এম এইচ নাহিদ ।। ধেয়ে আসছে সিত্রাং। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট এ ঘূর্ণিঝড় ক্রমশ উপকূলের কাছাকাছি এগিয়ে আসছে। আজ (২৪অক্টোবর) সোমবার মধ্যরাত বা ভোরের দিকে ঘূর্ণিঝড়টি বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করতে শুরু করবে-জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ইতোমধ্যে সিত্রাং সিভিয়ার সাইক্লোন (প্রবল ঘূর্ণিঝড়) রূপ নিয়েছে। এতে মহা বিপৎসংকেতও জারি করা হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান। এ ঘূর্ণিঝড়ে প্লাবিত হতে পারে ১৫ জেলা। তারমধ্যে ১৩ টিতে মারাত্মক আকারে এবং ২ টিতে হালকা আঘাত হানতে পারে। সবচেয়ে বেশি আঘাত হানার আশঙ্কা রয়েছে বরগুনা ও পটুয়াখালি জেলায়।–বলছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। ফলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকা উপকূল বাসিন্দারা ঘর ছেড়ে ছুটছেন আশ্রয়কেন্দ্রে।

তবে সিত্রাং-এর ভয়াবহতা থেকে রক্ষা ও ক্ষয়ক্ষতি কমাতে প্রস্তুত বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী’র নিজের তত্ত্বাবধানে তাঁর কার্যালয়ে মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে। বন্ধ করা হয়েছে উপকূলের তিন বিমানবন্দর। সকল ধরণের নৌ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে স্কুল-কলেজের ক্লাস-পরীক্ষাও স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত আছেন নৌবাহিনীর সদস্যরাও। এদিকে সিত্রাংয়ের প্রভাবে দিনভর বৃষ্টিতে সারাদেশের মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। রাজধানীর বাসিন্দাদের কষ্টের সীমা ছিল না। বিকাল থেকে নগরীর বেশিরভাগ রাস্তা-ঘাট পানিয়ে তলিয়ে ছিল।

জানাগেছে সোমবার বেলা ১২টায় এ ঘূর্ণিঝড়  চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৪৪০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণ- দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থান করছিল। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে সে সময় বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছিল।

আমাদের উপকূল সংবাদদাতা জানিয়েছে মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অফিস। উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ৭ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে। আর চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ৬ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার নদীবন্দরসমূহকে ৩ নম্বর নৌ-বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিনে বলা হয়েছে, এ ঝড় আরো ঘনীভূত হয়ে উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে সোমবার মধ্যরাত বা মঙ্গলবার ভোর নাগাদ নাগাদ পটুয়াখালীর কলাপাড়ার খেপুপাড়ার কাছ দিয়ে বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে ১৫ জেলাঃ সোমবার দুপুরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেছেন, ‘সিত্রাং বাংলাদেশে আঘাত হানবে। ভারতে আঘাত হানার সম্ভাবনা নেই। উপকূলীয় ১৩ জেলায় মারাত্মক ও ২ জেলায় হালকা আঘাত হানবে। সব থেকে বেশি আঘাত হানবে বরগুনা ও পটুয়াখালী।  বরগুনা সদর ও পটুয়াখালীর কলাপাড়াতে এ ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।’   

ঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রমুখী উপকূলবাসিন্দারাঃ ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচতে বিকাল থেকেই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলজুড়ে থাকা হাজার হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে আসা শুরু করেছেন। মানুষকে আশ্রয় দিতে উপকূলীয় জেলাগুলোতে ৭ হাজার ৩০টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে, যেখানে ২৫ লাখ মানুষ ঠাঁই নিতে পারবে। ইতোমধ্যে পটুয়াখালীতে ৫০ হাজার ৮২২ জন, বাগেরহাটে ৩৯ হাজার, পিরোজপুরে ১০ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছে বলে জেলা প্রশাসন সূত্র অনুযায়ীছেন আমাদের উপকূল অঞ্চলের জেলা প্রতিনিধি ও সংবাদাতারা। সেসব অঞ্চলে রেডক্রিসেন্ট, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগের স্বেচ্ছাসেবীরা মানুষজনকে সরিয়ে নিচ্ছেন। দুর্গম এলাকা থেকে মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে তারা মাইকিংও করছেন।

সীমাহীন দুর্ভোগে রাজধানীবাসীঃ সিত্রাংয়ের প্রভাবে আজ সোমবার সারাদিন বৃষ্টি ঝরছে রাজধানী ঢাকায়। এতে দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী। সোমবার সকাল থেকে প্রকোপ বাড়ে বৃষ্টির। নগরীর পল্টন, কাকরাইল, দৈনিক বাংলা, ফকিরাফুল, মতিঝিল, ইত্তেফাক মোড়, গোবিবাগ, টিকাটুলি, পুরানঢাকা সহ অধিকাংশ এলাকার সড়গুলো পানিতে ডুবেছিল। রিকশা ও গণপরিবহন ছিল কম। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে সকালে যারা অফিসে উদ্দেশে বেরিয়েছেন তাঁরা এ অবস্থায় বিপাকে পড়েন। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও পড়েছেন সমস্যায়। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে অনেককে। দ্বিগুণ ভাড়ায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও উবার ব্যবহার করতে বাধ্য হন। যারা ছাতা নিয়ে বের হননি, তাঁরা অনেকেই ভিজে গেছেন। কেউ কেউ ফিরে গেছেন বাসায়। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে সোমবার কেবল রাজধানী নয়, সারা দেশের মানুষই চরম কষ্টে দিন পার করেছেন।

প্রস্তুত বাংলাদেশঃ এদিকে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মনিটরিং সেল খোলা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সার্বক্ষণিক খোলা থাকবে এই সেল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন। সোমবার বিকেলে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রেস উইং। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য নিম্নোক্ত হটলাইন নম্বর সার্বক্ষণিক খোলা থাকবে: ০১৭৬৯-০১০৯৮৬, ০২-৫৫০২৯৫৫০, ০২-৫৮১৫৩০২২, ফ্যাক্স: ০২-৯১০২৪৬৯।

বন্ধ দেশের তিন বিমানবন্দরঃ ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিমানবন্দর বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। আবহাওয়ার পরিস্থিতি উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে । সোমবার দুপুরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন।

সারাদেশে লঞ্চ চলাচল বন্ধঃ সারাদেশে লঞ্চসহ সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। কর্তৃপক্ষ বলেছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া অবধি কোনো প্রকার নৌযান চলবে না।

প্রস্তুত নৌবাহিনীঃ ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী জরুরি উদ্ধার কাজ পরিচালনার জন্য ১৭টি জাহাজ, এমপিএ ও হেলিকপ্টার নিয়ে প্রস্তুত রয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। সোমবার দুপুরে নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। নৌবাহিনী জানায়, ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ পরবর্তী জরুরি উদ্ধার, ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তায় চট্টগ্রাম, খুলনা ও মোংলা নৌঅঞ্চলে মোতায়েনের জন্য বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ১৭টি জাহাজ, ২টি মেরিটাইম প্যাট্রোল এয়ারক্রাফট (এমপিএ) এবং ২টি হেলিকপ্টার প্রস্তুত রয়েছে। পাশাপাশি, ঘুর্ণিঝড় পরবর্তী উপকূলীয় দূর্গত এলাকাগুলোতে মোতায়েনের জন্য নৌ কন্টিনজেন্ট প্রস্তুত রাখা হয়েছে।