Home মতামত নিবন্ধ: বহুমাত্রিক খোলসের অন্তর্নিহিত ইন্দ্রজাল

নিবন্ধ: বহুমাত্রিক খোলসের অন্তর্নিহিত ইন্দ্রজাল

45

মো. হাবিবুল্লাহ: কোন কিছু সম্পর্কে জানা, দেখা, উপলদ্ধি করার আগ্রহ থাকলে সেটি সম্ভব হয়। অনেক চেনাজানা বিষয় গভীরে চিন্তা ভাবনা করলে অবাক না হয়ে পারিনা। ছোট্ট একটি শব্দ ‘খোলস’ বা খাপ (Casing/Folder) শব্দটি শুনলেই বুঝতে পারি, এটি কোন কিছুর আবর্তিত আবরণ। যা ভাল মন্দ, সুন্দর অসুন্দর, সকল গোপনীয় বিষয়কে ঢেকে রাখে, খোলস নামের বস্তুটি।

কোন কিছুকে গোপন রাখা, নিরাপদে যতনে রাখার অর্থেও মনে করতে পারি। একটি প্রাণি পোষতে হলেও তাকে খাঁচায় বন্দী করতে হয়। পাখিকে আবদ্ধ রাখার খাঁচাটিও একটি খোলস। কিছু খোলস দৃশ্যমান, কিছু একেবারেই অদৃশ্য। অদৃশ্য হলেও তারও খোলস আছে। কোন বিশেষ কিছুর নিরাপত্তার বলয়ে ঘিরে রাখাও সে নিরাপত্তা ব্যবস্থাটিকে অদৃশ্য খোলস ভাবতে পারি। বিষয়টি যুক্তিখন্ডন করে যে, পৃথিবীর কোন কিছুই খোলসের বাইরে নয়। খোলস একটি ছোট শব্দ হলেও এর অর্থ ও গুরুত্ব আমার কাছে অপরিসীম মনে হয়েছে। সেই চিন্তা চেতনা, ধ্যান ধারণা বিশ্লেষণ করে গবেষণা আকারে খোলসকে খোলস মুক্ত করে প্রকাশের প্রয়োজন অনুভব করেছি।

কোন বস্তুকে খোলসে ঢেকে বা মুড়িয়ে রাখলে সেটিকে খুলে না দেখা পর্যন্ত মনে জানার প্রবল কৌতুহুল থাকে। না হয় বিষয়টি অজানা-অচেনা অনাবিস্কৃত থেকে যায়। খোলস কোন প্রাণি, যে কোন বস্তু এমনকি মানুষের মনের খোলস হতে পারে। তবে কোন গাছ পালার ছাল চামড়া, প্রাণী হিসেবে মানুষের শরীরের হাড়গোড়ের কাঠামোটাকে ঢেকে রাখে চামড়া নামক যে বস্তু ও মনের যে খোলস থাকে এ দুটি একই বস্তু নয়। এর মধ্যেও যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। যেমন অনেকেই বলে থাকি লোকটির খোলস পাল্টিয়েছে, এর অর্থ এই নয় লোকটি গায়ের চামড়া পাল্টিয়েছে। এখানে লোকটি তার চরিত্রের দোষ-গুণ, যাই বলিনা কেন যে কোন একটি ভাল মন্দ দিক পরিবর্তন করার কারণে তাকে খোলস বদলানো বুঝানো হয়েছে।

তবে কিছু প্রাণীর মধ্যে সাপ তিনমাস পর পর সত্যিই গায়ের চামড়ার খোলস পাল্টায়। গাছের মধ্যে অনেক গাছ ছাল ঝরিয়ে খোলস পরিবর্তন করে। প্রকৃতির বাঁশ জন্ম থেকেই একটু একটু খোলস পরিবর্তন করে সে বেড়ে উঠে। উপরে আকাশটাকে এক এক সময় ভিন্নরূপে দেখি। তাই ঋতু পরিববর্তনের সাথে সাথে গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শরতের আকাশের রূপ পাল্টে যায়। সাদা সাদা, কালো কালো মেঘই আকাশের খোলস। সময় সময়ে খোলস মুক্ত হয়ে আকাশ বিভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়। উদারহন টানতে গিয়ে সাধারণ বিষয় চলে আসে যা আমরা ছোট বড় সকলে জানি, তারপরেও যদি নারকেলে পানির থাকার রহস্যটা একটুখানি ভাবি, পুরো খোলসের পর শক্ত আবরণ, তারপর নারকেলের আবরণের মধ্যে পানি থাকে ! এত আবরণের দরকার কি ছিল ? দুটো আবরণেই যথেষ্ট, একটি ডিমের মাঝেও দুইটি খোলস । ডিমকে সংরক্ষণের জন্য একটি খোলস হতে পারতো। সৃষ্টির গভীর রহস্য! বুঝা বড় দায়।

