।
ইফতি একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যায়। মিতুর কথা সে বেমালুম ভুলো গেলো কয়েট ঘন্টার জন্য ।
দোস্ত কাল আমারে নিয়ে আসিস।
তুই তো আসতেই চাইছিলি না,এখন আবার…
আরে আমি তো পরী দেখতে যাবো তুই যাবি ছবি আঁকতে।
রাতে মিতু খেয়াল করে ইফতি অনেক বেশি অস্হির।
কি হইছে তোমার? ঘুমাচ্ছো না কেন?
কিছু হয়নি, ঘুম আসছে না তুমি ঘুমাও।
এটা কি করে সম্ভব? আটমাস আগে পাগলের মত প্রেম করে বিয়ে করছে মিতুকে।তিনটা বছর প্রেম তাদের। সুখে দিন কাটছে। আজ একটা মেয়ে যে কিনা খুব সস্তায় জীবন যাপন করছে গান শুনিয়ে জীবন চালায়, তার রুপ দেখে এতটা কেন উতলা সে নিজেও বুঝছে না।
পরদিন নূপুরের রুমে ঢুকেই ইফতি পানি খেতে চাইলো। আজ অনেকটা সহজ হয়ে তিনজনই কথা বলছে।রাহি বারবার নূপুর কে হাসতে নিষেধ করছে। অকারনেও সে হাসছে কিন্তু কেন? আসলে ইফতির দিকে চোখ পড়লেই হাসি আসছে কি করবে?
সাহেব আমার ছবি একে কি করবেন?কার কাছে বিক্রি করবেন?
বিদেশে একটা একজিবিশন আছে ওখানে দেখাবো। কেউ কিনলে কিনবে।
না তুই বিক্রি করিস না।
চমকে তাকায় রাহি ইফতির দিকে, মানে? আমার কাজটা কি তুই ই ক?
চুপ করে থাকে ইফতি। একসময় ছবি আকা শেষ হয়।
দেখি দেখি আমায় কেমন একেছেন।সুন্দর তো!
তুমি এরচেয়ে বেশি সুন্দর নূপুর । ইফতির কথা হিহি করে হেসে উঠে,আপনারে বলছে।
আর কথা বাড়ায় না ইফতি। দুজনেই বেরিয়ে আসে।
ইফতি ভুলে যা দুদিনের কথা। দেস্ত তোরে আনা আমার ঠিক হয় নাই।আমিও রুপে পাগলা হইতাম, জানোস তো নারীরা আমারে টানে না।
কবে চলে যাবি?
আছি আরও কিছু দিন। নাটোর যাবো আগামীকাল। যাইরে।
আজ রাতেও কেমন অস্তিত্বে ভুগতে থাকে ইফতি। মিতু সেই কখন ঘুমিয়ে গেছে। তার কোন ঘুম নেই?
সকালে বেলা করে উঠেই দে দৌড় অফিসে একটা মাল্টিনেশন মোবাইল কোম্পানিতে জব করে উচ্চ পদে। কাজে মন বসানে কঠিন হয়ে পড়ে। বিকেল হতেই কেমন এক
ঘোরের ভেতর দিয়ে নূপুরর দরজায় এসে কড়া নাড়ে।নানী খুলেই বলে আজ আবার কেন? কাম তো শেষ। একা দেখি কি কাজ সাহেব?
নানী এমনি এসেছি গল্প করতে।
নাতিন তো গল্প করার লাইগা না। রাতে আইসা টাকা দিয়া গান শুইনা যাইয়েন।
পাঁচ হাজার আছে আমি শুধু গল্প করবো।
আসেন। দশটার আগে চইলা যাইবেন।
আচ্ছা বলে রুমে ঢুকেই দেখে খিলখিল করে নূপুর হেসেই চলেছে
আমি পড়ছি বিপদে আর তুমি হাসছো?
কি বলছেন সাহেব?
এই সাহেব সাহেব বলবে না। আমরা বন্ধু । নাম ধরে ডাকবে। ধুরু কি কন? বস্তির লোক আমরা, আমাদের কিসের বন্ধু কিসের বিয়ে, দশ ভুতে চড়াইয়া খায়। সে রাতে নূপুর তার গানের জলসা বাতিল করে দেয়। সারারাত দুজনে গল্প করে কাটিয়ে দেয়। শুধু মিতুকে জানিয়ে দেয় জরুরী কাজে শহরের বাইরে আছে ফিরতে পারছে না।
এ যেন এক রুটিনে পরিনত হয়ে গেলো অফিস শেষ হতেই নূপুরে কাছে। মিতু ইফতির এই পরিবর্তনে অবাক হয় কিন্তু কিছু ই বুঝতে পারেনা। তাছাড়া সে নিজেও ডাক্তার বিজি থাকে অনেকটা সময়। রাতে মিতু বুঝে যায় আগের মত ইফতি তাকে কাছে টানে না
মাস খানেক পর
তুমি আজ কোথায় গিয়েছিলে সন্ধ্যায় বাড়ি না এসে।
কোথায় যাবো? কাজ ছিলো তাই দেরী হয়েছে।
অনেক দিন ধরেই দেখছি রাতে বাইরে কাজ থাকে আসতেই দেরী হয় কারণ টা বলবা ইফতি?
মানে কি? মিতু আমি তো বলেছি, আবার জানতে চাইছো কেন? তুমি তো এমন ছিলো না!
তুমিও এমন ছিলে না, ঘরে বউ রেখে বাজারের মেয়ে নিয়ে রিক্সায় ঘুরে বেড়াও
হে বেড়াই তো?
ইফতি তুমি বুঝছো কি বলছো?
বুঝেই বলছি। মিতু ওকেও আমি ভালবাসি বিয়ে করবো।
মিতু কোন কথা বলে না থম ধরে যায়। পরদিন নূপুর কে বলে ঢাকায় আসে ইফতি অফিসের কাজে। বলে আসে ফিরেই বিয়ে করে এখান থেকে নিয়ে যাবে।
সাত দিন পর ইফতি ট্র্যুর থেকে ফিরে আসে। বাসায় মিতু কে দেখতে পায় না। বিকেলের দিকে সেই চেনা দরজায় নক করতেই নানী দরজা খুলে জড়িয়ে ধরে ইফতি কে। তুমি কই আসিলা? আমার নূপুর তো আর নাই। তুমি ওরে নিয়া গেলা না কেন? কই আসিলা তুমি?
কি শুনছে ইফতি হতভম্ব হয়ে যায়। মানে কি? মাটিতেই বসে পড়ে, কি হইছে নূপুরের ? আমার সাথে তো তিন আগেও কথা হয়েছে ফোনে।
এক ম্যাডাম আইছিলো কি কথা হইছে জানি না। রাতের বলা আমি ঘুমে রেলের তলে জীবন দিসে। তোমার নাম্বার নাই, ফোনটা লইয়াই ঝাপ দিসে আমার কলিজা আমার নাতিন বলেই বিলাপ পাড়তে লাগলো।
আজ দশদিন ইফতি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ঢাকার একটা মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পাশে পরম মমতায় ভালবাসায় মিতু সেবা করছে ইফতি কে আগের ইফতি তে ফিরিয়ে আনার জন্য ।
(গল্পটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা হয়েছে )
লেখক : অধ্যাপক, (অব) মীরপুর গার্লস আইডিয়াল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ঢাকা।