মার্কিন ডলারে আমদানি মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় চট্টগ্রাম বন্দরে আসা তিনটি জাহাজের পণ্য খালাস করা যাচ্ছে না। জাহাজগুলোতে পবিত্র রমজান মাসের বাজার সামনে রেখে আনা হয়েছে অপরিশোধিত চিনি ও ভোজ্যতেল। পণ্যের পরিমাণ প্রায় ৫৪ হাজার টন—আমদানি মূল্য ৩ কোটি ৫১ লাখ মার্কিন ডলার।
পণ্যগুলো আমদানি করেছে চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপ ও ঢাকার মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ (এমজিআই)। আমদানিকারক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্যাংকে বাংলাদেশি মুদ্রায় ঋণপত্র খুলে এসব পণ্য আমদানি করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা, তথা মার্কিন ডলারে দাম পরিশোধ করবে। কিন্তু ডলারের অভাবে ব্যাংক মূল্য পরিশোধ করতে পারেনি। এ কারণে বিদেশি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের অনুমতি দিচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডলার–সংকটে নিত্যপণ্য আমদানিতে সমস্যা তৈরি হওয়ার ঘটনাটি উদ্বেগজনক। আগামী মার্চ মাসের দ্বিতীয় ভাগে শুরু হতে যাওয়া রোজায় তেল, চিনি, ডালসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের চাহিদা বাড়বে। এমন সময়ে ডলার–সংকটে আমদানি করতে না পারলে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। এ বছর রোজার আগে পণ্য আমদানির ঋণপত্র খোলা কম হয়েছে।

জানতে চাইলে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বলেন, ‘রোজায় যাতে কোনো সংকট না হয়, সে জন্য আগেভাগেই পণ্য আমদানির ঋণপত্র খুলেছি। বাংলাদেশি মুদ্রায় পণ্যের দাম পরিশোধ করে দেওয়া হয়েছে। খালাস করতে না পারায় জরিমানা বাড়ছে।’

৫৪ দিন বন্দরে
চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, যে তিনটি জাহাজের পণ্য খালাস করা যাচ্ছে না, তার একটির নাম ‘এম টি সুপার ফরটি’। জাহাজটি মালয়েশিয়া থেকে প্রায় ১২ হাজার টন পাম তেল নিয়ে গত ২৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরের বহিনোর্ঙরে পৌঁছায়। ১ কোটি ২৪ লাখ ডলার মূল্যের এই তেল আমদানি করেছে চট্টগ্রামের এস আলম সুপার এডিবল অয়েল লিমিটেড। জাহাজ আসার পর ৫৪ দিন পেরিয়ে গেলেও তারা পণ্য খালাস করতে পারেনি।

জানা গেছে, জাহাজটি থেকে যত দিন পণ্য খালাস হবে না, তত দিন জরিমানা দিতে হবে আমদানিকারককে। প্রতিদিনের জরিমানার পরিমাণ প্রায় ১৬ হাজার ডলার, যা ৫৪ দিনে দাঁড়ায় ৮ লাখ ৬৪ হাজার ডলারে (প্রায় সোয়া ৯ কোটি টাকা)।

ব্রাজিল থেকে ৬০ হাজার ৫০০ টন চিনি নিয়ে ‘এম ভি কমন এটলাস’ নামের একটি জাহাজ বন্দরে পৌঁছায় ৫ জানুয়ারি। সূত্র জানিয়েছে, জাহাজটি থেকে ২৩ হাজার ৬৫০ টন চিনি খালাস হয়েছিল। তবে ১১ জানুয়ারি থেকে খালাস স্থগিত করে দেয় রপ্তানিকারক। কারণ, বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ডলার–সংকটে ঋণপত্রের বিপরীতে আমদানি দায় পুরোপুরি পরিশোধ করতে পারেনি। গত সোমবার ২০০ মিটার লম্বা জাহাজটি বন্দরের জেটিতে ভেড়ানো হয়। এর মাধ্যমে বন্দরে বড় জাহাজ ভেড়ানোর কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু উদ্বোধনের পর পণ্য খালাস না করে বিকেলে জাহাজটি বহিনোর্ঙরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এই জাহাজের বিপরীতেও প্রতিদিন ৪০ হাজার ডলার জরিমানা দিতে হবে আমদানিকারককে। ১১ জানুয়ারি থেকে খালাস বন্ধ থাকার হিসাবে সাত দিনে জরিমানা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮০ হাজার ডলার (প্রায় তিন কোটি টাকা)।

