Home মতামত পহেলা বৈশাখ উদযাপন হোক আনন্দ ও উচ্ছাসের

পহেলা বৈশাখ উদযাপন হোক আনন্দ ও উচ্ছাসের

68

বেগম শায়লা সিমি নূর: আজকাল শিল্পে নেতিবাচক ও উস্কানিমূলক চিত্র ও লেখনী লক্ষ্য করা যায়। একে এক্টিভিজম বলা যায় কিন্তু , এক্টিভিজম পসিটিভ শব্দ ব্যবহার করে এবং ইতিবাচক আচরণের মাধ্যমেও সম্ভব। শিল্প নিজেই একটি বিপ্লৱ তার শক্তিতেই সে প্রতীয়মান। ঘৃণা দিয়ে শিল্প হয়না , প্রেম দিয়ে হয়। ঘৃণা দিয়ে ঘৃনাকে মুছে দেওয়া যায়না , প্রেম দিয়ে সম্ভব হয় !

প্রত্যেক ধর্ম ও পথ উৎসবের আমন্ত্রণ দেয়: বিরোধিতার বিষয় এখানে আসেনা। প্রত্যেক ধর্ম উৎসবের আমন্ত্রণ দেয়। প্রত্যেক ধর্মে বিভিন্ন উৎসবের মধ্যে দিয়ে জীবনকে উপভোগের কথা বলা আছে। রমজানের প্রতিটা দিন নানা ঘটনার ইতিহাস। পৃথিবীতে যে চারটি প্রধান ধর্মগ্রন্থ রয়েছে তার সবগুলোই নাজিল হয়েছে রমজান মাসে । এমনকি চন্দ্র মাসের পুরো বছর ধরেই চাইলে নানা উৎসব। আর হিন্দু সম্প্রদায়ের রয়েছে ১২ মাসে ১৩ পূঁজা । তেমন রয়েছে বৌদ্ধ-সম্প্রদায়ের। এবং সুফী-সমাজ জন্ম ও মৃত্যু দুটোকেই উৎযাপনের আমন্ত্রণ দেয়। কারণ , আমরা যেখান থেকে এসেছি সেখানেই ফিরে যেতে চাই , শেকড়ে ! সুতারং মৃত্যু…সত্য তাকে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করা সুফিবাদের ধারা ।

ভারতে চারটি ধর্মের উদ্ভব এবং এই ধর্মপ্রবর্তকদের অর্থাৎ মহা মনীষীদের আবির্ভাব হয়েছে যেমন গৌতম বুদ্ধ। কিন্তু ভারতে গৌতমবুদ্ধের প্রভাব খুব কম তুলনামূলকভাবে চায়না ও নেপালে অধিক।
শিল্প ও ধর্ম কোনটাই স্বরসঙ্ঘাত চাপিয়ে দেওয়া যায়না। এ সব তাগিদ অন্তরে প্রতিস্থাপিত। আর পরিবর্তন স্থির-আত্মা ও প্রেমময় অবস্থায় সম্ভব। পানি ঘোলা করলে তা কেউ খেতে পারবে না, পানিকে শান্ত হতে দিতে হবে।

সংস্কৃতি ও সংস্কার হলো পরিবার ও পূর্বপুরুষের জীবনবোধ :

“আর যখন তারা কোন অশ্লীল আচরণ করে তখন বলে, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে এতে পেয়েছি “-সূরাঃ ৭/ আল-আ’রাফ …কোরানের এই বাণীর দ্বারা বুঝা যায় যে মানুষ কতটা সংস্কৃতির ধারক! সংস্কার যা মানুষ তার পূর্বপুরুষদের জীবনবোধ হিসাবে ধারণ করে , তা সে ধরে রাখতে চায় আমৃত্যু; এবং চায় তার পরের প্রজন্ম তা ধরে রাখুক। এ’কে পারিবারিক ও সাম্প্রদায়িক সৌভাগ্যের প্রতিক মনে করে। কিন্তু ,পরিবর্ধন সম্ভব। তা যদি ভালোর লক্ষ্যে হয়, সংশোধন করা যায়।

জীবনবোধ পরিবর্তনের চাইতে জীবনধারা সংশোধনের বিষয়টি ভেবে দেখা যায়:

এখানে প্রসঙ্গ ১লা বৈশাখ। আমাদের সংস্কৃতি, যা বাঙালির নিজ্বস্ব এক জীবনবোধ। অনেকেই এ বিষয়ে এখন ভাবেন যে, এই বৈশাখ উৎযাপন উচিত কি না ? এখানে উচিৎ -অনুচিৎ আসেনা। এখানে ধর্মের প্রসঙ্গ কখনই আসেনা। সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে স্যার হামিদুজ্জামান খান বলেন :