প্রকৃতভাবে মানুষের শরীরটাও যেমন একটি খোলস দ্বারা আবৃত। সেইসাথে মানুষের মনটাও আরেকটি ভিন্ন একটি খোলসে আবৃত। কলাগাছ যেমন শত খোলসে তার অস্তিত্ব! যেমন অনেকগুলো খোলসের ভাঁজে বাঁধা কপি উৎপন্ন হয় । মানুষ যখন তার খোলসের মুখ একটু খোলে তখন তাঁর ভিতর থেকে যে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ বেরিয়ে আসে ঠিক সে আচরণটি প্রমাণ করে যে, তাঁর অন্তরের প্রকৃত রূপটি তার মনের খোলসে বন্দি ছিল। আবেগের বশবর্তী হয়ে বেরিয়ে এসেছে। পূর্বে আমরা তাঁকে এমন বলতে দেখিনি । এতে একটি পরিস্কার ধারণা পেলাম মানুষের মন একটি খোলস। এর মধ্যে দুঃখ, হাসি, কান্না, প্রেম ভালবাসা, দয়া-মায়া, চিন্তা চেতনা, এমনকি পৈশাচিক ভাবনাও অন্তনির্হিত।

একজোড়া মোজা যেমন আমাদের পায়ের খোলস, একইভাবে মোজাকে একজোড়া জুতোর খোলস বলতে পারি। যদি আধুনিক বিজ্ঞানের আবিস্কৃত কম্পিউারের দেখতে পাই এর মধ্যে প্রতিটি ফাইলের ফোল্ডার, সাব-ফোল্ডার থাকে। দুইযুগ আগে দুরে থাকা মানুষের সাথে তথ্য আদান প্রদানের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। সেই চিঠির খামটিও পত্রের ‘খোলস’ ।

যে বিষয়টি নিয়ে বলতে চাই প্রকৃত খোলস কি? কেন খোলসের প্রয়োজন? কিসে নেই খোলস? আমাদের মনের আধ্যাত্মিক ভাবনাকে সমৃদ্ধ করতে বিষয়টি জানা প্রয়োজন। প্রাকৃতিক হিসেবে খোলসকে একটি অদ্ভুদ রহস্য বলতে পারি। সৃষ্টিলগ্ন থেকেই প্রকৃতি নানা রহস্যের অন্তরালে খোলসে ঢেকে রাখে তার সকল বস্তু। ফলমুল থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি বস্তু, উপাদানের খোলস রয়েছে।

বিশ্লেষণ করে দেখা যায় খোলস ছাড়া সবকিছুই অর্থহীন এবং খোলস একটি অপরিহার্য বস্তুর নাম, একটি প্রতিকী শব্দ মনে করতে পারি। প্রত্যেক ফলমুলের গুণাগুণ রক্ষার জন্য দেয়া হয়েছে খোলস অর্থাৎ খোসা। ধান, গম, ভুট্টা সকল শশ্যের মাঝেও খোলস রয়েছে। আমরা ঘুমাতে মাথার নীচে যে বালিশ ব্যবহার করি তারও খোলস আছে, একটি নয় পরপর দু’টি। একটি মোবাইল ফোন তারও খোলস রয়েছে যাকে আমরা ইংরেজিতে কেসিং(Casing) বলি। খোলস ছাড়া কোন বস্তুর অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না।