পণ্য খালাস আটকে যাওয়া তৃতীয় জাহাজের নাম ‘এম টি সোগান’। এটি ব্রাজিল থেকে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল নিয়ে বন্দর জলসীমায় আসে ৬ জানুয়ারি। আমদানিকারক বাংলাদেশ এডিবল অয়েল ও মেঘনা অয়েল রিফাইনারি লিমিটেড। বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের তেল খালাস করা হয়েছে। আটকে আছে মেঘনা এডিবল অয়েল রিফাইনারির পণ্য। জাহাজটিতে প্রতিষ্ঠানটির ৬২ লাখ ডলারের প্রায় ৫ হাজার টন তেল রয়েছে। আমদানিকারকের প্রতিদিনের জরিমানা ৩৮ হাজার ডলার (৪০ লাখ টাকা)। এর আগে গত মাসে ঋণপত্রের জটিলতায় টি কে গ্রুপের আমদানি করা তিনটি জাহাজের পণ্য খালাস হয়েছে ১০ দিন পর।
সরবরাহ নিয়ে দুশ্চিন্তা

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) হিসাবে, দেশে মাসে ১ লাখ ৭০ হাজার টনের মতো ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। তবে রমজান মাসে চাহিদা দাঁড়ায় আড়াই থেকে তিন লাখ টন। চিনির চাহিদা মাসে দেড় লাখ টন। রোজায় তা তিন লাখ টনে দাঁড়ায়।

এবারের রোজায় পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা নিয়ে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে। কারণ, আমদানির ঋণপত্র খোলা কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের শেষ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) অপরিশোধিত চিনির ঋণপত্র খোলার হার আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৮ শতাংশ কমেছে। অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের ঋণপত্র ৪৭, সয়াবিনবীজ ৮৩, ছোলা ৪৭ ও খেজুর আমদানির ঋণপত্র ৩০ শতাংশ কমেছে। অবশ্য জানুয়ারিতে ঋণপত্র খোলা বাড়তে পারে।

সাধারণত রোজার পণ্য তিন মাস আগে আমদানি করেন ব্যবসায়ীরা। এরপর তেল-চিনি পরিশোধন করে বাজারে ছাড়েন। পাইকারি বাজার হয়ে সেই পণ্য খুচরা দোকানে যায়।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ঋণপত্র জটিলতার কারণে পণ্য খালাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংককে কেউ জানায়নি। এ রকম সমস্যার বিষয় জানালে গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

‘দ্রুত সমাধান দরকার’

দেশে ডলারের সংকট চলছে প্রায় ১০ মাস ধরে। গত মে মাসের শুরুতে যে ডলার ৮৬ টাকা ছিল, সেটা এখন ১০৭ টাকা। ডলার–সংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণ করছে। তবে নিত্যপণ্য আমদানির ঋণপত্র খোলা স্বাভাবিক রাখতে দফায় দফায় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এরপরও ঋণপত্র বাড়েনি।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বড় গ্রুপগুলো যেখানে আমদানি করতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে অন্যদের অবস্থা কী তা সহজেই অনুমেয়। আমদানি কমলে রোজায় সরবরাহ কমবে। ইতিমধ্যে চিনি ও গম আমদানি কমার প্রভাব পড়েছে বাজারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার–সংকট সমাধান করতে পারছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। বিদেশি ব্যাংকগুলো ঋণের বিপরীতে নিশ্চয়তা দেওয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। এ জন্য ডলার–সংকট দ্রুত সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রথমআলো