“বৈশাখে আমাদের বাড়ির পাশেই একটা মেলা হতো। ঢোলের শব্দ জানান দিত মেলা এসেছে। ছোটবেলায় আমরা গিয়ে মেলায় উপস্থিত হতাম। একটা বকুল গাছের নিচে খাচায় ভরে পাখি নিয়ে আসত মেলায়।”…..
“আরেকটা মেলা হতো…এটা ছিল আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে। একটা মাজারকে কেন্দ্র করে বিশাল এই মেলাটা হতো। যদিও এটা হতো পৌষ সংত্রান্তিতে। “
এ দুটো কথা থেকে যা জানা যায় – উনি ছোট্ট থেকেই এই উৎসবকে একটি প্রধান উৎসব হিসাবে দেখে এসেছেন , এতে কোনো খারাপ কিছু দেখেন নি। আর এ উৎসব পালন করতো যেমন গ্রামের খুদে ব্যবসায়ী ও কৃষক , তেমনি মাজারেও এ উৎসব পালন করা হতো। বৈশাখ উদযাপন নিয়ে কেউ স্পষ্ট করে কিছু বলবেন আশা করেছিলাম…আমরা হয়তো একটা মধ্যবর্তী অবস্থায় নিরাপদ বোধকরি !

সামান্য স্বীকার্যের মধ্যে দিয়ে সকল দো’টানা দূর করা যেত: চরমপন্থা যেন সংস্কৃতি গ্রাস না করে এবং এই আয়োজনকে বুদ্ধিজীবী বা শিল্পীরা নিজের ক্ষমতা চর্চার জায়গা না বানিয়ে নেয়, সে কথাটি কে বলবেন ? শুধু একটি সামান্য স্বীকার্যের মধ্যে দিয়ে সকল দো’টানা দূর করা যেত, এখানে কৃষকের অগ্রাধিকার দিয়ে।
এ সংস্কৃতি কৃষকদের। কৃষকই আসল শিল্পী এই উৎসবের। রিজিক দাতার পরই কৃষকরা আমাদের মুখে খাবার তুলে দেন । সে খাবার তুলে দেওয়া হাতগুলো আমাদের কোনো উৎসবের অংশ হয়না। এখানে মঙ্গলযাত্রায় একজন কৃষকের মুখোশ থাকে না, লাঙ্গল থাকেনা, থাকেনা কৃষাণী বধূ ! একটি কৃষক পরিবার উপস্থিত থেকে উদ্বোধন করে না !এখানে একটি সংগৃহিত তথ্য দেওয়া প্রয়োজন….
“সৌরবর্ষের চেয়ে চান্দ্রবর্ষ ১১/১২ দিন কম হয়। কারণ, সৌরবর্ষ ৩৬৫ দিনে আর চান্দ্রবর্ষ হয় ৩৫৪ দিনে। চান্দ্রবর্ষে মৌসুম ঠিক থাকে না। অথচ চাষাবাদ, খাজনা আদায়সহ অনেক কাজ মৌসুমের ওপর নির্ভরশীল। মুসলিম জাহানজুড়ে চান্দ্রবর্ষের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম চললেও উপমহাদেশে ভ‚প্রকৃতির বৈচিত্র্য মৌসুমগত সমস্যা সামনে নিয়ে আসে। ফলে প্রয়োজন পড়ে সৌরবর্ষের। সম্রাট আকবর এ কারণে হিজরি চান্দ্রবছরকে সৌরবর্ষে রূপান্তরের আদেশ দেন। আদেশ পালন করেন তার দরবারে বিজ্ঞানী ফতহুল্লাহ সিরাজি।“

পহেলা বৈশাখ দেনা -পাওয়না মিটিয়ে দেবার জন্য একটি নির্ধারিত দিন :

পৃথিবীতে এতো আন্তর্জাতিক ও জাতীয় দিবস আছে, পাওনা মেটানোর কোনো দিন নাই? আছে; পহেলা বৈশাখ সেই দিন। কৃষিজীবী ও ব্যবসায়ীরা এ দিনটিকে ধরে হালখাতা খোলেন …..হালখাতা হলো বছরের প্রথম দিনে দোকান-পাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। শহরের এ’প্রজন্মের অনেকেই জানেই না বিষয়টি !

উৎসব হোক আনন্দের উদ্দেশ্যে এবং উন্নয়নের লক্ষ্যে : আয়োজন শুধু একদিন দুপুর ২টা পর্যন্ত কেন করবেন, বরং এটা সাত দিন করা যায় , বই-মেলার মতো… ষ্টল করে উৎপাদিত দ্রব্যের মেলা হতে পারে। সরাসরি কৃষক উৎপাদিত দ্রব্য নিয়ে আসবেন এতে করে সাশ্রয়ী মূল্যে ভালো মানের পণ্যক্রয় করা সম্ভব, সরাসরি কৃষক থেকে….পণ্যের দাম বাড়ানোর যে কৃত্রিম যড়যন্ত্র তা’এড়িয়ে গিয়ে একটি বাজার তৈরি করা সম্ভব। উৎসব হোক আনন্দের উদ্দেশ্যে এবং উন্নয়নের লক্ষ্যে…

-লেখক : বেগম শায়লা সিমি নূর, সুফী শিল্পী ও কবি, লন্ডন প্রবাসী।