এ লেখাটিতে আমার একটি প্রশ্ন, কোন বস্তুটি খোলসবিহীন? ‍আমরা মানুষসহ প্রায় বেশীরভাগ প্রাণী মাতৃজটরে খোলসের মধ্যেই ছিলাম। তেলেপোকা, প্রজাপতি, মাকড়সা এদের জীবন চক্র দেখে জানা যায় ওরা কয়েকটি খোলস পাল্টিয়ে কয়েক ধাপ পরিবর্তনের পর তাদের জন্ম হয়। আজব এই পৃথিবীটাও একটি খোলসের মধ্যে পুরে আছে মনে করতে পারি। তানাহলে বায়ু মন্ডলে বায়ুর চাপ অনুভুত হতো না। সুর্যেরও খোলস আছে মনে করি, তাই সুর্যের বেগুনি রশ্মি বা তাপ সরাসরি এসে খোলসের কারণে ছেঁকে আসে। সুর্য পূর্বাকাশে খোলস থেকে বের হয়ে পৃথিবীকে আলোকিত করে, সন্ধ্যায় খোলসে ঢুকে যেয়ে রাতের আঁধার নামে? চন্দ্রও ঠিক তাই।

যদি বলি আলোরও খোলস আছে! আশ্চর্য নয় কি? তাহলে আলোর খোলস কি? সেটা অন্ধকার হতে পারে। আলো ও অন্ধকার দু’টি পরস্পরের খোলস মনে করতে পারি। কারণ উভয়ের মধ্যে উভয়ে লুকাতে পারে। রাত্রি যেমন দিনের মাঝে লুকিয়ে যায়,একইভাবে দিন লুকায় রাত্রির মাঝে। এইতো চলছে আলো আঁধারের নিত্য দিনের লুকোচুরির খেলা। পৃথিবীর সকল মূল্যবান ধাতু, খনিজ পদার্থ, তরল দাহ্য পদার্থ সবকিছুই মাটির নীচে পাতালে মাটির নানা আবরণ দিয়ে ঢাকা থাকে।

আমার কাছে এই বিষয়টি এতই ব্যপক মনে হয় যা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। তাই এত কিছু না ভেবে আমাদের সাধারণ জ্ঞানে শুধুমাত্র মানুষের শরীরে কত খোলস আছে এইটুকু চিন্তা করলেই অবাক হতে হয়। মাথা থেকে পা পযর্ন্ত যত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আছে এর মধ্যে মানুষের স্মৃতির জন্য ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ কোটি সেল বা খোলস আছে, রক্ত প্রবাহের ভিন্ন খোলস, অক্সিজেন গ্রহণ ও বর্জনের জন্য ফুসফুস, হৃদযন্ত্র রয়েছে। খাবার পরিপাকতন্ত্রও একটি ভিন্ন খোলস। প্রকৃতির খোলা বাতাসকে আবদ্ধ করতে প্রয়োজন একটি খোলস নামক জার/বেলুন।

পরিস্কার ধারণা পেলাম এ খোলসের মধ্যেই পৃথিবীর সকল কিছুকে ভিন্ন ভিন্ন সত্তায় পরিচয় ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আলাদা আলাদা করে রাখতে এ খোলস (Casing) ব্যবহার হয়েছে। আমাদের মৃত্যুর পর দেহটাকে কাপড়ের খোলস দিয়ে ঢেকে কবর নামক মাটির গর্তে আরেকটি খোলসে পুরে রাখবে। প্রমাণ করে: পৃথিবীর সবকিছুই খোলসের মধ্যে বন্দী, একমাত্র মহান আল্লাহপাকই খোলসের বাইরে। স্পষ্টত তিনিই আমাদের একমাত্র পালনকারী মহাপরাক্রমশালী সৃষ্টিকর্তা পরম দয়াময় আল্লাহ! যিনি সবকিছুর উর্ধ্বে, তাঁর কাছেই আমাদের নিশ্চিত ফিরে যেতে হবে। তাঁর সকল সৃষ্টিকে তিনি নিজেই হেফাজত করেন। আল্লাহপাক আমাদের সকলকে তাঁর অপরূপ সৃষ্টির গভীর অজানা রহস্য জানা ও বুঝার তৌফিক দান করুন।

-লেখক: গীতিকবি, গবেষক ও অভিনয়শিল্পী।
ইমেইল: habib2729@gmail.com